জ্বালানি তেলের মূল্য ও আমাদের লাভ-ক্ষতি

মাসিউল হক চৌধুরী
Published : 28 August 2011, 03:17 PM
Updated : 24 Feb 2016, 04:44 AM

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলসহ বিবিধ ধাতুর আন্তর্জাতিক ক্রমাগত মূল্যাবনতিতে বিশ্বঅর্থনীতির চাকা আরও সচল হয়ে ওঠার কথা। এর বিপরীত চিত্রটি বেশ দুর্বোধ্য এবং অবশ্যই বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। সম্প্রতি ব্যক্তিখাত ব্যতীত অন্য খাতে ঋণাত্মক সুদ ধার্যের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেজাপান কেন্দ্রীয় ব্যাংক, তা সে দেশের অর্থনীতির স্থবিরতার প্রকাশ বলেই ধরে নেওয়া কি অমূলক হবে?

২০১২ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের মূল্য একশ চল্লিশ মার্কিন ডলার থেকে নেমে এ বছর ব্যারেল প্রতি তিরিশ মার্কিন ডলার বা তারও নিচে নেমে যাবার বিষয়টি বিশেষজ্ঞদের সব ভবিষ্যদ্বাণী অসার বলে প্রমাণ করেছে। অনুমান করা হচ্ছিল, তেলের মূল্য ব্যারেল প্রতি দুশ মার্কিন ডলার পার করবে। কারণ তেলের অত্যধিক ব্যবহারে এর বৈশ্বিক মজুদ ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। অথচ এখন এর বিপরীতমুখী প্রবণতা দেখা গেল যা সত্যি আশ্চর্যজনক। এর কারণটাই-বা কী আর আমাদের মতন উন্নয়নশীল দেশের উপর এর প্রভাব কতটুকু, এ গদ্যে সে বিশ্লেষণের প্রচেষ্টা থাকবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর তেলসম্পদে সৌদি আরব বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও এখনও সবচেয়ে বৃহৎ তেল রফতানিকারক ওই দেশটি। সে দেশের বড় বড় শহর ও অবকাঠামো বিনির্মাণ এবং আরব ও পারস্য উপসাগর অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান সুসংহত রাখতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। তাই তেল বিক্রির অর্থ তাদের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। এ কারণে তারা বাজারে প্রচুর তেল বিক্রি করে। তেলের মূল্যহ্রাসের এটি অন্যতম কারণ।

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে ক্রমান্বয়ে বেরিয়ে আসা ইরান সে দেশের বন্দর আব্বাসসহ অন্যান্য বন্দরে তেলবাহী জাহাজ নিয়ে অপেক্ষমাণ। এর ফলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যের উপর আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কিনা সেটি সময়ই বলে দেবে।

আন্তর্জাতিকভাবে জ্বালানি তেলের বিকল্প তথা আণবিক, সৌর ও জলবিদ্যুতের ব্যবহারের মাত্রা বৃদ্ধি এবং কার্বন নির্গমনে বিশেষ তদারকি জ্বালানি তেলের চাহিদা কমিয়ে আনতে সহায়ক হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ অন্যান্য তেল আমদানিকারক দেশ বিকল্প বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করছে বলে বিশ্বে উত্তোলিত তেলের মজুদ সকল সময়ের মাত্রা অতিক্রম করেছে।

উপরের সারণী লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, জ্বালানি তেলের চাহিদার চেয়ে যোগানের পরিমাণ বেশি এবং এ কারণে ঊত্তোলিত জ্বালানি তেলের মজুদও বাড়ছে। বলা হয় যে, মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হারের সঙ্গে বৈশ্বিক তেল উত্তোলনের একটি সম্পর্ক বিদ্যমান। মার্কিন সুদের হার বেশি হলে তেল উত্তোলন বৃদ্ধি পায়। আর সে হার কমলে উত্তোলন কমে যায়।

এখন মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদ উর্ধ্বমুখী বলে জ্বালানি তেল উত্তোলনের পরিমাণ বেশি। এ কারণে জ্বালানি তেলের বিশ্বমূল্য প্রতি ব্যারেল বিশ মার্কিন ডলারের কাছাকাছি চলে আসতে পারে বলেও ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে তেলসমৃদ্ধ আরব বিশ্ব, রাশিয়া, নাইজেরিয়া, ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলাসহ অন্যান্য দেশে বাজেট ঘাটতির সমস্যা প্রকট হতে পারে।

এবার ফিরে তাকাই প্রিয় স্বদেশের দিকে। আমাদের দশ হাজার মেগাওয়াটের বিরাট অংশ জ্বালানি তেলনির্ভর। বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য হ্রাসের কারণে আমাদের দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসাটা কি সময়ের দাবি নয়? এতে যেমন বিদ্যুতের খরচ কমে আসবে, তেমনি মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে। যানবাহনে গ্যাস ব্যবহার হ্রাসের মধ্য দিয়ে আমাদের মূল্যবান খনিজের ব্যবহার রোধে সক্ষম হব আমরা। তাই বিশ্ববাজারের সঙ্গে কিছু সঙ্গতি রেখে ব্যক্তিখাতে এর সুফল ভাগ করলে বাণিজ্য অগ্রগতি পাবে।

বর্তমানে গ্যাস সংকটে বাণিজ্যিক কার্যক্রম বিশেষভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে বাণিজ্যিক মহলের অনুযোগের বিষয়টি বিশেষ করে প্রণিধানে নিয়ে আসা প্রয়োজন। এতে যেমন অভ্যন্তরীন ব্যবসায়ী মহল প্রণোদনা পাবেন, তেমনি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে। কৃষিকাজে সেচের খরচও আনুপাতিক হারে কমে আসবে বলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিসহ খরচ সাশ্রয় হবে। যানবাহনে মূল্যবান দেশীয় গ্যাসের অপচয় রোধের এ সুযোগের ব্যবহার করা বিশেষ প্রয়োজন। তাই জ্বালানি তেলের মূল্য পুনঃর্নির্ধারণের বিষয়টি নীতিনির্ধারকেরা বিশেষ বিবেচনার আনতে পারলে অর্থনীতি গতি পাবে।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের দেশের জন্য এক বিশেষ আশীর্বাদস্বরূপ। এতে একদিকে যেমন বেকার সমস্যার সমাধান ঘটে, অন্যদিকে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পায়।রেমিট্যান্সের শতকরা ষাট ভাগ আসে তেলসমৃদ্ধ আরব দেশসমূহ থেকে। কিন্তু জ্বালানি তেলের মূল্য পতনের কারণে এ সমস্ত দেশে বাজেট ঘাটতি তাদের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত করবে। বিশেষ করে এ সকল দেশের নির্মাণকাজে স্থবিরতার প্রভাবে আমাদের প্রবাসীরা বিবিধ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবেন, এমনকি অনেকের চাকুরিচ্যুতি ঘটাও অস্বাভাবিক নয়। বিদেশ-প্রত্যাগত অদক্ষ শ্রমিকদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োগ এবং পুনর্বাসনের বিষয়ে নীতিনির্ধারক মহলের উচিত বিশেষ যত্নের সঙ্গে একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা।

জ্বালানি তেলের বিকল্প তথা পরিবেশবান্ধব বিদ্যু উৎপাদনের জন্য বিশেষ সময়ের প্রয়োজন; তা সে আণবিক শক্তি, সৌর শক্তি, বায়ু শক্তি, জল শক্তি যা-ই হোক না কেন। এ সমস্ত শক্তির সার্বিক পরিচালনার জন্য সময়ের দরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দরপতন আমাদের জন্য বিশেষ সুবিধাটুকু এনে দিয়েছে। এ সময়ের মধ্যে আমাদের বিকল্প জ্বালানি দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।