একজন মাশরাফি আর বদলে যাওয়া নড়াইলের সদর হাসপাতাল

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 12 May 2019, 03:34 PM
Updated : 12 May 2019, 03:34 PM

জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ও নড়াইলের সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মর্তুজাকে নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল আলোচনা চলছে। উপলক্ষ এমপি সাহেবের নড়াইল সদর হাসপাতাল পরিদর্শন। হাসপাতালে গিয়ে কর্তব্যরত ডাক্তার না দেখতে পেয়ে তিনি এক সার্জনকে ফোন দিয়ে 'ফাইজলামি করেন' বলেছেন। আর তারপরই কিছু মানুষ এবং ডাক্তারও মাশরাফির শিক্ষা-আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। এমনকি ব্যক্তি মাশরাফিকে গালাগাল করতেও ছাড়ছেন না কেউ কেউ।

ডাক্তারের কর্তব্য ফাঁকি নিয়ে চিকিৎসক কমিউনিটির প্রায় কেউই প্রশ্ন তুলছেন না। বরং তাদের কাছে বড় হয়ে গেছে মাশরাফির বাচনভঙ্গি।

অথচ নড়াইল সদর হাসপাতালে মাশরাফির ঝটিকা অভিযানের পর পুরো নড়াইল জুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে চলছে সেবা পাওয়ার আনন্দ। বদলে গেছে হাসপাতালের চালচিত্র। বিভিন্ন গণমাধ্যম জানাচ্ছে, ওই হাসপাতালে দালালদের দেখা যাচ্ছে না। হাসপাতাল চত্বরে আর্বজনার স্তুপ নেই তেমন একটা। ড্রেনগুলোও পরিস্কার। বাইরে ব্যক্তিগত অ্যাম্বুলেন্সের ছুটোছুটি নেই। নিয়মিত উপস্থিত থেকে রোগী দেখছেন চিকিৎসকরা। সাধ্যমতো আন্তরিক সেবা দিচ্ছেন সেবিকারাও।

চিকিৎসক ও নার্সদের সেবা পাওয়ার কথা জানা গেছে রোগীদের কাছ থেকেও। গত কয়েকদিনে অন্য এক হাসপাতালে পরিণত হয়েছে নড়াইল সদর হাসপাতাল।

তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, ঐ হাসপাতালে ব্যবস্থাপনায় মারাত্মক গলদ ছিল। এমপি মাশরাফির আন্তরিকতায় পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। এবং এটাও প্রমাণ হলো সদিচ্ছা থাকলে স্বল্প আয়োজন এবং সমূহ সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও খুব ভালো সেবাদানের ব্যবস্থা করতে পারে হাসপাতাল প্রশাসন। তারপরও মাশরাফিকে নিয়ে যেভাবে সোশাল মিডিয়ায় ট্রল হচ্ছে বিশেষত ডাক্তারদের তরফ থেকে তা বড় লজ্জাজনক ও হতাশাজনক।

মাশরাফি নড়াইলের সরকারি হাসপাতালে যা দেখেছেন, তা বাংলাদেশের প্রায় সব সরকারি হাসপাতালের চিত্র। হাসপাতালে অধিকাংশ সময়ই চিকিৎসক থাকেন না। তারা ব্যস্ত থাকেন প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিয়ে। এর নিশ্চয় একটা সুরাহা হওয়া প্রয়োজন।

অথচ উল্টো ডাক্তাররা বলছেন, পারলে মাশরাফি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে দেখাক। যদিও এই দেশে অশিক্ষিত মানুষও বছরের পর বছর ক্লিনিকগুলোর অসাধু মালিকের ছত্রছায়ায় স্পেশালিস্টের দায়িত্ব পালন করে যেতে পারেন।

মাশরাফি যেহেতু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষার্থী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন, চাইলে তিনি ভালো মানের ডাক্তারও নিশ্চয় হতে পারতেন। কিন্তু দেশের সমালোচক শ্রেণির প্রতিক্রিয়াশীল সব ডাক্তাররা একজোট হলেও কি ম্যাশের মতো মেধাবি ও দায়িত্বশীল ক্রিকেটার হতে পারবেন? সংবেদনশীল মানুষ হতে পারবেন?

সরকারি ডাক্তাররা একযোগে বিনা ছুটিতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার মত দায়িত্বহীন  কী করে হতে পারেন? জনগণের টাকায় বেতনভুক্ত সেই ডাক্তাররা নিজের হাসপাতালে রোগীর সেবা না দিয়ে উপরি কামাইয়ের জন্য প্রাইভেট প্র্যাকটিসে দিন পার করার জন্য লজ্জিত হন না। বরং একজন সাংসদ এর প্রতিবাদ করলে এই সব শিক্ষিত ক্যাডার ডাক্তাররা আর আব্দুন নূর তুষারের মত নন-প্র্যাকটিসিং ডাক্তার ম্যাশকে অরুচিকর ও অযৌক্তিক  কথা  বলতে পারেন।

দেশে অনেক মেধাবী, সংবেদনশীল ও মানবিক ডাক্তার আছেন যাদের খুব ভালো করে চিনি, তাদের কাছ থেকে দারুণ সেবাও গ্রহণ করি । তাদের অনেকের গবেষণায় শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্ব চিকিৎসাব্যবস্থাও ঋদ্ধ হয়। তারা সবকিছুতেই লোভী ও অযোগ্য ডাক্তারদের মতো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখান না। তারা আমাদের নমস্য। তাদের প্রতি প্রাণান্ত শ্রদ্ধা সবসময়ের জন্য তোলা থাকল।

পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী,  ৩৬টি সরকারি এবং ৬৪টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে ফি বছর ৫ থেকে ৬ হাজার ডাক্তার পাস করে বের হলেও হাতেগোনা একশ-দুইশ ডাক্তার সরকারি চাকরি পান। এছাড়া খুব কম বেতনে বেসরকারি হাসপাতালে কিছু কর্মসংস্থান হয়। কার্যত বেকার চিকিৎসকদের কেউ কেউ বিনা বেতনে প্রাইভেট হাসপাতালে কাজের জন্য ধর্না দেন। হতাশা থেকে বহু তরুণ চিকিৎসক রোগীকে উপযুক্ত সেবার পরিবর্তে বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জন করে ক্লিনিক বাঁচান, নিজে বাঁচেন।

আর যারা সরকারি চাকরির মতো সোনার হরিণ পেয়ে যান। সরকারি পয়সায় দেশ-বিদেশের বড় ডিগ্রি নেন তাদের চাওয়া ব্যাপ্তি আরো বিশাল। তারা নিকটস্থ দামি বেসরকারি হাসপাতাল বা বিভিন্ন ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে গিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। অথবা অল্প কয়েক দিনে নিজেরাই প্রাইভেট হাসপাতালের মালিক বনে যান। একজন মানবিক বোধ ও বিবেক সম্পন্ন মানুষের আর্থিক চাওয়া কি এত বেশি হতে পারে যে টাকার যোগান নিশ্চিত করতে সরকারি হাসপাতালে আসা গরীব রোগীদের ঠকাতে হয়?

দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা হিসেবে সাড়ে ছয় হাজার রোগীর জন্য একজন ডাক্তার। আর সামগ্রিকভাবে প্রায় দেড় হাজার রোগীর জন্য একজন ডাক্তার। ডাক্তার কর্তৃক রোগী দেখার সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত, পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। মিনিটও না, রোগীরা গড়ে মাত্র ৪৮ সেকেন্ড সময় পান। এটা আমরা মেনেই নিয়েছি। আমরা জানি, রোগী প্রতি উপযুক্ত ডাক্তার ও নার্সের সংখ্যা যতদিন পর্যন্ত না বাড়ছে ততদিন আমাদের মতো রোগীদের আক্ষেপ কেউ ঘোচাতে পারবে না।

ক্ষণিক উত্তেজনাবশত অনভিপ্রেত শব্দচয়ন দিয়ে মাশরাফির মতো একজন ব্যক্তিত্ববান মানুষের সামগ্রিক জীবনদর্শন অবশ্যই বিবেচনাযোগ্য হতে পারে না। মাশরাফি তার অসতর্ক শব্দচয়নের জন্য ওই ডাক্তারকে ব্যক্তিগতভাবে ফোন দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন ইতোমধ্যে।

ডাক্তারদের কর্তব্য ফাঁকি অতি অবশ্যই জায়েজ নয়। বরং জনপ্রতিনিধি হিসেবে জবাবদিহিতা চাওয়াই মাশরাফির গণঅধিকার।