অর্থনৈতিক মুক্তি-৭ম পর্ব

গ্রুপ ক্যাপ্টেন ফজলুল হক
Published : 22 June 2011, 03:31 AM
Updated : 22 June 2011, 03:31 AM

সোসিও-ইকোনমিক পাওয়ার এবং অর্থব্যবস্থা গণতন্ত্রায়নের আলোকে বাংলাদেশে আর্থিক সংস্কারের বিষয় আলোচনা করা যায়। ১৯৭২ এর সংবিধানের ১৩ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রীয়, সমবায় ও ব্যক্তিগত মালিকানার বিধান দেয়া হয়েছে। কিন্তু আর্থিক উন্নয়নে উক্ত মালিকানা নীতির ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট কোন পদক্ষেপ নেয়া হয় নাই।রাষ্ট্রীয় মালিকানার ক্ষেত্রে এক এক সময় এক এক পলিসি নেয়া হয়েছে। কখন রাষ্ট্রীয় করণ; কখন বিরাষ্ট্রীয় করণ। টিসিবি বন্ধ; আবার চালু। দাতাগোষ্ঠীর চাপে রাষ্ট্রীয় শিল্প বন্ধ।জনগণের ক্ষমতায়ন বিশিষ্ট গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার বদলে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য দুর্নীতিগ্রস্থ হওয়া। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় খাত ও ব্যক্তিমালিকানা খাত একই সাথে চালু থাকলে নানা দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় খাত হতে ব্যক্তিমালিকানা খাতে সম্পদের হস্থান্তর হয় যা একমাত্র জনগণের ক্ষমতায়ন বিশিষ্ট ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধানে বন্ধ করা সম্ভব। এজন্য স্থানীয় সংসদ সমূহের তত্ত্বাবধানে এবং স্থানীয় পরিষদ কতৃক রাষ্ট্রীয় মালিকানা খাত পরিচালিত হতে হবে। পেশাজীবিদের গঠিত সমিতির মাধ্যমে সমবায় খাত চালু করতে হবে। এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক মালিকানা এমন হবে যেন ব্যক্তিমালিকানা দ্বারা সমাজে শোষণ সৃষ্টি না হয়।

বাংলাদেশের আর্থিক খাত ও তার সংস্কার-

১। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ব্যবস্থাঃ- বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাপন ব্যক্তিগত পরিবার কেন্দ্রিক। জীবিকার জন্য সম্পদ ও উৎপাদনের উপায়ের মালিকানা, শ্রমদান, পুজি বিনিয়োগ ইত্যাদি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ও পরিবার কেন্দ্রিক। কিছু ধনী কৃষক ও ব্যবসায়ী ব্যতীত তাদের বেশীর ভাগ ক্ষুদে চাষী, ক্ষুদ্র পেশাজীবি, কারিগর ও ব্যবসায়ী যারা সাধারণতঃ মজুর খাটায় না এবং নিজদের পারিবারিক শ্রমে প্রতিষ্ঠান চালায়।অথবা মৌসুমে দু'একজন মজুর নিয়োগ করে। তাদের উৎপাদনশীলতা কম, পূন্য ও সেবার মান নীচু এবং তারা বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারে না। তারা সামান্য সম্পদের মালিক ও দরিদ্র হওয়া সত্বেও তাদের জীবিকার ক্ষুদ্র অবলম্বন তারা ছাড়তে চায় না। কারণ অধিকতর ভাল আয়ের সুযোগ না পেলে বর্তমান আয়ের উপায় ছাড়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা একটা অমানবিক নীতি। বিকল্প ভাল আয়ের উপায় না দিয়ে কিছু নগদ অর্থ দেয়া গরু মেরে জুতা দানের সামিল।

সতরাং এই শ্রেণীখাতের সংস্কার এমনভাবে করা প্রয়োজন যে তারা যেন তাদের বর্তমান সম্পদ, পেশা ও আয় হতে বঞ্চিত না হয়। বরং তাদের জীবিকার অবলম্বনের উন্নতি হয় এবং বিকল্প কোন পেশায় গেলেও আয় বৃদ্ধি পায়। এই সংস্কার বাজেট, বাজার ব্যবস্থা, রাজস্ব নীতি, ঋণদান প্রভৃতি দ্বারা সহায়তা করা যায়। তবে বৈদেশিক ঋণ নয়; নিজস্ব সঞ্চয় ও বিনিয়োগ হতে সংস্কার প্রকল্প গ্রহন করা বিধেয়।

২। প্রাইভেট ও কোম্পানি ব্যবস্থাঃ- জোতদার ও বৃহত ভূমি মালিক, শিল্প মালিক, বৃহত ব্যবসায়ী, ব্যাঙ্ক ঋণ ও বড়পুজি মালিকানায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠান সমুহ। তারা মুজুর খাটায় এবং নিজেরা ব্যবস্থাপনাকারী ও লভ্যাংশ ভোগকারী হয়। তারা রাজনৈতিক, আর্থিক ও সামাজিকভাবে ক্ষমতাধারী। তাদের ক্ষমতা ও শাসন শোষণের সুবিধা তারা ছাড়তে চায় না। যে কোন রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রাম ও পট পরিবর্তনে তাদের অবস্থান তারা ধরে রাখতে সচেষ্ট থাকে। রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন ঠেকাতে না পারলে তারা আপোস বিন্যাসের মাধ্যমে নিজদের অবস্থান ও সম্পদ রক্ষা করে।
সুতরাং দেশের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক সংস্কার এমনভাবে হওয়া প্রয়োজন যে এই শ্রেণী যেন তাদের আর্থিক ও রাজনৈতিক অবৈধ সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে না পারে। তবে তারা স্বেচ্ছায় বা সহজে তাদের ক্ষমতা বা সুবিধা ত্যাগ করে না। পরিবর্তনের জন্য দরকার হয় জনগণের ঐক্য, সংগঠন ও আন্দোলন যা স্থানীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও স্থানীয় অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন দ্বারা করা সম্ভব।স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় বাজেট, অবৈধ ঋণ বন্ধ এবং রাজস্ব ও কর ব্যবস্থা দ্বারা আরাধ্য সংস্কার এগিয়ে নেয়া যায়। তবে পরিবর্তন আনতে হলে স্থানীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং স্থানীয় অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

৩। সমবায়ী ব্যবস্থাঃ- বাংলাদেশে উত্তরাধিকার সূত্রে কিছু কিছু যৌথ পরিবার বা গোষ্ঠীভুক্ত মালিকানা আছে; কিন্তু সমবায়ী উৎপাদন ব্যবস্থা নাই বললেই চলে। ব্যক্তি ও ক্ষুদ্র মালিকানার কৃষক, কুটীর শিল্প কারিগর ও পেশাজীবী সম্প্রদায়ের সমবায় গঠন করে আধুনিক পদ্ধতি ও প্রযুক্তি নির্ভর উৎপাদন, প্রোসেসিং, সংরক্ষণ ও বাজারজাত করা দরকার। এসব সমবায় খামার ও কারখানা এমনভাবে হবে যেন সেখানে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, প্রতিযোগিতা মূলক পণ্যমান ও উৎপাদন মূল্য নিশ্চিত করা যায়।

৪। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাঃ- বাংলাদেশে খাস ও রাষ্ট্রীয় মালিকানার ভূমি,বন, জলাশয়, খনিজ ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদ; রেল, সড়ক, বন্দর প্রভৃতি অবকাঠামো; পানি, গ্যাস, জ্বালানি, বিদ্যুত, টেলি যোগাযোগ ইত্যাদি ইউটিলিটিস; রাষ্ট্রীয় মালিকানার শিল্প, বাণিজ্য, ব্যাঙ্ক,পরিবহন ও সেবা প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়। প্রকৃত রূপে রাষ্ট্রীয় আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে সর্বত্র ও সর্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা না থাকায় সকল ক্ষেত্রেই আধিপত্যবাদ, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। এবং অর্থব্যবস্থায় শোষণ বঞ্চনা প্রবলভাবে প্রচলিত আছে।
বাংলাদেশে উপরোক্ত শ্রেণী ও ব্যবস্থা সমূহ পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তাই সংস্কার ও পরিবর্তন করতে খাত ও শ্রেণীগুলোর সাথে সমন্বয় যেমন প্রয়োজন তেমনি সর্বস্তরের জনগণের কর্ম সংস্থান মূলক অংশগ্রহন আবশ্যক। গণতান্ত্রিক ও স্থানীয় অর্থব্যবস্থার মাধ্যমে ৬০%, ২০%, ২০% মালিকানায় আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠান সমুহ প্রতিষ্ঠিত হলে পৃথকভাবে রাষ্ট্রীয়, ব্যক্তিগত ও কোম্পানি ব্যবস্থার অনেকটা পরিবর্তন হয়ে জাতীয় অর্থব্যবস্থার সৃষ্টি হবে।

স্থানীয় অর্থব্যবস্থার মাধ্যমে এক্ষণে যেসব প্রকল্প নেয়া যায়ঃ-

১। চাষী সমিতির মালিকানায় ধানকল স্থাপন এবং এসকল ধানকল হতে সরকারী ক্রয়ের ব্যবস্থা নেয়া।
২। দুধ উৎপাদক সমিতির মালিকানায় পাস্তুরাইজেশন, প্যাকেজিং ও বাজারজাত করা।
৩। জেলে সমিতির মালিকানায় ট্রলার,জাল,মাছ সংরক্ষণ ও বাজারজাত করা।
৪। চাষীদের মালিকানায় আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, আনারস ইত্যাদি ফল প্রোসেসিং, সংরক্ষণ ও বাজারজাত করা।
৫। চাষীদের মালিকানায় টমাটো সহ অন্যান্য সবজী প্রসেসিং, সংরক্ষণ ও বাজারজাত করা।
৬। তাঁতীদের মালিকানায় তাত স্থাপন, সুতা ও কাপড় উৎপাদন এবং বাজারজাত করা। ইত্যাদি।