পয়লা’র ষাঁড় ও স্বামীগণ

ফারুক জোয়ার্দ্দার
Published : 16 Nov 2014, 06:22 PM
Updated : 16 Nov 2014, 06:22 PM

২০১০ এর শেষ নভেম্বর। সিরাজগঞ্জের চৌহালী গেছি অফিসের এক তদন্তকাজে। বন্ধু সহকর্মী নেওয়াজের মায়ের হৈমন্তিক আতিথ্য উপভোগ করছি। চৌহালীতে আমাদের বিআরডিবি'র দ্বিতল পল্লীভবন পরিত্যাক্ত হয়েছে আগেই; যমুনার ভাঙা পাড়ে মরার মত পড়ে আছে পানির দরে বিকোনোর প্রতীক্ষায়। যমুনা এখন মরা, ধুধু বালুচর যতদূর চোখ যায়। উপজেলা সদরের দিকে ধুলো উড়িয়ে চলে গেছে যে রাস্তা, নদীভাঙা ভুখা মানুষের খুপড়ি ঘর আর গরু-ছাগলের দখলে তার দু'পাশ।

কাকডাকা ভোরে হাঁটতে বেরিয়েছি নেওয়াজের সঙ্গে। আখের শুকনো পাতা আর বিছালির আগুনে ওম পাবার নিরন্তর চেষ্টা চালাচ্ছে বুড়োরা। আর মোটা জাম্পারে মিথ্যে উষ্ণতা খুঁজতে ব্যস্ত শিশুদের চোট্ট নাক দিয়ে শিন্ গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। উঁচু বাঁধের মধ্যিখান দিয়ে 'পায়ে চলা'র রাস্তা; ঘাস-লতাপাতায় মাখা শিশির ভিজিয়ে দিচ্ছে দু'পা। ধুসর কুয়াশামাখা মায়াময় এ গ্রামের নাম 'পয়লা'।

বাঁধ থেকে ঢালুতে নেমে পড়ি। দু'পাশে বাঁশবাগান; অশ্রুবিন্দুর মত জলের ফোঁটা বাঁশের পাতার ডগা গলে গলে নেমে আসছে গালে। চোখের সামনে যতদূর চোখ যায়, যমুনা। হাটাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গা বেয়ে নদীর খাড়া পাড় নেমে গেছে তলদেশে। আগামী বার এ স্কুল থাকবে না, নিশ্চিত। আগেও গেছিল দু'বার যমুনার গর্ভে। বসতবাড়ির চালা, গোয়ালের গরু আর নারী-শিশুদের সাথে স্কুলটাও বয়ে এনেছে পয়লার মানুষ। আবার সময় হলো বুঝি অন্য কোথাও বয়ে নেবার।

নদীর উঁচু পাড় কেটে কেটে তৈরী নেমে যাওযার সিঁড়ি। ভীষণ পিচ্ছিল। বহু দূরে ক্ষীণকায়া স্রোতস্বিনী যমুনা। ভেজা বালিয়ারি মাড়িয়ে হেঁটে চলেছি। মানুষের দেখা মিলছে সারি সারি। ষাঁড়ের গলায় বাঁধা দড়ি হাতে শক্ত পেশির পুরুষ মানুষ। তাদের অনুসরণ করছে দ্রুতগামী মলিন খালি পা নারী ও শিশু।

নদীর ঘাটে বিস্ময় অপেক্ষায়। অগণিত মানুষ। পুরুষ, নারী ও শিশু। আর অসংখ্য ষাঁড়। কত বিচিত্র! কী অপরূপ! বড় বড় নৌকা ঘাটে বাঁধা। তাতে উঠার জন্য বাঁশের মাচান। ষাড়ের সাথে শক্তির কসরতে ব্যস্ত শক্ত পেশির পুরুষ। একজন কিছুতেই নৌকায় উঠবে না, আরেকজন নাছোর। চূড়ান্ত বিচারে পুরুষের অনিবার্য জয়। মাথার পেছনে দু'হাত ঠেলে ধরে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে নারী। ছলছল চোখ। গত ছ'মাস শোবার ঘরে স্বামীর মাচানের পাশে শুয়ে জাবর কেটেছে সে। সকালের পান্তা স্বামীকে না খাইয়ে কুড়া-বিছালির সাথে তাকে খাইয়েছে। মহাজনের ঋণের কুড়ি হাজার এখনো সুদে আসলে বাড়ছে। কত স্মৃতি! কত স্বপ্ন! আসছে কুরবানির হাটে গাবতলীতে উঁচু দরে বিকোবে সে। ঋণ শোধ হবে। বছরের চাল-ডাল-স্বপ্ন কেনা হবে সে টাকায়। জলের তোড়ে ঝাপসা হয়ে আসা দু'চোখ নৌকায় স্বামীকে খুঁজে ফেরে। নাকি ষাঁড়কে! বিদায় জানাতে হবে। অনেক দূরে, গাবতলীর পথে রওনা হচ্ছে যে! বিদায় জানানোর জন্যই তো এই সব আয়োজন।