আমাদের ‘বাণী’ সংস্কৃতি: একটি অর্থহীন দাস মনোবৃত্তি

ফরিদুল আলম সুমন
Published : 21 Dec 2011, 05:13 AM
Updated : 21 Dec 2011, 05:13 AM

আমাদের দেশে ছাপা হওয়া পত্রিকা, সাময়িকী, স্মরণিকা, ম্যাগাজিনে প্রায়ই আমরা 'বাণী' নামে একটি জিনিস দেখতে পাই। প্রকাশনার শুরুতেই কয়েক পৃষ্ঠা জুড়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বাণী প্রকাশ আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত একটি রীতি।

জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলোতেও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ক্রোড়াপত্রে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বাণী প্রকাশিত হতে দেখা যায়। একজন পাঠক হিসেবে আমি এই বাণীগুলো কখনোই পড়িনা কিংবা পড়ার আগ্রহ বোধ করিনা এগুলোতে কিছু গৎবাঁধা কথা লেখা থাকে তাই।

সাধারণ পাঠকেরা একটি পত্রিকা কিংবা ম্যাগাজিনে বেছে বেছে আকর্ষনীয় লেখাগুলোই পড়েন। যাঁরা পড়ুয়া তারা হয়তো পড়েন এঁদের চেয়ে কিছুটা বেশি। কয়েকদিন আগে যথেষ্ট পড়ুয়া কিছু বন্ধু এবং সহকর্মীর এক বৈঠকে এমনই একটি ম্যাগাজিন দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম ওখানে ছাপা হওয়া বাণীগুলো তাঁরা কেউ পড়েছেন কীনা অথবা পড়ার আগ্রহ বোধ করেন কীনা। একবাক্যে সবাই উত্তর দিয়েছেন তাঁরা পড়েননা। কেউ কেউ ব্যাঙ্গাত্মক হাসি দিয়ে বুঝিয়েছেন এগুলো পড়ার সময় কোথায়?

প্রকাশনার কাজে জড়িত থাকার আমার যে ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা তাতেও দেখেছি, এসব বাণীগুলো সাধারণত যাঁরা প্রকাশনার কাজ করছেন, তাঁরা নিজেরাই লিখে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, জেলা প্রশাসক অথবা অন্যান্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে স্বাক্ষর করিয়ে নিচ্ছেন। স্বাক্ষরকারী ব্যক্তিরা তাঁদের বাণী হিসেবে কোথায় কী প্রকাশিত হচ্ছে তা প্রায় সময়ই জানেননা। দেশের কোনো এক উপজেলায় বিজয় দিবস উপলক্ষে ম্যাগাজিন বেরুবে, সেখানে কোনো মন্ত্রী বাণী দেবেন। সেক্ষেত্রে বাণীর ড্রাফ্টটি ফ্যাঙ্ েতাঁর অফিসে পাঠানো হয়। সংশ্লিষ্ট সচিব কিংবা ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ড্রাফ্টটি দেখে আপত্তিকর কিছু না থাকলে মন্ত্রী মহোদয়ের স্বাক্ষর নিয়ে ফ্যাঙ্ইে প্রকাশনার উদ্যোক্তাদের কাছে ফেরত পাঠান। বাণী প্রকাশ হয়ে যায়। প্রকাশিত ম্যাগাজিনটি পরে অত্যন্ত যত্ন সহকারে হয়তো মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে পাঠানোও হয়। কিন্তু দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আশা শত শত ডাকের ভীড়ে কোনো উপজেলা থেকে আসা একটি ম্যাগাজিন কিংবা সেখানে প্রকাশিত তাঁর নিজের বাণীটিই পড়ার মতো সময় মন্ত্রী মহোদয়ের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়না, হবার কথাও নয়।

অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যাচ্ছে- যিনি বাণী দিচ্ছেন তিনিও পড়ছেননা, সাধারণ পাঠক কিংবা পড়ুয়া পাঠকও পড়ছেননা। যেখানে একটি প্রকাশনায় স্থান, বাজেট ও সময় সংকুলানের জন্যে অনেক লেখকের লেখা ফেলে দিতে হয়, সেখানে এমন পাঠকসম্পৃক্ততাবিহীন বাণীগুলো ছাপা হয় কেন? গুরুত্বপূর্ণ ও ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের তুষ্ট করার জন্যে যদি এটা হয়ে থাকে, সেখানেও এই পদ্ধতি কার্যকর হয়না, যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নিজেরাই এগুলো পড়ার সময় পাননা।

গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বেশিরভাগই দেশের সর্বত্র কোনো না কোনোভাবে তাঁদের নাম ও ছবি ঝুলিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। এক্ষেত্রেও হয়তো করেন। কিন্তু আমরা যারা প্রকাশনার কাজগুলোর উদ্যোগ নেই, তারা কেন এই অর্থহীন স্তুতিসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছিনা? এই দাস মনোবৃত্তি থেকে আমরা কবে বের হতে পারবো