বিজয় বার্তার বীর ঘোষক ও তার প্রস্থান

তুষার দাশ
Published : 21 Jan 2012, 04:58 PM
Updated : 21 June 2020, 11:11 AM

আমাদের জাতীয় জীবনের যাবতীয় অর্জনের সূচনা-বিন্দু আমরা ধরে নেই ১৯৫২। কিন্তু ১৯৪৮ সালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব ছাত্র সেদিন জিন্নাহর মুখের ওপর মাতৃভাষা বাংলার বদলে উর্দু চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ইংরেজিতে নো নো বলে প্রতিবাদ জানিয়েছিল, আমাদের নতুন করে সব চলার শুরু সেদিন থেকেই। বাঙালির আত্মসচেতনতার অভাব নেই, রাষ্ট্র আর তার ভাষা-সংস্কৃতির ব্যাপারেও সে নিরাপোষ।

আমাদের অনেকেরই হয়তো একথা মনে থাকবে যে, ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশদের হাতে ভারতের স্বাধীনতা অস্তমিত হলেও, মাত্র সাত বছরের মাথায় ৭/৮ জনের এক সিপাহী দল ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। তাদের সবাইকে কামানের গোলার মুখে বেঁধে উড়িয়ে দিয়েছিল শাসকগোষ্ঠী। ১৯০ বছর পর দেশ স্বাধীন হয়ে দুটি টুকরো হলেও নতুন নামে, সূচনা বিন্দু আমি মনে করি সেই ১৭৬৪ সাল। একথা বলার দুটি কারণ রয়েছে। এক হলো, এই উপমহাদেশের মানুষ সতত সংগ্রামী, লড়াকু, অন্যায়ের সংগে নিরাপোষ। আর, দ্বিতীয়ত, প্রথমবারের আপাত ব্যর্থতাকে সে বুকের মধ্যে জ্বালিয়ে রেখে সামনে এগোয় পরের বিদ্রোহের মাহেন্দ্রমুহূর্তকে স্পর্শ করার জন্যে, যা একসময় তার লক্ষ্যকে সফল করে তোলে। এটা আমাদের দেশের বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রেও সত্য।

এই ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে, অনেকগুলো আন্দোলনের রক্তাক্ত ধাপ পেরিয়ে বিপুল জীবন দানের, ব্যাপক নারীর অসম্মানের অনালোক পেরিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন।

ধরা যাক, এই আন্দোলনগুলোর প্রতিটি ধাপে, প্রতিটি কর্মকাণ্ডে একজন বামধারা-বিশ্বাসী মানুষ নিয়ত সম্পৃক্ত হয়েছেন, তিল তিল করে পরবর্তী প্রজন্মের মানুষগুলোর জন্যে একটি কণ্টকহীন দেশ ও ভবিষ্যৎ নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছেন ব্যক্তিগত অর্জনের লোভনীয় সবকিছু ছেড়ে, নিজের পোশাকে-আশাকে, চলনে-বলনে সবসময় বাঙালি সংস্কৃতিকে মনে-প্রাণে ধারণ করেছেন, নিজেকে প্রকাশে নিরঞ্জন থেকেছেন, কিন্তু দৃঢ়তার ক্ষেত্রে থেকেছেন গাঢ় উঁচুমাথা। সানগ্লাসে চোখ-ঢাকা, অবিশ্বস্ত, নাটুকে, দেশের ভবিষ্যৎ বিনষ্টকারী, বিষভাণ্ড বহনকারী সেনানায়কের পছন্দের পোশাক পরেননি বলে বিদেশ-যাত্রায় বাদ পড়েছেন (আসলে কথাটি বাদ পড়েছেন হবে না, হবে তিনি পোশাক পরিবর্তনে অসম্মত ছিলেন, তিনিই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সরকারি সফর, কারণ তিনি সামরিক প্রেসিডেন্টের পছন্দের সাফারীতে রাজি ছিলেন না, তার পা'জামা-পাঞ্জাবিতেই তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন, একথা জানিয়েছিলেন। অবশ্য এই অবাধ্যতার(!) নগদ পুরস্কারও জুটেছিল। সরকারি পত্রিকার সাংবাদিক হওয়া সত্বেও, প্রগাঢ় সাংস্কৃতিক চেতনার পাশাপাশি বিপুল সাহস না থাকলে এই প্রত্যাখ্যান অসম্ভব।

তিনি ও তার সহযাত্রী বন্ধুরা যে বন্ধুর পথ হেঁটেছিলেন দীর্ঘ যাত্রায়, তার প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে রেখেছিলেন সামনের সারিতে, অনির্বাণ। তাকে দেখলেই মনে হতো আমাদের ধ্রুপদী এক পথ-যোদ্ধা নায়ক। সন্তানদেরও গড়ে তুলতে চেয়েছেন নিজের বিশ্বাসের পথরেখা ধরে, ওদের মধ্যেও চারিয়ে দিয়েছিলেন সাংস্কৃতিক চেতনা। তাদের পুরো পরিবারের বহু সুযোগ্য লোক দেশে বিদেশে নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে তাদের নানা প্রতিভার স্ফূরণ ঘটিয়েছিলেন। একবার সুযোগ হয়েছিল ওনার সংগে তারই বাসায় সামান্য কথাবার্তার। আমরা যাচ্ছি কুমিল্লা, এক অনুষ্ঠানে। এক আবৃত্তি উৎসবে।

তার ছেলে সাগর আমাকে ধরে নিয়ে গেল ওদের কমলাপুরের বাসায়। পরিচয় করিয়ে দিল বাবার সংগে, মায়ের সংগে। কী কথা হয়েছিল, মনে নেই, তবে কাছ থেকে সেই মহীরুহটিকে দেখেছিলাম। বুকের ভেতর অনুভব করেছিলাম এক প্রাণিত ঢেউ। এটা বোধ করি ১৯৮৫-৮৬-র দিকে। এরপর থেকে যে কোনো উৎসবে-জাতীয় সংকটে-মেলায়-অনুষ্ঠানে অনেকের সংগে আছেন তিনি। তিনিই, আমাদের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বিজয় বার্তার মহান ঘোষক, সেই পবিত্র ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এর অনন্য দিনে।

ক্রিকেটে, জয়ের রানটা যেমন সেঞ্চুরিয়ানকে বা ক্যাপ্টেনকে নিতে দেয়া হয় মাঠে থাকলে, এটাও যেন সেরকমই এক নিয়তি নির্দেশিত বিষয়।

কিছু কিছু মানুষ কতভাবে যে মানুষের, দেশের, সংগ্রামের ইতিহাসের সংগে জড়িয়ে যান, তাদের পদচিহ্ন ধরে পরবর্তী প্রগতিপন্থী প্রজন্ম চলে, অন্তত পথের রেখাটি তারা বেশ দীর্ঘ গভীর দাগে রেখে যান। তার সম্পর্কে অনেক কথাই ইতোমধ্যে রচিত হয়ে গেছে। আমি শুধু পরবর্তী প্রজন্মের একজন হিসেবে, প্রিয় কবির ভাষায় বলি — "ঋণশোধের জন্য নয়, ঋণস্বীকারের জন্য" আমার এই ক্ষুদ্র নিবেদন!!

জয়তু কামাল লোহানী !!