বানভাসি জীবন: সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 20 August 2017, 04:43 AM
Updated : 20 August 2017, 04:43 AM

১.
ইসলাম ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারাহ'র ২৪৫তম আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-
مَنْ ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا فَيُضَاعِفَهُ لَهُ أَضْعَافًا كَثِيرَةً وَاللَّهُ يَقْبِضُ وَيَبْسُطُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ!
'এমন কে আছে যে,আল্লাহকে ঋণ প্রদান করবে? উত্তম ঋণ ; যাতে আল্লাহ তার জন্য তা দ্বিগুণ-বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিতে পারেন। আল্লাহই (জীবিকা) সংকোচিত করেন এবং তিনিই তা সম্প্রসারিত করেন এবং তাঁরই নিকট তোমরা সবাই ফিরে যাবে।' (২:২৪৫)

বিভিন্ন সময় নানা দুর্বিপাকে জনগণের অর্থ সাহায্যের প্রয়োজন হয়। তাই এ আয়াতে মুমিনদেরকে আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করার অর্থ হলো- আল্লাহকে উত্তম ঋণ দেয়া। সমাজের দরিদ্র ও বঞ্চিতদেরকে যে কোন সাহায্য দেয়াও এই ঋণের অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ দুনিয়ায় ও পরকালে মানুষকে এর বিনিময়ে অনেকগুণ বেশী প্রতিদান দেবেন। কারণ, আমাদের জীবিকার মালিক আল্লাহ। আর যা আমরা আল্লাহর রাস্তায় দান করব আল্লাহ তা হিসাবে রাখবেন এবং সময়মত এর প্রতিদান দেবেন। রিজিক বা জীবিকা আল্লাহর হাতে এ কথাটি মনে রাখলে আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করা অনেক সহজ হয়ে যায়!

বিপদের দিনে মানুষের কাজে না লাগা যক্ষের ধনের মতো পুঞ্জিভূত করে রাখা অর্থসম্পদের এক কানাকড়ি দামও নেই। অর্থের প্রকৃত মূল্য নির্ধারিত হতে পারে কেবল আর্তের জন্য সেবা ও প্রেমময় মানবিকতায়!

২.
৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে সূরা বাকারাহ'র ২৪৫তম আয়াত আত্মস্থ করবার সময় এসেছে এখন। যখন দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে চলছে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। ভেসে যাচ্ছে ঘরবাড়ি, বৃক্ষরাজি ও প্রকৃতির বিচিত্র প্রাণ। আজ বড় বিপন্ন মানুষের জীবন। মানুষ ও তাদের নিত্য সহচর গবাদিপ্রাণিগুলোর না আছে আশ্রয় না আছে অন্ন। কী সংকটাপন্ন অবস্থা শিশু, নারী ও বয়োবৃদ্ধদের! ভিটাশূন্য মানুষেরা অকালে হারিয়ে ফেলা তাদের প্রিয় স্বজনদের কবরস্ত বা সৎকার করবার মাটিটুকুও পাচ্ছে না।

গেল শনিবার সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, এবারের বন্যায় এখন পর্যন্ত ১৮ লাখ ৮৫ হাজার ৫৮৯ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৩০ জেলার ১৭৯ উপজেলা ও ৪৬টি পৌরসভার প্রায় ১৩ লাখ ৩৪ হাজার ২৫০ পরিবারের ৫৮ লাখ ৪৬ হাজার ৬২০ জন বানভাসি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মারা গেছে ৫৫ হাজার হাঁস-মুরগি। দুই হাজার ৭৮৯ কিলোমিটার রাস্তা, ১২৩টি ব্রিজ ও কালভার্ট, ২৮০টি বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানি উঠায় বিভিন্ন জেলার ১৯৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৫৩২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো। এ পর্যন্ত মারা গেছে শত মানুষ।

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের জন্য খোলা আশ্রয়কেন্দ্র ও ত্রাণ সহায়তা এখনও খুবই অপ্রতুল। গভীর দু:খে নিপতিত বন্যার্ত এসব মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে শুধুমাত্র সরকারি ব্যবস্থাপনা ফলপ্রসূ হবে না। এখন দরকার সবার সমন্বিত উদ্যোগ।

প্লাবন নিয়ে আসে প্রভুদের চাপিয়ে দেয়া জলের রাশি। সাথে বহন করে বিচিত্র রোগের প্রাদুর্ভাব। বানভাসি নিরাশ্রয় অনাহারী মানুষদের বাঁচাতে পারে কেবল আপনার সদিচ্ছা, ভালোবাসা আর সহমর্মিতা।

৩.
অনেকেই লাখ টাকা ব্যয় করে সহস্র ঝঞ্ঝাট সয়ে পূণ্যের আশায় দ্বিতীয়বার তৃতীয়বারের মতো হজে যান। ধর্মাচার পালন করতে যেতে আপনাকে হবেই। তবু সূরা বাকারাহ'র ২৪৫ এর আলোকে আপনার বিপন্ন স্বজনের দিকেও মুখ তুলে চাইবার জরুরত আছে বৈকি। মানবিক বিপর্যয়ে স্বয়ং প্রভু আপনার কাছে ঋণ চেয়েছেন। প্রভুর সৃষ্ট জীব হিসেবে স্রষ্টাকে কর্জ দেয়ার চেয়ে বড় পূন্য আর কী হতে পারে?

অনেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছেন বিশাল গরু কোরবানি দিয়ে এলাকায় নিজেকে দানবীর হাজী মহসিন হিসেবে প্রমাণ করবেন। আপনার বিপুল অর্থ আছে, তাই ধর্মাচারের কর্তব্য হিসেবে এটা আপনি নিশ্চয় করতে পারেন। তাছাড়া কোরবানি সাথে জড়িয়ে আছে প্রাণিপালন ও চামড়াশিল্পের অর্থনীতি। লাখো মানুষের জীবনজীবিকা এর সাথে জড়িত। তবু হৃদয়বান ও বিবেচক মানুষ হিসেবে একবার ভেবে দেখেন না, কোরবানির বাহুল্যব্যয়ে কিছুটা কাটছাঁট করে বন্যার্ত বিপদগ্রস্ত মানুষের মুখে এক চিলতে হাসি ফোটানো যায় কিনা? জীবনের জন্য জীবনের কান্নায় প্রশান্তি খোঁজা যায় কিনা?
অসহায় প্রাণ বাঁচাতে আপনার বহুকষ্টে সঞ্চিত মুদ্রার কিয়দাংশ ব্যয় করলে কোরবানির তৃপ্তি বা সওয়াবের আশাই পূর্ণ হবে; একদম ঠকবেন না নিশ্চয়। আপনার সামনে আবার রাখা থাকল পবিত্র কোরআনের বাকারাহ-২৪৫!

আজ এই বিপদের দিনে খোদাকে ঋণ না দিলে আর কবে দেবেন? মহাপরাক্রমশালী স্রষ্টা নিশ্চয় বারবার আপনার কাছে আবদার করবেন না? নি:শ্বাসের এক মুহুর্তের ভরসা নেই। আজ দুর্যোগের দিনে খোদার পথে জানমাল ব্যয় করবার এমন মোক্ষম সময় আপনি আর পাবেন কি প্রিয় ধার্মিক মানুষ?

হিন্দুধর্মীয় গুরু স্বামী বিবেকানন্দের বাণী 'জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর' অথবা মধ্যযুগের কবি বড়ু চণ্ডীদাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক বাণী 'শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই'-এর সাথে বাকারাহ ২৪৫ এর কোনো বিরোধ নেই, বরং সাযুজ্যই শতভাগ। সব ধর্মেই মানুষের জয়গান করা হয়েছে। সেই প্রিয় মানুষের অতল দু:খে, ভয়াল দুর্দিনে একজন হার্দিক মানুষ হিসেবে আপনার উদার হস্ত কি প্রসারিত হবে না?

ফারদিন ফেরদৌস
সুখেরছায়া
১৮ আগস্ট ২০১৭