কোরবানির সাম্যবাদ ও সৌন্দর্য!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 1 Sept 2017, 07:53 PM
Updated : 1 Sept 2017, 07:53 PM

১.
সরকারি ফোরামে উন্নয়নের গালগপ্প যতই শুনি না কেন এখনও দেশের কোটি লোক কোরবানির ধর্মাচারে অংশ নিতে পারেন না আর্থিক সক্ষমতা না থাকায়। সেই না পারা কোটি মানুষের বছরে অন্তত একবার সুস্বাদু আমিষের ভরসা হলো লাখো সামর্থ্যবানের কোরবানির মাংসের সামাজিক বন্টনের ভাগ। এমনিতে টাকাওয়ালারা গরীবকে ডেকে এনে গরুর দামি মাংস খাওয়াতেন না। তবু তো ঈদের একদিন তারা ঠান্ডা ফ্রিজকে কিঞ্চিৎ অভুক্ত রেখে গণমানুষকে মাংস বিলান। বিশ্বাসী মানুষ হিসেবে আমিও এই ধর্মাচারের অনুবর্তী ও অনুগামী।
প্রাণির প্রাণকে কোরবান করবার জন্যই তাকে পেলে পুষে বড় করা হয়। ঈদবাজারে বেঁচে দিয়ে আর্থিক সক্ষমতা অর্জন করেন প্রান্তিক মানুষ। এখান থেকে কোটি টাকার রপ্তানিযোগ্য চামড়া পাই আমরা। গরুর হাড় থেকে জীবনরক্ষাকারী ক্যাপসুলের দামি কভার তৈরি করা হয়। সুতরাং এই গ্রহে মানুষকে বেঁচেবর্তে থাকতে হলে 'প্রাণিরক্ষার কথা' বলে কোরবানির যৌক্তিকতা বাতিল করা যাবে না।

২.
কোরবানির সৌন্দর্য্য অন্যরকম ও অনন্য। বছরজুড়ে খুব মায়া করে সন্তানবাৎসল্যে প্রাণিকে মার্কেটিং-এর জন্য উপযোগী করেন খামারিরা। তারপর ঈদের আগে আগে নানা পথ ঘুরে বাজারে নিয়ে তোলেন ওটাকে। বাজারে রঙ্গবেরঙের গরু, ছাগল, দুম্বা বা উটকে কী যত্নে সাজিয়ে রাখা হয়! সেখান থেকে দরদামে বনিয়ে ক্রেতা ওটাকে বাড়ি নিয়ে এসে যত্নআত্তি করেন। এসময় শিশুদের আনন্দ যেন ধরে না। নতুন মালিক ও তাদের স্বজনেরা কচি ঘাস বা সুগন্ধি শাইল ধানের চিকন খড় খাওয়াতে খাওয়াতে গরুকে খুব ভালোবাসেন এবং এটা দেখে গরুও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মনে মনে হয়ত প্রশান্তির হাসি হাসে, এটা দেখতেই ভালো লাগায় মন ভরে ওঠে। গরুর হাসি কি দেখা যায়? কেউ কেউ বাড়ির এই দু'দিনের প্রিয় অতিথির শিঙ-এ তেল মালিশ করে পলিশও করে। ভেড়া বা দুম্বাকে নিজেদের মাথায় ব্যবহৃত চিড়ুনি দিয়ে আচড়েও দেয়। এভাবে প্রাণি যেন হয়ে ওই বাড়িরই সবচে' খাতির যত্ন পাওয়া একজন। সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে কেউ যখন গরুর ছবির সাথে সেলফি তুলে টাইমলাইনটাকেও 'আমাদের হাম্বা' ক্যাপশান দিয়ে গরুময় করেন, আমার দারুণ লাগে! বিশেষ করে কেউ যখন ঈদের আগের রাত পর্যন্ত গরুর আচরণের ওপর ভিত্তি করে তার একটা নাম নির্ধারণপূর্বক যেমন: আমাদের 'ঠান্ডা মিয়া' অথবা আমাদের 'রাগান্বিতা' কিংবা আমাদের 'বলদা' বলে স্ট্যাটাস আপ করেন তা দেখতে বা পড়তে বেশ লাগে! আমি ব্যক্তিগতভাবে এধরণের বিচিত্র গরু কাহিনী খুব উপভোগ করি। এবং আমার কোরবানির ঈদের আনন্দ এ পর্যন্তই।

৩.
ঈদের দিন নামাজে অংশগ্রহণ শেষে ঘরে ফিরে পানাহার করে কিছুসময় ঝিম মেরে থাকি। বেলা বাড়ার সাথে সাথে মায়াভরা চোখে গরুগুলো দেখি আর বুকের ভিতর ভাঙ্গন অনুভব করি। কখনও গরুর চোখেও জল দেখি আমি। পৃথিবীর এই আলো বাতাসের সাথে বিচ্ছেদব্যথায় ওরাও কাঁদে হয়ত। ওদেরও প্রাণ আছে, আছে অনুভূতিও।
এদিন বিকেলবেলা আর ভালো লাগে না। বাড়ির বের হতে পারি না। পথেঘাটে ঘরের আনাচেকানাচে একটাই দেখার দৃশ্য, বড় বাঁশ ও রশি দিয়ে কয়েকজন মিলে চেপে ধরে জোর করে গরুকে ছুড়ির নিচে নিয়ে যাওয়া, ধারালো তরবারি হাতে মৌলভীদের ছুটোছুটি, রক্তের গড়াগড়ি, চামড়া ছাড়ানোর কসরত, পিচ পিচ করে কাটা প্রিয় প্রাণির ভাগবাটোয়ারা, বিচ্ছিন্ন মস্তকের বিভৎসতা, বাচ্চাদের হাতে হাতে গরুর ইউরিন ব্লাডারের খেলাধুলা। এদিক-ওদিক হাড্ডি নিয়ে বেওয়ারিশ কুকুরদের কামড়াকামড়ি।
আর এখনকার যুগে এসব ছবিই আসে ফেসবুকের পাতা ভরে। সেখানেও চোখ রাখা যায় না। সমাজের সবচে' শিক্ষিত ও উচ্চপদস্থ মানুষটিও কাটা মাংস, খন্ডিত মস্তক বা ছুড়ি-চাপাতি সামনে রেখেই সহাস্যে সেলফি তুলে স্ট্যাটাস দেন: আমরা কোরবানি দিলাম, আল্লাহ কবুল করুন! ফেসবুক কি স্রষ্টার প্রচারমাধ্যম যে, কবুল ও মঞ্জুর করবার জন্য এখানেই বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে? আজকাল পিচ পিচ কাটা মাংস দেখলে মানুষের প্রতি আরাকানি অত্যাচারের কথাই মনে আসে। তাহলে কোরবানির ত্যাগের ধর্মাচারটাকে এত অসুন্দর ও রুচিহীনতায় পর্যবশিত করা কি সুশিক্ষতের সাজে?
অথচ এই কাজটি হতে পারে নিরবে নিভৃতে গোপনীয় নির্দিষ্ট পয়েন্টে। যেখানে শিশু, দুর্বলচিত্তের মানুষ ও বয়োবৃদ্ধের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ থাকবে। এত সহজ রক্তারক্তি বা প্রাণহত্যার বিষয়টি দেখে শিশুমনে কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে না? শিশু মনে কি নির্মমতা জন্মাতে পারে না? কোরবানির কার্যক্রম দেখানোর মাধ্যমে শিশুকে মানুষসহ সর্বপ্রাণে ভালোবাসার বিষয়টি কি শেখানো যাবে? এখন প্রশ্ন ওঠবে, আপনি তো বাল্যকালে এমন স্যাক্রিফাইস বহু দেখেছেন, আপনি কি নির্মম নিষ্ঠুর হয়েছেন? আমার উত্তর হলো, আমরা অনেক আগেই ভালোবাসাহীন গোয়ার মানুষে পরিণত হয়ে গেছি। সাম্প্রতিককালে মধুপুরে একজন কর্মঠ ও সুশিক্ষিতা নারী 'রূপা'র প্রতি অমানুষের যে গণ আক্রমণ দেখা গেছে, এমনটা পশুদের মধ্যেও দেখা যায় না!
কাজেই আমরা আল্লাহ'র নামে প্রাণি 'স্যাক্রিফাইস' করব ঠিক আছে, পাশাপাশি বাস্তবে অথবা সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের রুচিবোধটাকে যেন বিব্রত না করি, সুন্দর পরিবেশ রক্তারক্তি না করি। প্রাণির রক্ত হেলাফেলায় প্রকাশ করবার বস্তু নয়। ত্যাগের শিক্ষায় প্রাণকে ভালোবেসে কোরবানির সুন্দর সমাপণ হোক সবার আরাধ্য!

ফারদিন ফেরদৌস
সুখেরছায়া
০২ সেপ্টেম্বর ২০১৭।