অর্থনৈতিক মুক্তি-৬ষ্ঠ পর্ব

গ্রুপ ক্যাপ্টেন ফজলুল হক
Published : 19 June 2011, 05:03 AM
Updated : 19 June 2011, 05:03 AM

ক্ষমতার ব্যক্তিমালিকানার অধিকার ক্ষমতা গণতন্ত্রায়নের মৌলিক শর্ত। তবে শুধু ব্যক্তি মালিকানা থাকলেই যথেষ্ট নয়; ক্ষমতা সংরক্ষণ ও ব্যবহারের অধিকার এবং সামর্থ থাকার প্রয়োজন হয়। সার্বজনীন ভোটাধিকার জনসাধারণকে সোসিও-পলিটিকাল ক্ষমতার( রাষ্ট্র ক্ষমতা) ব্যক্তিমালিকানা দেয়; তেমনি অর্থ-সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানা সোসিও-ইকোনমিক ক্ষমতার( আর্থিক ক্ষমতা) মালিকানা দেয়।

কিন্তু সেন্ট্রালাইজড গভর্নমেন্ট সিসটেমে রাষ্ট্র ক্ষমতা জনগণের থেকে কেড়ে নেয়া হয় এবং নির্বাচনের মাধ্যমে।নির্বাচিত সংসদ সদস্য, মন্ত্রী প্রভৃতি প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হয়। এমনকি প্রতিনিধিদের অনুসারীরা( রাজনৈতিক নেতাকর্মী) জনগণের উপর আধিপত্য বিস্তার করে। শুধু ভোটদান ব্যতীত রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের রাষ্ট্র ক্ষমতা ব্যবহারের কোন সুযোগ থাকে না। ফলে জনগণ রাষ্ট্র ক্ষমতাধারীদের দ্বারা শাসিত হয়; সমাজে গণতন্ত্র থাকে না।

অন্যদিকে সেন্ট্রালাইজড অর্থব্যবস্থা (মুক্তবাজার ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক উভয়ই) জনগণকে আর্থিক ক্ষমতাহীন করে শোষণে আবদ্ধ করা হয়। ব্যক্তিমালিকানার অধিকার সূত্রে যেটুকু আর্থিক ক্ষমতা সাধারণ মানুষকে দেয়ার অংগীকার করা হয় তা ফিস্কাল পলিসি; মানিটারি পলিসি; বাজেট; কৃষি,শিল্প,ও বাণিজ্য নীতি; আমদানি,রপ্তানি নীতি; ব্যাংক ও ঋণ নীতি ইত্যাদি দ্বারা কেড়ে নিয়ে ধনিক, বণিক, সম্পদশালীদের কাছে কুক্ষিগত করা হয়।সাধারণ মানুষ তখন অসহায় শ্রমবিক্রয়কারী হিসেবে শোষিত হয়। দেশের ফিসকাল পলিসি, মানিটারি পলিসি,বাজেট, ব্যাংক, ঋণ নীতি ইত্যাদি কোন অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে জনগণের ভূমিকা রাখার কোন সুযোগ থাকে না। ফলে জনগণ অসহায়ের মত শোষিত হয়।

উক্ত শাসিত ও শোষিত অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং অর্থব্যবস্থার গণতন্ত্রায়ন করতে হবে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার গণতন্ত্রায়নের বিষয় আগেই আলোচিত হয়েছে( সংবিধান সমস্যা—–)। অর্থনৈতিক মুক্তির আলোচনায় অর্থব্যবস্থার গণতন্ত্রায়নের বিষয় আলোচিত হচ্ছে।অর্থনৈতিক চক্রে(সঞ্চয়- বিনিয়োগ– উৎপাদন– বন্টন– বিনিময়–ভোগ) যে ফ্যাক্টর প্রয়োজন হয় তাহলো শ্রম, সম্পদ, মূলধন, প্রযুক্তি ও সংগঠন এবং মুক্তবাজার অর্থব্যবস্থায় এগুলোর ফ্যাক্টর প্রাইস অনুসারে সমাজে আয় বন্টন হয়।তাই ফ্যাক্টরের মালিকগণ অংশমত আয় প্রাপ্ত হয়।সুতরাং শোষণহীন ভাবে আয় বন্টন নিশ্চিত করতে হলে ফ্যাক্টর সমূহের মালিকানার গণতন্ত্রায়ন করতে হবে।

১। শ্রমঃ সম্পদ ও উৎপাদনের উপায়ের উপর শ্রম প্রযোজিত হয়ে পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হয়। শ্রমই একমাত্র ফ্যাক্টর যা নতুন মূল্য সৃষ্টি করে। মুক্ত সমাজে শ্রমশক্তির মালিকানা ব্যক্তিগত হলেও আর্থিক ক্ষমতাহীন হওয়ায় শ্রমজীবিরা অর্থনীতির অদৃশ্য শৃংখলে আবদ্ধ থেকে কম মূল্যে (মুজুরী) শ্রম বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। শ্রমজীবীদের মুক্ত স্বাধীন শ্রমিক হতে হলে মূলধন ও উৎপাদনের উপায়ের মালিকানা অর্জন করতে হবে।

২। সম্পদঃ প্রাকৃতিক সম্পদ যা মানুষের সৃষ্ট নয়; তবে সেগুলো আহরণ ও ব্যবহার উপযোগি করতে মানুষের শ্রম নিয়োগ করতে হয়। গণতান্ত্রিক নীতিতে সম্পদের মালিকানা জনগণের ও দেশ ভিত্তিক হওয়া উচিত।ভূমি, জলাশয়, বন, ইত্যাদির স্থানীয় ( ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা) মালিকানা অর্থব্যবস্থার গণতন্ত্রায়নের জন্য আবশ্যকীয়।স্থানীয় সমিতি সমূহের মালিকানায় এগুলো উৎপাদনমুখী প্রকল্পে ব্যবহার করতে হবে।

৩। মূলধনঃ মূলধন গঠিত হয় সঞ্চয় থেকে এবং তা থাকে পুঁজিপতিদের দখলে। শ্রমজীবীরা মূলধনের মালিক না হওয়ায় শোষিত হয় এবং তারা ক্রমাগত দরিদ্র হয়।কিন্তু রাষ্ট্র, সরকার বা পুঁজিপতিরা শ্রমজীবীদের পুঁজির মালিকানা দিতে পারে না।কারণ তারা শোষণের হাতিয়ার ছেড়ে দেবে না।তাই শ্রমজীবীদের নিজস্ব সঞ্চয় থেকে মূলধন গঠন করতে হবে। এনজিও, সমবায় প্রভৃতির মাধ্যমে সঞ্চয় প্রমাণ করে যে সম্পদহীন শ্রমজীবীরা মুলধন গঠন করতে সক্ষম। তবে সঞ্চয়কৃত মূলধন যাতে নিজদের কর্তৃত্বে ব্যবহার করতে পারে তার জন্য—– প্রতি ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা স্তরে সমিতির মাধ্যমে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ তহবিল গঠন করতে হবে। তহবিলের ৬০% হবে স্থানীয় সমিতির সঞ্চয়; ২০% হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ এবং ২০% হবে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমূহের বিনিয়োগ। এই তহবিলের ব্যবহার হবে এলাকা ভিত্তিক কর্মসংস্থান মূলক প্রকল্প গ্রহন এবং স্থানীয় জনগণের চাহিদা পূরণমুখী। তহবিলের ব্যবস্থাপনা পরিষদ গঠিত হবে সঞ্চয়কারী সমিতির নির্বাচিত সদস্য ৬০%; কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদস্য ২০% এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমূহের সদস্য ২০%।এই তহবিলের অর্থ কোন নির্বাহী ব্যয়ে খরচ করা যাবে না। প্রকল্প সমূহের আয় বিনিয়োগের অনুপাতে(৬০%,২০%,২০%) ভাগ হবে।

৪। প্রযুক্তিঃ শিক্ষা, বিজ্ঞান,প্রকৌশল, ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি প্রযুক্তি জ্ঞান ব্যবহার করে প্রতিযোগিতা মূলক অর্থব্যবস্থায় টিকে থাকা আজকের বিশ্বের দাবী। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন তাই অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবি। শিক্ষা ও প্রযুক্তি জ্ঞান অর্জন শ্রমজীবিদের জন্য অত্যাবশ্যক। এজন্য পেশাজীবি সমিতি সমুহের তত্ত্বাবধানে টেকনিকাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।

৫। সংগঠনঃ বাংলাদেশে ক্ষুদে উৎপাদনকারীরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে আর্থিক কর্ম চালায়। কিন্তু তারা পুজি ও প্রযক্তির ব্যবহার করতে না পারায় প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠে না।এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে পেশাজীবীদের সমবায়ের মাধ্যমে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। তবে স্থানীয় অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে প্রথমে রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিকেন্দ্রায় ও গণতন্ত্রায় করে স্থানীয় স্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা (ইউনিয়, উপজেলা, জেলা) সংসদ, পরিষদ, বিচার ও লজিস্টিক বিভাগ গড়ে তুলতে হবে।

অর্থব্যবস্থা গণতন্ত্রায়নের মৌলিক পদক্ষেপ হবেঃ

১। নীতি নির্ধারণঃ মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি; কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ও ঋণ নীতি এবং বাজেট ও পরিকল্পনা ইত্যাদি নীতি নির্ধারণে স্থানীয় সংসদ সমূহের মাধ্যমে জনগণের অংশগ্রহন নিশ্চিত করতে হবে।

২। সঞ্চয় ও বিনিয়োগঃ স্থানীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগ তহবিল গঠন করে জনগণের কর্মসংস্থান, চাহিদা পূরণ ও উন্নয়ন মূলক প্রকল্পে বিনিয়োগ করা যাতে জিডিপির বন্টন জনগণের কাছে যায়।

৩। উৎপাদন ব্যবস্থাঃ ব্যক্তিমালিকানার অংশীদারিত্বে সমবায় ভিত্তিক ফার্ম ও শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করা।

৪। বাজার ব্যবস্থাঃ গণতান্ত্রিকভাবে সংগঠিত ও পরিচালিত এবং স্থানীয় সংসদ সমূহের তত্ত্বাবধানে বাজার গড়ে তুলতে হবে।

৫। নির্বাহী ব্যবস্থাঃ সকল নির্বাহী ব্যয় জনগণ প্রদত্ত করের অর্থে করতে হবে। সংযুক্ত তহবিলে সঞ্চয়ের বা উন্নয়নের অর্থ নেয়া যাবে না।

৬। বৈদেশিক বা আন্তর্জাতিকঃ বৈদেশিক বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক লেনদেন, বিনিময় হার জাতীয় সংসদ ও গণ সংসদের অনুমোদনে গৃহীত হওয়া।