ঘাতকের শেষকৃত্য ও আমাদের হিসেবনিকেশ

হাসান মোরশেদ
Published : 14 June 2011, 12:43 PM
Updated : 27 Oct 2014, 07:15 PM

১৫ জুলাই, ২০১৩ যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গোলাম আযমের মানবতাবিরোধী অপরাধের রায় দেন, তখন এই যুদ্ধাপরাধীর বয়স ছিল একানব্বই বছর। ট্রাইব্যুনালের রায়ে তার বিরুদ্ধে আনীত পাঁচ ধরনের অভিযোগের ৬১ ঘটনার সবগুলোই প্রমাণিত। মহামান্য আদালত রায় ঘোষণায় বলেছেন যে, তার অপরাধ নিঃসন্দেহে মৃত্যুদণ্ডের সমতুল্য কিন্তু বয়স বিবেচনায় তাকে নব্বই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

যে অপরাধীর বয়স ইতোমধ্যেই একানব্বই বছর, পূর্ণমেয়াদে সাজা গ্রহণের জন্য আরও নব্বই বছর সে বেঁচে থাকবে না– এটাই স্বাভাবিক। বিজ্ঞ আদালত এটা জ্ঞাত ছিলেন। যারা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারপ্রার্থী ছিলেন, তারাও জানতেন এবং গোলাম আযমের পক্ষে যারা, তার রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী, তারাও এটা জানত।

গোলাম আযম, কাদের মোল্লা, মতিউর রহমান নিযামীর মতো শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীরা ১৯৭১এ পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্বারা সংগঠিত গণহত্যায় সহযোগী ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হয়ে অংশ নিয়েছেন কেবল ব্যক্তি হিসেবে নয়, জামায়াতে ইসলামী নামে একটা রাজনৈতিক সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্ব হিসেবেও।

স্বাধীনতার চার দশক পর দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল হিসেবে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে কাদের মোল্লা্র সর্ব্বোচ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ড ঘোষিত হয়েছে এবং গোলাম আযম সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসাবেই কারাবন্দি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু যে রাজনৈতিক দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধ তারা সংগঠিত করেছিলেন, সেই দলটি– সাংগঠনিকভাবে এখনও দণ্ডিত নয়। ১৯৭৫এর পর থেকে সামরিক শাসক জিয়া ও এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার দু'বারের শাসনামলের বদান্যতায় এই রাজনৈতিক দল শুধু পুনর্বাসিতই হয়নি, দেশের সামরিক, অর্থনৈতিক, সেবা, এমনকি কৃষিখাত পর্যন্ত তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী ভূমিকা নিয়ে তাদের কোনো অনুতাপ নেই এবং দণ্ডপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন শীর্ষ নেতৃত্বকে তারা নিজেদের অস্তিত্বের অংশ বলেই মনে করে।

একানব্বই বছর বয়সে পরবর্তী নব্বই বছরের জন্য কারাদণ্ড পাওয়া গোলাম আযম যে কোনো দিন মারা যাবেন এবং তার মৃত্যুপরবর্তী পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ফায়দা আদায় করতে হবে– এমন প্রস্তুতি রাজনৈতিকভাবে চরিত্রহীন ও ধুরন্ধর জামায়াতে ইসলামীর থাকাটাই স্বাভাবিক।

এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, গোলাম আযমের শেষ অছিয়তনামা বলে প্রচারিত চালবাজিতে। মৃত্যুর মুহূর্তে যেখানে মানুষ তার সারাজীবনের ভুল-ভ্রান্তি, পাপের জন্য মহান স্রষ্টার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হন, মুসলমান মাত্রই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে তওবা করেন সেখানে গোলাম আযমের শেষ ইচ্ছা তার জানাজা যেন পড়ান আরেক দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদী অথবা বিচারাধীন মতিউর রহমান নিযামী।

জামায়াতে ইসলামীর ভালোভাবেই জানা আছে যে, আইনত সরকার এটা পারবে না। সে ক্ষেত্রে সাঈদী বা নিযামীকে প্যারোলে মুক্তি দিতে হবে। নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু ব্যতীত প্যারোলে কারও মুক্তি পাওয়ার আইন নেই। তবু এই অছিয়তনামার উদ্দেশ্য ছিল, কোনোভাবে সরকারকে ফাঁদে ফেলা। যদি সরকারের ভেতরে ক্রিয়াশীল জামায়াতের প্রতি সহানুভূতিশীল অংশের মাধ্যমে এই কাজটা করানো যায় তাহলে ব্যাপক লোকসমাগম ঘটিয়ে একটা নৈরাজ্যের সৃষ্টি করা যাবে।

সৌভাগ্য যে, সরকার এই ফাঁদে পা দেয়নি। গোলাম আযমের মরদেহ ময়নাতদন্ত না করার আবেদনও করা হয়েছিল, সরকার সেটাও অগ্রাহ্য করে আইন অনুযায়ী ময়নাতদন্ত করেছে।

যেখানে মুসলমান মাত্রেরই ধর্মীয় বিধানমতে দ্রুত দাফনের বিধান আছে, সেখানে তার প্রবাসী সন্তানদের দেশে ফেরার অজুহাতে দুদিন কালক্ষেপণ করা হয়েছে। আগের প্রস্তুতি এবং এই দুদিনের সুযোগে জামায়াত তার ম্যাকানিজম কাজে লাগিয়ে গোলাম আযমের জানাজায় বেশ ভালো উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পেরেছে। ঢাকা এবং এর আশপাশ থেকে জামায়াতের বিভিন্ন প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের কর্মীদের উপস্থিতিতেই এই দৃশ্যমান সমাবেশ সম্ভব।

সরকার এই সমাবেশে বাধা দেয়নি, বরং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল, পুলিশ তৎপর ছিল জানাজা ও দাফন পূর্ববর্তী সমস্ত ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ যেন তাদের হাতেই থাকে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সম্ভবত দুটো সীমাবদ্ধতা ছিল। প্রথমত, একটা বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের দায়; দ্বিতীয়ত, এই ব্যবস্থাপনা যদি সরকারের নিয়ন্ত্রণে না থাকত তাহলে তা যেত জামায়াতের হাতে এবং জামায়াত তার পরিকল্পনামতো নৈরাজ্য সৃষ্টি করত।

কিন্তু শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী– যে জনতার আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত, রাষ্ট্রীয় আদালতেও নব্বই বছরের সাজাপ্রাপ্ত– সেই ঘৃণিত গোলাম আযমের কি এমন নিশ্চিত নিরাপদ শেষ বিদায় প্রাপ্য ছিল? স্পষ্ট ও সরাসরি উত্তর, 'না'। পৃথিবীর যে সকল দেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পেরেছে কোথাও যুদ্ধাপরাধীর শেষ যাত্রা এমন আয়োজিত হয়নি। তাহলে আমরা ব্যর্থ হলাম কেন?

জামায়াতে ইসলামী এবং সরকারের বাইরে এখানে আরেকটি পক্ষ উপস্থিত ছিলেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষজন। স্বাধীন বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের সরকারি বিমুখতার পরও যে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষজন দুর্বল তা কিন্তু নয়। প্রবল পরাক্রমশালী হয়ে ওঠা গোলাম আযমের কারাভোগী অপরাধী হিসেবে মৃত্যু, কাদের মোল্লার ফাঁসি– প্রমাণ করে এই দেশে এখনও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।

এই মানুষদেরকে দীর্ঘদিনের আন্দোলন সংগ্রামের বিনিময়ে এই অর্জনগুলো আদায় করে নিতে হয়েছে। এই মানুষদের, এই মানুষদের সংগঠনসমূহেরও কিন্তু জানা ছিল গোলাম আযম যে কোনো দিন মারা যাবেন। কিন্তু শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের শেষ বিদায়ের আয়োজনের কোনো প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা ছিল না এই পক্ষ থেকে।

একজন অ্যাকটিভিস্ট মাহমুদুল হক বাঁধনের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘৃণা প্রকাশ ছাড়া ঘাতক-প্রধানের শেষ বিদায়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের কোনো আয়োজন ছিল না কোথাও।

শুধুমাত্র সরকারকে সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে আমরা নিজেদের দায় এড়াতে পারি না। অবস্থানগত কারণে সরকারের কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, কিন্তু আমরা যারা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক, আমরা এই সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ নই। কারাবন্দি যুদ্ধাপরাধীরও শেষকৃত্যের আয়োজন সরকারের দায়, কিন্তু সেই শেষকৃত্যে ঘৃণা প্রকাশ করা নাগরিকের স্বাধীনতা।

অনেকগুলো গণমাধ্যমে গোলাম আযমের মৃত্যুসংবাদে তার পরিচয় দেওয়া হয়েছে 'জামায়াতের সাবেক আমীর' কিংবা 'মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত'। গোলাম আযমের প্রধান পরিচয় তিনি শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী, গণহত্যার অন্যতম অংশীদার এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে 'অভিযুক্ত' নন বরং 'দণ্ডিত'। এমনকি একটা টিভি চ্যানেল তার জানাজার সরাসরি দৃশ্যায়ন প্রচার করেছে। এই চ্যানেলের কল্যাণে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত জানাজা প্রচারিত হয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই তা দেশের অসচেতন, অর্ধসচেতন বিরাট জনগোষ্ঠীর সহানুভূতি আকর্ষণ করেছে।

অথচ জানাজার সংবাদ প্রচারের পাশাপাশি এইদিন সারাদিন মিডিয়া ব্যস্ত থাকতে পারত গোলাম আযমের কুকীর্তিগুলো প্রচারে। তার জানাজা প্রচার না করে সিরু মিয়া দারোগার হত্যাকাণ্ড প্রচার করা হল না কেন যাকে সরাসরি গোলাম আযমের নির্দেশে হত্যা করা হয়েছিল? ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর রোজার ঈদের রাতে কারাগার থেকে বের করে এনে হত্যা করা হয়েছিল যে ৩৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে– গোলাম আযমের সরাসরি নির্দেশে– তাদের পরিবার-পরিজনের আহাজারি কেন সম্প্রচার করা হল না?

যে অসচেতন, অর্ধসচেতন বিরাট জনগোষ্ঠীর সহানুভূতি তৈরি করা হল জানাজা প্রচারের মাধ্যমে, মিডিয়া কি সত্য জানা থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করল না?

একটা প্রশ্ন উত্থাপিত হতেই পারে– মিডিয়ার দায়িত্ব কি নিরপেক্ষ থাকার নামে সত্য ক্ষতিগ্রস্ত করা, নাকি সত্যের পক্ষে থাকা?

একজন গোলাম আযম মারা গেছেন দণ্ডিত অপরাধী হিসেবে। বাকি যুদ্ধাপরাধীদেরও অনেকের দণ্ডিত অপরাধী হিসেবে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। প্রত্যেকের শেষকৃত্যই কি এ রকম আয়োজিত হবে? অথবা এই যুদ্ধাপরাধীদের প্রত্যেকে মারা যাওয়ার পর, তাদের শেষকৃত্যের পর?

আমাদের যে পূর্বসূরীরা প্রাণ দিয়ে গেলেন, যুদ্ধাপরাধীর এ রকম শেষকৃত্যের সঙ্গে সঙ্গেই কি তাদের আত্মদানের উত্তরাধিকার ফুরিয়ে যাবে? দীর্ঘ রাষ্ট্রীয় প্রণোদনায় যুদ্ধাপরাধীরা এদেশের রাজনীতি, ধর্ম, শিক্ষা, অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থায় যে বিষবৃক্ষ রোপন করার সুযোগ পেয়েছে, সেটা মহীরুহ হয়ে আমাদের সমূহ সর্বনাশ করছে এবং করতে থাকবে– যেদিন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের শারীরিক উপস্থিতি থাকবে না সেদিনও। গোলাম আযমরা নেই, কিন্তু তারা থেকেও যাবেন ততদিন, যতদিন না এই রাষ্ট্র থেকে তাদের রাজনীতি ও আদর্শ সমূলে উৎপাটিত হয়।

এই বিষবৃক্ষ মোকাবেলায় শুধুমাত্র আবেগ, নিবেদন ও চেতনাই যথেষ্ট নয়, বরং প্রয়োজন কার্যকর পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি। এই প্রস্তুতির শুরু হতে পারে সরকারের কাছ থেকে একটা সুনির্দিষ্ট দাবি আদায়ের মাধ্যমে। স্কুল পর্যায় থেকে পাঠ্যপুস্তকে বীরশ্রেষ্ঠদের পাশাপাশি গোলাম আযমসহ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের কীর্তিকলাপ লিপিবদ্ধ হোক। শৈশব থেকে যেন আমাদের শিশুরা ঘৃণা করতে শিখে সেইসব ঘাতকদের যারা আমাদের শিশুদেরও হত্যা করেছিল নির্দয়ভাবে।

এই ঘাতকদের শেষ বিদায় আমরা আয়োজন করেছি এটাই শেষ সত্য নয়, তাদের কফিনে ঘৃণার জুতা ছুঁড়েছি– সেই অমোঘ সত্যও লিপিবদ্ধ থাকুক আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য।

হাসান মোরশেদ: ব্লগার, পর্যটন ঊন্নয়নকর্মী।