মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যে হোক বিজয়ের উজ্জীবন

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 3 Sept 2018, 10:05 AM
Updated : 3 Sept 2018, 10:05 AM

বাবা ওদের চোখ বেঁধে রেখেছে কেন? ভাস্কর্যের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়  আমার শিশু সন্তান প্রায়ই এ প্রশ্ন করে। আমি ওকে একাত্তর নিয়ে বলি।

ওর পরের প্রশ্ন,  "বাবা, পাকিস্তানিরা কি আমাদেরকে এখনো নির্যাতন করছে?"

আমি উত্তর দিই, না।

ও সঙ্গে সঙ্গে ভাস্কর্যটি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলে, "বাবা, তুমি ভুল বলছো। ওই যে দেখো চোখ বেঁধে মারছে।"

আমি ভাস্কর্যটির দিকে তাকিয়ে নিরুত্তর থাকি।

গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটির মেইন গেট সংলগ্ন ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে একটি সিএনজি পাম্পের সামনে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে  'নির্যাতন ৭১' নামে একটা কংক্রিটের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়।

ভাস্কর আশরাফের নকশায় প্রায় ২০ লাখ টাকা ব‍্যয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।

একটা গোলাকার বেদি। বেদির তিনপাশে গাল ও কপালের একপাশে জখমসহ চোখ বাঁধা তিনটি মুখাবয়ব। বেদির ওপরে চোখ বাঁধা অবস্থায় তিনজন মুক্তিযোদ্ধা। এদের একজন নারী।

ভাস্কর খুব সাদাসিধে মোটিফে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের উপর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরতে চেয়েছেন।

কিন্তু শুধু এই চোখবাঁধা ভাস্কর্য দিয়ে যুদ্ধকালীন অবর্ণনীয়, ভয়াবহ আর নির্মম নির্যাতনকে অনুভব করা যাবে কি? ৩০ লাখ মুক্তিযোদ্ধার প্রাণ ও চার লাখ মা-বোনকে নির্যাতনের কোনো প্রতীকি চিত্র কি আদৌ গড়ে তোলা সম্ভব?

একাত্তরে নির্যাতনের ভয়াল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে গৌরবের বিজয় অর্জন করেছে এ জাতি। অমানুষের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে বিনির্মাণ করেছে ইতিহাস। এখন আর কারো পদাবনত নই আমরা। কেউ আমাদেরকে চোখ বেঁধে রাখেনি। দৃষ্টিসীমায় অসীম আকাশ দেখি। শুভ স্বপ্নগুলোর সবটাই আমাদের।

আর তাই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে একজন অভিভাবক হিসেবে বিজয়ের সাহসী অর্জনই তো দেখাতে চাইবো আমি।

কিন্তু  অবদমনের প্রতীক বন্দনায় কী করে বিজয়ের গান গাওয়া যায়?

পৃথিবী শ্রেষ্ঠ মনোসমীক্ষক সিগমুন্ড ফ্রয়েড বলেছিলেন, মানুষের যে ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি, যার জন‍্য সে অতৃপ্ত, সেই অবদমিত অতৃপ্তি ও ইচ্ছাগুলোই অচেতন স্তর থেকে স্বপ্ন হয়ে বেরিয়ে আসে। মনের চেতন ও অচেতন স্তরের সমন্বয়ে তৈরি হয় একজন ব্যক্তি মানুষের অহং।

তাহলে আমাদের অহং কেন অতৃপ্তি বা অবদমন নামের সংকোচে ঘোরপাক খাবে? আমাদের মন কেন বীরত্বের অগ্নিশিখায় প্রজ্বলিত হবে না?

সঞ্চয়িতায় লিপিবদ্ধ 'কণিকা' কাব‍্যের 'ধ্রুবাণি তস্য নশ্যন্তি' শীর্ষক পঙ্ক্তিমালায় রবিকবি যথার্থ বলেছেন, "রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা/সূর্য নাহি ফেরে, শুধু ব্যর্থ হয় তারা।"

বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটির সামনে জাতির পিতার প্রমাণ সাইজের আবক্ষ ভাস্কর্য থাকতে পারে। হতে পারে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কোনো ভাস্কর্য। অথবা বঙ্গবন্ধু স‍্যাটেলাইটের রেপ্লিকাবেইজড কোনো স্মারকচিহ্নও থাকতে পারে।


গাজীপুর সার্কিট হাউজ প্রাঙ্গণে স্থাপিত ভাস্কর্য অনুপ্রেরণা '১৯

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর কালিয়াকৈরের নির্যাতন '৭১-এর তিনভাগের একভাগ খরচে নিজের পরিকল্পনা ও ভাবনায় গাজীপুরের সার্কিট হাউজ প্রাঙ্গণে সম্প্রতি 'অনুপ্রেরণা '১৯' নামের ভাস্কর্য নির্মাণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন স্বাধীনতার স্মারক ভাস্কর্য আসলে দেখতে কেমন হওয়া উচিৎ।

শিশু-বৃদ্ধ-বণিতার হাতে সামর্থানুযায়ী যুদ্ধাস্ত্র আর প্রেরণাদায়ী নারীর হাতে বিজয় পতাকা – এখানে স্বাধীনতা, স্বতঃস্ফূর্ততা ও উজ্জীবন যেন সমার্থক ও সার্থক।

মুক্তিযুদ্ধের সূর্যসমান প্রগাঢ় শোকনাম জপতে গিয়ে আমাদের স্বাধীনতার আনন্দকে যেন ব‍্যর্থ না করে তুলি আমরা। কাজেই আমাদের প্রেম ও দ্রোহকে জাগিয়ে রাখতে প্রেরণা উদ্দীপক স্মারকচিহ্ন চাই। মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিপ্লব ও বিদ্রোহের জয়োল্লাস দেখতে চাই ভাস্কর্যে।