বিশ্ব ইজতেমা ও একটি খোলা চিঠি!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 11 Jan 2018, 02:53 AM
Updated : 11 Jan 2018, 02:53 AM

বরাবরই বিশ্ব ইজতেমার আগে পেশাগত দায়িত্বপালনের অংশ হিসেবে টঙ্গির ময়দান পরিদর্শনে যাই। বয়স্ক-মুরুব্বীরা যখন নিজেদের বিশ্বাস থেকে স্রেফ পুণ্য লাভের আশায় বড় বড় বাঁশ টেনে একস্থান থেকে আরেক স্থানে নিয়ে যান, ছোট ছোট কোমলমতি শিশুরা যখন বিশাল আকারের শামিয়ানা বহন করে, সরকারের সেবা সংস্থাগুলো নিবিষ্ট মনে তাদের দায়িত্বপালন করে যান, বিষয়গুলো দেখতে আমার দারুণ লাগে। ভাবনার দ্বারে কড়াঘাত পাই, প্রভুর সান্নিধ্য লাভের জন্য এত শ্রম, আহা! মহান ঈশ্বর যেহেতু এত সুন্দর জীবন দিয়েছেন, সুশোভন পৃথিবী দিয়েছেন তাঁর জন্য এইটুকু শ্রম মামুলিই। কিন্তু যখন ভাবনার আরেকটু গভীরে যাই, ১৯২৭ সালের আগে তো বিশ্ব ইজতেমা বলে কিছু ছিল না, তখন মানুষ কি তবে মহান আল্লাহর ইবাদত করতেন না?

১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা ইলিয়াস ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহরানপুর এলাকায় ইসলামী দাওয়াত তথা তাবলিগের প্রবর্তন করেন এবং একই সঙ্গে এলাকাভিত্তিক সম্মিলন বা ইজতেমারও আয়োজন করেন। ১৯৪৬ সালে বাংলাদেশের কাকরাইল মসজিদে তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সম্মেলন তথা বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের হাজী ক্যাম্পে, ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে এবং ১৯৬৬ সালে টঙ্গির পাগারে এই সমাবেশ বসে। ১৯৬৭ সাল থেকে টঙ্গিতে রাজউকের হুকুম দখলকৃত ১৬০ একর ভূমিতে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মুসুল্লি আধিক্য বেশি থাকায় ২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে এবং ২০১৭ সাল থেকে প্রতিবছর ৩২ জেলার মুসুল্লিদের নিয়ে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সাধারণত তাবলিগ জামাতের অংশগ্রহণকারীরা সর্বনিম্ন তিন দিন আল্লাহর পথে কাটানোর নিয়ত বা মনোবাঞ্ছা পোষণ করেন। সে হিসাবেই প্রতিবছরই বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় তিনদিনব্যাপী।

২০১১ সাল থেকে ইজতেমা ময়দানে সংবাদকর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে ইজতেমা মাঠে দায়িত্বপালন একটা বড় প্যারা। প্রথম কথা ইজতেমা মাঠে ছবি তুলতে গেলেই বাঁশের লাঠি হাতে মাঠে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মুসল্লিদের থেকে সাবধান থাকতে হবে। ওরা ক্যামেরার লেন্সে হাত রেখে ছবি তুলতে বাঁধা দেবেনই দেবেন। ওদের ভাষায় ছবি তোলা গুণাহের কাজ এবং বাঁধা দেয়াটা বড় সওয়াবের কাজ। ইজতেমা শুরুর আগে মাঠে প্রবেশ করে গোঁড়া মুসল্লিদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে ছবি তোলা গেলেও ইজতেমা শুরুর পর সাংবাদিকের আর ভিতরে প্রবেশ করার অধিকার নেই। এবারের ইজতেমা শুরুর এক সপ্তাহ আগে মাঠের ভিতর প্রবেশ করেছিলাম। পাঁচ ছ'জন মুসল্লি একটি বাঁশে শামিয়ানা কুন্ডুলি পাকিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন। সবুজ ঘাসের গালিচায় খিত্তাওয়ারি বাঁশের খুঁটির মাঝখান দিয়ে যখন উনারা হেঁটে যাচ্ছিলেন, এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্য সৃষ্টি হচ্ছিল। আমি ভিডিও ক্যামেরা তাক করলাম। অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা আমার ক্যামেরায় লুক দিচ্ছিলেন। বড় মুরুব্বী মন্তব্য জুড়ে দিলেনঃ
-আজাইরা কাম!

আমি ক্যামেরা বন্ধ করে মনে মনে ভাবলাম। আসলেই তো উনারা সকলে উনাদের ভাষায় আল্লাহর ঘরে এসে বাঁশখুঁটি টানছেন আর আমি কিনা ছবি তুলছি? কে বলেছিল আমাকে ছবি তোলার পেশা গ্রহণ করতে? আচ্ছা এই যে, উনাদের দেখিয়ে দেখিয়ে আমি টিভির সংবাদে বললাম, বিশ্ব মুসলিমরা এই মাঠে আসবেন আর সওয়াবের আশায় স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে নানা বয়সী মুসুল্লীরা মাঠ প্রস্তুত করছেন। এতে আমার পূণ্য হলো, নাকি পাপ? যদি পাপ হয়ে থাকে তাহলে মানছি, কাজটি যারপরনাই আজাইরা।

ইজতেমা মাঠে লোহার পিলার, পাটাতন ও ব্রিজসহযোগে বয়ান মঞ্চ বানানো হয়। সেখানে দাঁড়িয়ে এক মুরুব্বীর বয়ান নিচ্ছিলাম ইজতেমার উদ্দেশ্য বিধেয় কি? উনার বক্তব্য শেষ না হতেই এক জোয়ান মৌলভী এসে হুঙ্কার দিলেনঃ
-এইগুলা কোনো কাজ নারে ভাই। চিল্লায় মন লাগান। আল্লাহর পথে সময় দেন। এইদিকে আসেন আমাদের আমির আপনাদেরকে চিল্লা বিষয়ে বয়ান দেবেন!
-আগে কথা দেন, আপনার আমিরকে আমি সাংবাদিকতা বিষয়ে বয়ান দেব, তিনি আগে আমারটা শুনবেন, তারপর আপনাদের কথা শুনব। আমি বললাম।
-এইটা কোনো কথা হইল ভাই? এইসব দুনিয়াবি কাম ছাইড়া দিয়া লাইনে আসেন ভাই। তিনি গেলেন আর আমি লাঠিয়ালবাহিনীর ভয়ে সেখান থেকে সটকে পড়ে অন্য কলীগদের সাথে মিশে গিয়ে দল ভারি করলাম।

গত বছর ইজতেমার শেষ পর্বে বিদেশি খিত্তার মূল ফটক লক্ষ্য করে যেইনা ক্যামেরার সুইচ অন করেছি, অমনি আমার উপর হুমরি খেয়ে পড়লেন তিন মুসুল্লি। আমাকে ইজতেমা থেকে বাইরে কামারপাড়ার দিকে রাস্তা দেখিয়ে বললেনঃ
-সোজা ঐদিকে চলে যাবেন। এই রাস্তায় আসার কথা কল্পনাও করবেন না!
আমি বললাম, রাস্তাটা আমার আমি এখানেই থাকব। একচুলও নড়ব না।
-যান বলছি, এই ভূমি আমার। এখানে আমি যা বলব তাই হবে!
আমি সাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ এক ইন্সপেক্টর লেভেলের পুলিশ ভাই যিনি অন্য জেলা থেকে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে এসেছেন, এগিয়ে এসে আমাকে ডিফেন্স করলেন। কিন্তু তিনিও মুসুল্লির স্বরে কথা বললেনঃ
-ভাই কিছুদূর উল্টোদিকে গিয়ে আবার ফিরে আসেন!
যে ভূমি আমার না, সেখানে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। অগত্যা আমি পুলিশ ভাইয়ের নির্দেশনা অনুসরণ করলাম।


সব সাংবাদিক আমার মতো ভীতু নয়। অনেকেই ইজতেমা চলাকালীন সময়ে দিব্যি ভিতরে চলে যান। তাদের কেউ কেউ বেশ কয়েকবার শারীরিক লাঞ্ছনা ও ক্যামেরা ভাঙচুরের মুখে পড়েছেন। এসব বিব্রতকর ঘটনার কোনো প্রতিকার নেই। বরং জান নিয়ে ময়দানের বাইরে আসতে পারাটাই খোদার কাছে হাজার শোকর।

গেল বছর আমাদের এক সাহসী কলিগ তার হ্যান্ডিক্যাম জামার আস্তিনে লুকিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলেন। কিছুদূর যাওয়ার পরই লাঠিয়াল বাহিনীর তল্লাশীর মুখে পড়ে ধরা খেয়ে গেলেন। তাকে নিয়ে রীতিমতো খিত্তার ভিতর টানাটানি পড়ে গেল। একদল ভিতর দিকে নিয়ে গিয়ে এই সাংবাদিককে তাবলিগ শেখাবেন বলে ঘোষণা দিলেন। কেউ কেউ ক্যামেরা ছিনিয়ে নিতে চাইলেন। হঠাৎ কোনো এক উদারনৈতিক মুসল্লি ভাই এসে ওই সাংবাদিককে উদ্ধার করে তার ডেরায় নিয়ে গিয়ে এক গ্লাস জল খেতে দিয়ে বললেনঃ
-দাদা ভয় পাইয়েন না। আপনাকে আমি চিনি। সবাই তো আর সমান না। ভাগ্য ভালো যে, ওরা জানতে পারেনি যে, আপনি আমাদের গোত্রভুক্ত না।

গতবার যেহেতু উগ্র মুসল্লিদের ডরে আমার ওই কলীগের হৃদযন্ত্রের বারোটা বেজে গিয়েছিল প্রায়, সেহেতু এবার আর তিনি ভিতরে প্রবেশ করবার সাহস হয়ত আর দেখাবেন না। রাস্তাঘাট, ওয়াচ টাওয়ার ইত্যাদি দেখিয়েই সংবাদ তৈরি করবেন।

পৃথিবীতে কিম জং উনের দেশ উত্তর কোরিয়া ছাড়া আর কোনো ভূমি আছে যেখানে সাংবাদিকরা দায়িত্বপালন করতে পারে না? বিশ্ব ইজতেমা ময়দান কি এমন নিষিদ্ধনগরী যে, সেখানকার তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে তাদের অনীহা? সাংবাদিক কি জানতে চাইবে, তাদের অর্থের উৎস? তাদের অর্থ ব্যয় বলতে তো ওই বাঁশখুঁটি শামিয়ানা আর বিদেশী মেহমানদের এন্টারটেইনমেন্ট। বাকি সব বন্দোবস্ততো রাষ্ট্রই করে দিচ্ছে। রাষ্ট্রের টাকা আমার আপনার সবার।

নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ও অন্যান্য সকল সেবা নিশ্চিতের মাধ্যমে বিশ্ব ইজতেমা সফল করতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন নিরাপত্তা এজেন্সি ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান সার্বিক দায়িত্বপালন করে থাকে। কিন্তু ইজতেমার মুরুব্বীরা সেসব স্বীকার না করে বড় উপেক্ষার স্বরে বলে যানঃ
-আমাদের জন্যই আল্লাহই যথেষ্ট। কারও সহায়তা আমাদের লাগে না।

বরাবরের মতো এবারের ইজতেমায়ও ১৫টি ওয়াচ টাওয়ার, ৪১টি সিসি ক্যামেরা, নৌ-টহল, হেলিকপ্টার টহল, আর্চওয়ে, মেটাল ডিটেকটর দিয়ে তল্লাশী, বোম ডিজপোজাল টিম ও ভিডিও ধারণ করা হবে। জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে প্রতিটি খিত্তায় ৬ জন করে সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্য নিয়োজিত থাকবে। নিরাপত্তা জন্য পুলিশের পাশাপাশি, র‍্যাব ও অন্যান্যবাহিনীর সদস্যসহ অন্তত ১০ হাজার নিরাপত্তাকর্মী কাজ করবে। মুসল্লিদের সহজ এপার ওপারের জন্য তুরাগ নদে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন ৭টি পল্টুন ব্রিজ নির্মাণ করে দিয়েছে। বিশ্ব ইজতেমার সার্বিক কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য গাজীপুর সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, র‌্যাব, আনসার ও ভিডিপি পৃথক ৫টি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করেছে।

গেল কয়েক বছরে কয়েক শ'কোটি টাকা খরচ করে ইজতেমা ময়দানের চারপাশে পাকা শৌচাগার স্থাপন, ভিতরে পাকা সড়ক নির্মাণ ও নিচুভূমি মাটি ফেলে ভরাট করে দিয়েছে রাষ্ট্র। ইজতেমা চলাকালীন ২১টি গার্বেজ ট্রাকের মাধ্যমে দিন-রাত বর্জ্য অপসারণ করা হবে। গাজীপুর সিটি করপোরেশন ইজতেমা মাঠের চারপাশের রাস্তার ধূলাবালি নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত পানি ছিটানোর ব্যবস্থা নিয়েছে। অসাধু, চোর বা প্রতারকদের বিরুদ্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। ইজতেমা মাঠে আগত বিদেশী মেহমানদের রান্নার জন্য ১৩৬টি গ্যাসের চুলা স্থাপন করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় টেলিফোন সংযোগও দেয়া হয়েছে। এছাড়া মুসল্লিদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদানের লক্ষ্যে সরকারি হাসপাতালে অতিরিক্ত বেড সংযোজনসহ ইজতেমা মাঠ সংলগ্ন এলাকায় ৪৫টি চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।

বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের ওযু, পয়:নিষ্কাষণ ও সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য লক্ষ্য ইজতেমা মাঠে স্থাপিত ১৩টি গভীর নলকূপ দ্বারা ১৮ দশমিক ৫০ কিলোমিটার পাইপ লাইনের মাধ্যেমে প্রতিদিন ৩ কোটি ৫৪ লক্ষ গ্যালন সুপেয় পানি সরববরাহ নিশ্চিত করা হবে। বাংলাদেশের বর্তমান বাজার মূল্য অনুযায়ী প্রতি লিটার পানি যদি ১০ টাকা করেও ধরি, তবে এই ইজতেমা ময়দানে প্রতিদিন ১৩৪কোটি টাকার পানি সরবরাহ করা হবে।

কিন্তু ইজতেমা ময়দানে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের ট্যাক্সের টাকায় সঞ্চিত রাষ্ট্রীয় কোষগার থেকে যে, হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয় তার প্রাপ্তিটা কি? ভাবমূর্তি ছাড়া তো আর কিছু নয়। কারণ ইজতেমা তো ইসলামের অবশ্য পালনীয় পঞ্চস্তম্ভের মতো কোনো বিষয় নয়। ইজতেমার মুরুব্বীদের অধিকাংশই সমাজের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। অবসরপ্রাপ্ত সচিব বা প্রকৌশলীরা তাবলিগের বাংলাদেশ পার্টের নেতৃত্ব দেন। যারা চাইলে, মুসল্লিদের নিজেদের টাকাতেই ইজতেমা আয়োজনের হাজার কোটি টাকা ব্যয়ভার নির্বাহ করা সম্ভব এবং তাই করা উচিৎ। কারণ বিশ্বের ১৩০ কোটি মুসলমানের অধিকাংশই ইজতেমা বা তাবলীগ কনসেপ্টের সাথে একাত্ম নন। বাংলাদেশেও তাই। তাহলে অন্যধর্মের মানুষের কথা বাদই দিলাম যারা তাবলিগ করবেন না বা করতে চান না, সেইসব মুসলমানের করের টাকায় ইজতেমা আয়োজনের নৈতিক ভিত্তি আছে কি?


হজ্বের মতো অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় আচার থেকে সৌদিআরব প্রতিবছর সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে, সেখানে আমরা বাঙালিরা যেটা ধর্মের অনুষঙ্গ নয় সেটা বাস্তবায়ন করতে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করি! বাংলাদেশে ভোট, ধর্ম, অনুভূতি এই তিনটি বিষয় এত ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে, ধর্মের নাম নিলেই সেখানে সবার ঝাঁপিয়ে পড়া চাই। অথচ যে তাবলিগের জন্ম মাত্র ৯০ বছর আগে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। বরাবর দিল্লীর নিজামুদ্দিন মারকাযের আমিরই তাবলিগ জামাতের প্রধান মুরুব্বী থাকেন। কিন্তু গেল এক বছর ধরে সেই আমির মাওলানা ইলিয়াসের বংশধর মাওলানা সা'দ-এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে মারাত্মক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।

মাওলানা সা'দ মক্কা মদিনার পরেই তার মারকাযকে স্থান দেয়ার দাবি করেছেন। তাবলিগ না করলে তওবা কবুল হবে না, এমনকি বেহেশত পাওয়া যাবে না বলেও চরম অনৈসলামিক কথা বলেছেন তার বয়ানে। ফলে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার ইসলামিক স্কলাররা মাওলানা সা'দের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিতে বাধ্য হয়েছেন। ওই ফতোয়ার আলোকে ইজতেমা নিয়ে দলাদলিতে লিপ্ত হয়েছে বাংলাদেশের বিশ্ব ইজতেমা এন্তেজামিয়া কমিটিও। এক দল ইজতেমায় ভারতের মাওলানা সা'দকে চেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠায়, আর আরেক দল মাওলানা সা'দকে ঠেকাতে এয়ারপোর্ট রোড অচল করে দেয়।

তাহলে ইজতেমা আমাদেরকে কি দিচ্ছে? মানুষ ঈমানের পথে আসছে? ইজতেমাকে ঘিরে সাধারণ মুসল্লিদের মধ্যে বিশ্বাসগত বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে দিনদিন। আখেরি মোনাজাতের দিন যারা হুজুগে পড়ে মোনাজাতের মাধ্যমে পাপ খণ্ডানো ও সৌভাগ্যের প্রত্যাশা করেন তারা ইজতেমাকে দ্বিতীয় হজ্বের সাথে তুলনা করেন। অনেক মুসল্লিই বলেন, এই ময়দানে এক রাকাত নামাজ মানে মক্কা মদিনার চেয়ে বেশি সওয়াবের কাজ। অথচ হাদিস মতে, মসজিদুল আল আকসা, হারাম ও নববী এই তিন পবিত্র মসজিদ ব্যতীত অন্য কোথাও নামাজে বিশেষ কোনো সওয়াব নেই।

ইসলাম ধর্মাচারের সাথে আখেরি মোনাজাত বলে আলাদা কোনো ইবাদতের স্থান নেই। অথচ এই আখেরি মোনাজাতে সারা দেশ থেকে মানুষের ঢল নামে টঙ্গির বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে। এই বিপুল সংখ্যক মুসল্লীকে সামলাতে গাজীপুর থেকে উত্তরা, সাভারের বাইপাইল থেকে আব্দুল্লাহপুর এবং মিরেরবাজার থেকে টঙ্গি মহাসড়ক প্রায় একদিনের জন্য বন্ধ করে দিতে হয়। এবং পুরো ইজতেমা চলাকালীন সময়েই ঢাকার প্রবেশ দ্বারের সাথে উত্তরবঙ্গ ও সিলেটবাসীর যোগাযোগে মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টি হতে থাকে। পৃথিবীর আর কোথাও এমন নেই যে ধর্মীয় কিংবা অন্য সভা সমাবেশের জন্য ছয়দিন মহাসড়ক বন্ধ থাকে। আখেরি মোনাজাতের দিন যেভাবে ৫০০ যাত্রী ধারণ ক্ষমতার ট্রেনে ৫০ হাজার লোক ওঠে, একবার যদি ওই ট্রেনটি কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে কত হাজার পরিবারে আজীবনের জন্য কান্না নেমে আসবে কেউ ভেবেছেন?

আখেরি মোনাজাতের দিন টঙ্গি এলাকা একটা মূত্রের নগরীতে রূপান্তর হয়। একসাথে লাখো মানুষের বর্জ্য বিসর্জনের ব্যবস্থা করা কোনো প্রশাসনের পক্ষেই সম্ভব নয়। অনেকেই আছেন ফজর নামাজটি পড়েন না, কিন্তু মোনাজাতের আশায় বসে থাকেন। তাহলে সেসব মুসল্লিদের কারা বুঝাবে যে, মোনাজাত কোনো ইবাদত নয়, এটায় অংশগ্রহণ করা না করায় ধর্মাচারের কোনো হেরফের হয় না। বহু ব্যয় করে দেশ-বিদেশ ঘুরে মসজিদে জীবন কাটানোই ধর্ম নয়, সংসার ধর্ম সামলানো, প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্বপালন সর্বোপরি দেশকে সেবা দেয়াটাও বড় ধর্ম!

ইজতেমা চলাকালীন ছয়দিন উত্তরা আবাসিক এলাকা এবং টঙ্গির আশেপাশে রাস্তায় রাস্তায় মাইক বসানো হয়। মাইকের শব্দে সারারাত অসুস্থ্য, বৃদ্ধ, শিশুরা ঘুমাতে পারে না। হাসপাতাল, স্কুলে কাজের ব্যাঘাত ঘটবে। শিল্পনগরী টঙ্গির শ্রমিক ভাইবোনেরা তাদের কাজকর্ম ঠিকঠাক করতে পারবে না। উপরন্তু আখেরি মোনাজাতের দিন এসব এলাকার সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। রাস্তাঘাট অচল হয়ে যাবে। মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছাবে। এতে কি আসলেই পরম প্রতিপালক খুশি হবেন? আমাদের সত্যি জানা নেই।

দিন দিন বিশ্ব ইজতেমায় অধিকসংখ্যক মানুষের সমাগম হচ্ছে। আর এ কারণে ইজতেমা চলাকালীন রাজধানীর প্রবেশমুখে মানুষের ভোগান্তিও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। কাজেই ইজতেমার স্থান নিয়ে এখনই ভাবনার সময় এসেছে। রাজধানীর বাইরে অন্য কোনো নিরিবিলি এলাকায় এই মহাসমাবেশ স্থানান্তরের কথা ভেবে দেখতে পারে এর সাথে সংশ্লিষ্ট মুরুব্বী ও সদাশয় সরকার। সেক্ষেত্রে ইজতেমার বর্তমান ভূমিটি ইসলামী শিক্ষার জন্য মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় বা আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে বিশেষায়িত শিক্ষায়তন অথবা সাধারণের চিকিৎসা সেবার জন্য আধুনিক হাসপাতাল গড়ে তোলা যেতে পারে।

ইজতেমার এক পর্বেও যেমন মুসুল্লির সমাগম হয় দুই পর্বেও তাই হয়। এমনকি এটা তিন-চার পর্ব করলেও মুসুল্লির সংখ্যা একই থাকবে। সবাই প্রত্যেকটি আখেরি মোনাজাত কিংবা জুম্মার নামাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অধিক সওয়াবের আশা করেন। কাজেই মানুষের দুর্ভোগ ও সেবা সংস্থাগুলোর দায়িত্বপালন বিবেচনায় ইজতেমাকে এক পর্বে ফিরিয়ে আনার কথা ভাবা যেতে পারে।

বিশ্ব ইজতেমাকে একটি অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর ভিতরে আনা যেতে পারে। এখানে অংশগ্রহণকারী দেশি-বিদেশি মুসুল্লীদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থেই নিরাপত্তা ও ইউটিলিটিসেবাসহ যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করা যেতে পারে।

বিশ্ব ইজতেমা যে ইসলামের অবশ্য পালনীয় অনুষঙ্গ নয়, এটা সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে টঙ্গি এলাকায় অধিক জনসমাগমে নিরুৎসাহিত করা যেতে পারে।

দেশে যেহেতু তথ্য অধিকার বলে আইন আছে, সেহেতু ইজতেমা ময়দান থেকে গণমাধ্যমকর্মীদের অবাধ তথ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধান করার ব্যাপারে সরকার ভূমিকা রাখতে পারে।

সকলের না হোক অনেক মুসলমানেরই ইসলামী সংস্কৃতির অংশ এখন বিশ্ব ইজতেমা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সেবাসংস্থার কর্মীরা ইজতেমাকে সফল করতে তাদের সর্বোচ্চ শ্রম দেন। ব্যয় করা হয় বিপুল রাষ্ট্রীয় অর্থ, সেহেতু শুধুমাত্র ইজতেমা ইন্তেজামিয়া কমিটির উপর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব না দিয়ে গঠনমূলক সিদ্ধান্তে সরকারি কর্মকর্তাদেরও অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করা যেতে পারে।

উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে পুরো বিষয়টির প্রতি গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর, গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য মোঃ জাহিদ আহসান রাসেল ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মহোদয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

মানুষের যথার্থ ধর্মাধিকার ও সর্বোপরি মানবাধিকার সুনিশ্চিত হোক।

ইতিঃ-
ফারদিন ফেরদৌস
লেখক ও সাংবাদিক
১০ জানুয়ারি ২০১৮।