রোহিঙ্গা রাজনীতি ও বাংলাদেশের বিপর্যয়!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 7 Sept 2017, 07:25 AM
Updated : 7 Sept 2017, 07:25 AM


রোহিঙ্গারা ধেয়ে আসছে বাংলাদেশের দিকে।
১.
রোহিঙ্গা দমনে পাকিস্তান মিয়ানমারকে অস্ত্র সহায়তা দেয়। বাঙালি মুসলমানরা এখানে অমানবিকতা দেখে না। বিস্ময়করভাবে তারা ভাবে, মানবিকতা দেখানোর দায় শুধু বাংলাদেশের বা বাংলাদেশ সরকারের! বিপন্ন রোহিঙ্গাদের উদ্ধারে কোনো মুসলিম দেশ নয়, ইউরোপ থেকে উদ্ধারকারী জাহাজ আসে। কিন্তু বাংলাদেশকেই রোহিঙ্গাদের সকল ভার বহন করতে হয়। আগের ৫ লাখ আর বর্তমান সংকটে ১ লাখ আমরা গ্রহণ করেছি। অপেক্ষায় আছে আরও ৮/১০ লাখ। দেশহীন এত মানুষের চাপ সইবার ক্ষমতা নিশ্চিতই বাংলাদেশের নেই। রোহিঙ্গা মুসলিম ভাইদের জন্য একমাত্র তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোগান ছাড়া কোনো মুসলিম শাসকের মুখে দু'কথা শুনলাম না। অথচ রোহিঙ্গাদের অসনীয় চাপ বছরের পর বছর বয়ে বেড়াচ্ছি আমরা!


দমন-পীড়নের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে একদল লোক টাকা নিয়ে কক্সবাজারের উখিয়ায় পাহাড়ের ঢালে তাদের ঘর করতে দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
২.
বাংলাদেশ পড়েছে মহাসংকটে। নিজেদের সভ্যতা ও মানবিকতা বজায় রাখতে গিয়ে রোহিঙ্গাদের জায়গা দিচ্ছে। আবার সম্পর্ক বাঁচাতে ভারত বা চীনকেও কিছু বলতে পারছে না। আর পুরনো শত্রু পাকিস্তানতো চাচ্ছেই এই ইস্যুতে বাংলাদেশ বিপাকে পড়ুক।

কাজেই জায়গা দেয়া, মানবিকতা দেখানো বা হাহুতাশ করাটা কোনো সমাধান না। রোহিঙ্গা সংকট নিরসন করতে হবে প্রথমত রোহিঙ্গাদের নিজেদেরকে। আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য তাদের লাগবে কৌশলী রাজনৈতিক নেতৃত্ব। কিন্তু এসবের কিচ্ছু নাই ওদের। বিস্ময়কর হলেও সত্যি ওদের নিজ দেশে নাগরিক অধিকারই নেই!

আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা'র মতো দু'একটি গোষ্ঠী যারা রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে লড়ছে তাদেরও নেই কোনো নিয়মনিষ্ঠ কর্মপরিকল্পনা। তারা হুটহাট বিচ্ছিন্নভাবে হামলা করছে সেনা বা পুলিশ চৌকিতে। যার খেসারত দিচ্ছে লাখো সাধারণ রোহিঙ্গা এবং সর্বোপরি বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে আমাদের কক্সবাজারের স্থিতিশীলতা বলে কিছু নেই। পাহাড় কেটে, টিলা কেটে যে যার মতো খুপরি ঘর তুলছে রোহিঙ্গারা। এদের জীবন কি এখন শুদ্ধপথে বাঁঁচবে? বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অপরাধপ্রবণতার অতীত ইতিহাস কিন্তু সে সাক্ষ্য দেয় না!


মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা দমন অভিযানের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা তিন লাখে পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করছেন জাতিসংঘ কর্মকর্তারা।
৩.
যেহেতু রোহিঙ্গাদের নেই কোনো একজন বঙ্গবন্ধু বা তাজউদ্দীন এবং তাদের হয়ে কথা বলে মাত্র গুটিকয়েক গোষ্ঠী, যারা আবার কিনা জঙ্গি হিসেবে পরিচিত; সেহেতু স্বাধীন আরাকান বা রাখাইন রাজ্যের আবদার এই মুহুর্তে ধোপে টিকবে না। কাজেই রোহিঙ্গাদের প্রতি আমরা নি:সন্দেহে মানবিক হবো তবে তা নিজের দেশের নাগরিকের অধিকার বিনষ্ট করে নয়, দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নয় এবং নিজেদের সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট করে নয়।

রোহিঙ্গাদের স্বাধীন আবাসভূমি ফিরে পেতে তাদেরকেই লড়তে হবে, রক্ত দিতে হবে এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। যেমন একাত্তরে পাক হানাদারের বিরুদ্ধে জীবনপণ লড়েছি আমরা। বিচ্ছিন্ন বোমাবাজি বা জঙ্গি হামলা করে মানুষের অধিকার আদায় হবে না। এর জন্য থাকতে হবে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন। শাসকের রক্তচক্ষুর ভয়ে অন্যদেশে উদ্বাস্তু হওয়াটা সংকটকে ঘণিভূতই করবে, সমাধানসূত্র মিলবে না মোটেও।

তাই সবদিক বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণের সমালোচনা না করে আমাদের উচিৎ আন্তর্জাতিকমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। ভূ-রাজনীতি বুঝতে ও শিখতে হবে আমাদের। ভারত, পাকিস্তান ও চীন তাদের স্বার্থে রোহিঙ্গাদের বিপক্ষে এবং মিয়ানমার সরকারের পক্ষে। বিশ্বমোড়লরাও এই গোষ্ঠীরই অনুবর্তী। তাহলে অর্ধশত বছর ধরে মানবিকতার কথা বলে আমাদের পক্ষপাতিত্বটা কি বরাবর নিজেদের বিপর্যয়ের দিকেই রাখব? ধর্মের কথা বলে উদার আমরা মানবিকতা দেখিয়েই যাব আর সেই মানবিকতার ওপর বন্দুক রেখে চীন, ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমাররা লাভবান হবে, তা কেন? নিজের দেশটা ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়ার আগে ভাবনাটা কিন্তু এখনি জরুরি।

ফারদিন ফেরদৌস
সুখেরছায়া
০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭