ত্রাতাবাদ ও বাংলাদেশের গণতন্ত্র

গ্রুপ ক্যাপ্টেন ফজলুল হক
Published : 28 August 2011, 08:48 AM
Updated : 28 August 2011, 08:48 AM

মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে ত্রাতাবাদের উপস্থিতি বহু প্রাচীন। নীল, জর্ডান, ইউফ্রেটিস, তাইগ্রিস নদীগুলোর অববাহিকা অঞ্চলের সংস্কৃতি, বিশেষ করে ধর্মীয় সংস্কৃতিতে একজন ত্রাতার আবির্ভাবের ভবিষ্যত বাণীর প্রচলন বেশ স্পস্ট। উক্ত অঞ্চলের সমাজ ব্যবস্থায় দাসত্ব প্রথা হয়তো তার প্রধান কারণ। বিজয়ী গোত্র বা রাজারা যুদ্ধে পরাজিত গোত্রের মানুষদের দাস হিসেবে ব্যবহার ও অত্যাচার নিপীড়ন করতো। দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ গোত্রের মানুষেরা মুক্তির জন্য তাদের মধ্যে একজন মুক্তিদাতা ত্রাতার আবির্ভাবের অপেক্ষায় থাকতো। ফেরাউনদের থেকে মুক্তির জন্য মুসা নবী, রোমানদের শাসন শোষণ থেকে মুক্তির জন্য যিশুর আগমন এবং তারও পূর্বে বনি-ইস্রায়েলদের পূর্ব পুরুষদের মাঝে বহু নবীর আগমন ও নবীদের দ্বারা তাদের মুক্তি সাধনের প্রতি বিশ্বাস ছিল প্রচলিত ধর্মীয় সংস্কার। তবে মুহম্মদকে (দঃ) খাতামান্নবী বা শেষ নবী ঘোষণা করায় মানবত্রাতা হিসেবে নবীদের আগমনের অবসান হয়।

ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে মানবমুক্তি বা ত্রাতাবাদের উপস্থিতি ঠিক ধর্মীয় সংস্কৃতির মত গোত্রনির্ভর বা বংশীয় নয়। বৈদিক ধর্মীয় সংস্কৃতিতে সুর,অসুর; দেবতা, দৈত্য; মানব, দানব ইত্যাদির ধারণা প্রচলিত। মর্তের মানুষেরা যখন অসুর, দৈত্য, দানবদের অত্যাচার, নিপীড়নের কবলে পড়ে; তখন স্বর্গরাজ্য থেকে সুর বা দেবগণ মর্তে এসে অসুর ও দানবদের পরাজিত ও শান্তি স্থাপন করে পুনরায় স্বর্গে ফিরে যান। রাম, কৃষ্ণ ত্রাণকারী অবতার এবং এই বিশ্বাস থেকে সর্ব বিপদ ত্রাতা হিসেবে মা দুর্গার পুজা করা হয়।

উক্ত দুটো দর্শনের মাঝে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও মৌলিক দর্শন হলো নবী বা দেবতার মানব ত্রাতার ভূমিকা গ্রহন এবং মানব সমাজের সংস্কার বা মুক্তিদান। এখানে জনগণের ভূমিকা স্বীকার্য নয়। ত্রাতাবাদ ও গণতন্ত্রের মৌলিক দ্বন্দ এখানেই। গণতন্ত্রের দর্শন হলো মানবমুক্তি বা সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন জনগণের দায়িত্ব ও তা জনগণের দ্বারা সম্পাদিত হয়। সেখানে ত্রাতাবাদের দর্শন হলো মানবমুক্তি বা সমাজ সংস্কারের জন্য ত্রাতা হিসেবে কেউ একজনের অবতীর্ণ হওয়া। জনগণের ভূমিকা সেখানে নির্দেশ ও কতৃত্ব মান্যকারী। গণতন্ত্রে জনগণ কর্তা ও কর্তৃত্বকারী।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ধারণায় জনগণের ভূমিকা ত্রাতাবাদের বিশ্বাসে আচ্ছন্ন। নবী, দেবতা তথা ত্রাতার ভূমিকায় সমাজের বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি ও শ্রেণী খুবই প্রবল। তারা তাদের অবস্থান শক্তিশালী রাখতে জীবিত অথবা প্রয়াত নেতাদের স্ব-আরোপিত প্রতিনিধিত্ব ঘোষণা করেন এবং নানা অতিকথন ও প্রচারের ( অপপ্রচার) মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করেন। ঠিক যেমনটা করতো প্রাচীন রাজা বাদশাহ খলিফাগণ; তারা নিজদেরকে অবতার বা ধর্মীয় নেতাদের শিষ্য হিসেবে প্রচার করতো।বর্তমান রাজনীতিবিদদের অধিকাংশকে কোন না কোন নেতার অনুসারী হিসেবে প্রচার করতে দেখা যায়। জনগণকে রাজনৈতিক কতৃত্ব থেকে বঞ্চিত করাই এর উদ্দেশ্য। তাদের মতে জনগণের ভূমিকা হবে নির্দেশ মান্যকারী (ভোটদাতা) এবং নেতারা রাষ্ট্র পরিচালনার নামে জনগণকে শাসন শোষণ করবেন— যেটা তাদের সংজ্ঞানুযায়ী গণতন্ত্র। এই ত্রাতাবাদী ব্যবস্থা গণতন্ত্র হতে পারে না।

কোন প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃত্ব দেয়া আর ত্রাতাবাদ এক নয়। সবার মতামতের ভিত্তিতে নেতৃত্বদান আর নিজকে বা অন্য কাউকে সর্ববিপদ ত্রাতার আসনে বসানো এক নয়। গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে জনগণের মতামত ও কতৃত্ব রক্ষা হয়; আর ত্রাতাবাদে জনগণকে একজনের কতৃত্বে অন্ধ সমর্থন করতে হয়। ত্রাতাবাদে নেতা হন সর্বময় ক্ষমতাধারী একনায়ক এবং জনগণের অবস্থান হয় অনুগত ব্যক্তি পুজারী যা স্বাধীন চেতনা পরিপন্থী।

রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে সোসিও-পলিটিকাল ক্ষমতা এবং সোসিও-ইকোনমিক ক্ষমতার গণতন্ত্রায়ন করে জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। সোসিও-পলিটিকাল ক্ষমতার গণতন্ত্রায়ন করতে সংসদ, নির্বাহী, বিচার ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্র ক্ষমতার বিকেন্দ্রায়ন করে জনগণের অংশগ্রহন নিশ্চিত করতে হবে। এবং সোসিও-ইকোনমিক ক্ষমতার গণতন্ত্রায়ন করতে বাজেট, উন্নয়ন পরিকল্পনা, কর,শুল্ক, রাজস্ব ব্যবস্থার বিকেন্দ্রায়ন করে অর্থ ব্যবস্থার উপর জনগণের কতৃত্ব স্থাপন করতে হবে। ত্রাতাবাদের সর্বময় কতৃত্ব নয়; সৎ ও মহান নেতা সব করে দেবেন এই অন্ধ বিশ্বাস নয়; গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র জনগণের কতৃত্ব স্থাপন।