আরাকানের অন্ধকার আরসা!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 9 Sept 2017, 08:04 AM
Updated : 9 Sept 2017, 08:04 AM

১.
ওপরের ছবিটি কথিত স্বাধিকার আন্দোলনগোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি তথা আরসা'র নেতা আতা উল্লাহ'র। যার আরেক পরিচয় পাকিস্তানি রোহিঙ্গা। যিনি নিজেকে অন্ধকারে লুকিয়ে রাখতেই খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন! লোকটা দেখতে জঙ্গি'র মতো হলেও ভালো হেডম আছে। গেল ২৫ আগস্ট তাঁর ইশারায় ছুড়ি, লাঠি, ক্ষুদ্রাস্ত্র (এর কিছু অস্ত্র আবার আমাদের আনসার বাহিনীর কাছ থেকে লুট করা) ও হাতবোমাকে সম্বল করে আরাকানের মংডু ও আশপাশের ৩০টি পুলিশ ও ১টি সেনা চৌকিতে হামলা চালানো হয়। মারা যায় ডজন খানেক বার্মিজ আইন শৃঙ্খলা কর্মী। তারপর থেকে প্রতি আক্রমণ হিসেবে বার্মিজ বাহিনীর দমন-পীড়নের জের দেখে চলেছে সারাবিশ্ব। চলছে জ্বালাও পোড়াও ও গণহত্যা। উদ্বাস্তু হয়ে গেছে তিন লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মানুষ। যার ভয়ঙ্কর উদাহরণ নাফ নদীতে ভেসে আসা শিশুদের লাশ এবং ভয়াল দুর্দশায় পড়া লাখো রোহিঙ্গা জনস্রোত। ইতোমধ্যে শরণার্থীর ভিড়ে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব সীমান্তাঞ্চল। এমনিতেই আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার পাহাড়ে রয়েছে কয়েক দশকের আদিবাসী সংকট। তার ওপর উদ্বাস্তু সমস্যা বাংলাদেশকে জটিল পরিস্থিতে ফেলে দিয়েছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জনস্রোত ঠেকাতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার তত্ত্বাবধানে একাধিক 'সেইফ জোন' বা 'নিরাপদ এলাকা' গড়ার আহবান জানিয়ে লিখিত প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এখন সেই প্রস্তাব বাস্তবায়নে মিয়ানমারকে রাজি করাতে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে জোরদার কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো উচিৎ। এবং এই প্রস্তাবে গণমাধ্যম, বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ ও সংশ্লিষ্ট সকলপক্ষের জোরালো সমর্থনও জরুরি।

২.
নাফ নদীতে ভেসে আসা শিশুদের মতো করেই বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও শান্তিও এখন মরণোন্মুখ। কারণ আতা উল্লাহ'র হামলার খেসারতে তিনি ভুগছেন না, ভুগছেন না তাঁর সমর্থক রাষ্ট্র বা গোষ্ঠীরাও। যতটুকু জানি তিনি নিজে আরাম আয়েশেই আছেন। তাহলে এই যে, হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুমুখে ঠেলা দেয়া হলো, লাখো মানুষকে উদ্বাস্তু করে দেয়া হলো এর দায়ভার তিনি বহন করবেন কবে এবং কিভাবে? মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তজুড়ে যে অমানবিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হলো তার নিদান হবে কিসে? হাজারো নারী ও শিশুকে মারাত্মক ট্রাজেডির মুখে ঠেলে দেওয়ার অধিকার কি কারও থাকতে আছে? ওদের মতো অন্যগোষ্ঠীর দ্বারা অতীতে এখনকার মতোই নির্বুদ্ধিতায় ভরা আক্রমণের ফলে বাংলাদেশ ৬ লাখ রোহিঙ্গার ভার বইছে। এবার আরসা কর্তৃক অনুরূপ আক্রমণে ৩ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আবাস গেড়েছে। আরও আসছে বলে সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে। আগে আসা রোহিঙ্গাদেরই বার্মায় ফেরৎ পাঠানো যায়নি। তাহলে এবারে আসা বিপন্ন মানুষেরা কি আর আদৌ মংডুতে ফেরৎ যাবে বা যেতে পারবে?

এইসময় পৃথিবীতে বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন রাষ্ট্র কি আছে যারা মাত্র পনের দিনে ৩ লাখ শরণার্থী গ্রহণ করেছে? তাদের দায়িত্ব নিয়েছে? এমন কোনো দেশ নেই। তারপরও বাংলাদেশের মানবিকতা, সভ্যতা, সৌজন্যতা বা ঔদার্য নিয়ে বিশ্বফোরামে কোনো আলোচনা নেই। বরং বার্মার প্রতিবেশি চীন, ভারত এবং বাংলাদেশের জাত শত্রু পাকিস্তান নিজ স্বার্থ রক্ষায় সু চি'র মতো উদাহরণযোগ্য অশান্তিকামী ও একালের বড় ফ্যাসিস্ট নেত্রির সাথে এক টেবিলে বসে শরাব পান করছে! মার্কিন বা জাতিসংঘরা দু'চার কথা বলছে, তাও মিনমিনে গলায়! আর অন্য মুসলিম দেশের নিরবতার মুখে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নিজে নেতা হওয়ার জন্য বার্মিজ নিপীড়কদের বিরুদ্ধে লোকদেখানো কিছু কথা বলছেন বা রোহিঙ্গাদের দেখতে বউ পাঠাচ্ছেন বটে, কিন্তু তারমতো ধুরন্ধর নেতার দুরভিসন্ধি বোঝা যাবে আরও পরে। রোহিঙ্গাজট নিয়ে এমন নানামুখী দোলাচলের ভিড়ে বাংলাদেশের কূটনীতি এতই দুর্বল যে, বিশ্বকে বুঝাতেই পারছে না রোহিঙ্গাদের জন্য আমরা নিজেদের জীবন দিয়ে দিচ্ছি। যেই ত্যাগের হিসেব মারাত্মকভাবে মেটাতে হবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে!

৩.
যাহোক এই যে আরসা নেতা আতা উল্লাহ আগুপিছু না ভেবে বার্মিজ বাহিনীকে ক্ষেপিয়ে তুলল যার একমাত্র ভুক্তভোগী বাংলাদেশ। ওই নেতা কি কোথাও কোনো মিডিয়াকে সাক্ষাতকার বা বিবৃতিতে বলেছেন যে, বাংলাদেশের এতবড় ত্যাগের কথা? তিনি কি বলেছেন, আরাকানে রোহিঙ্গারা অধিকার ফিরে পেলে বাংলাদেশের সব শরণার্থী সেখানে ফেরত যাবে? না, আতা উল্লাহ বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হওয়া শরণার্থীদের ব্যাপারে এককথাও কোথাও বলেননি! তাহলে ওই লোকটার নিজের স্বার্থে বানিয়ে দেয়া বুঝা আমরা বইতে থাকব কেন? আমাদের মানবিকতা এত সস্তা কেন?

মিয়ানামারে ১০ লাখের বেশি মুসলিম রোহিঙ্গা থাকে রাখাইন প্রদেশে; ১৪ হাজার বর্গমাইলের এই রাজ্যে তাদের জনসংখ্যার হার ৪২ শতাংশ। রাখাইনের মোট জনসংখ্যার ৫২ শতাংশই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তাহলে কোনো নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন ব্যতিরেকে নিজেদেরকে আত্মগোপনে রেখে এই ৪২ শতাংশ সংখ্যালঘুর স্বাধীনতা বা অধিকার আদায় কি দু'চারটা হাতবোমা ফাটিয়ে লাভ করা সম্ভব মিস্টার আতা উল্লাহ?

আধুনিক ভূ-রাজনীতি ছুড়ি আর লাঠি দিয়ে চলে না! এটা ব্রিটিশ আমলের বাঙালি স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বা প্রীতিলতাদের যুগও নয়। এ যুগে ভয়াল মারণাস্ত্র পরমাণু বোমাও যেন কিছু নয়, পৃথিবী এখন তার চেয়ে শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমার পূজারি। অতএব যা যাওয়ার বাংলাদেশের যাচ্ছে, আরসা'র হারানোর কিচ্ছু নাই। কারণ আরসা বিশ্বস্বীকৃত কোনো নিয়মতান্ত্রিক দল বা গোষ্ঠী নয়। কাজেই নাফ নদীতে ভেসে আসা শিশুদের লাশ দেখে আমরা কাঁদি, বিপন্ন রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াই আমরা মানবিকবোধসম্পন্ন মানুষ বলে। কিন্তু বিপাকে পড়া লাখো রোহিঙ্গা শরণার্থীর পাশে থাকার সক্ষমতা যাদের নেই, সেই আরাকানের অন্ধকার আরসা বা আতা উল্লাহদের কাঁদবারও কোনো যোগ্যতা নেই!

ফারদিন ফেরদৌস
সুখেরছায়া
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭