প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প কেন আবার নির্বাচিত হবেন

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 29 Jan 2012, 04:32 AM
Updated : 26 August 2020, 09:26 AM

ডনাল্ড ট্রাম্প হলেন গত একশ বছরের মার্কিন ইতিহাসে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে ব্যর্থ প্রেসিডেন্ট। ২০১৬ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমেরিকাকে আবার মহান রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলবেন বলে বলেছিলেন, তার কিছুই তিনি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। উপরন্তু করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলায় তার চূড়ান্ত ব্যর্থতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিক্ষিপ্ত করেছে এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কটের মাঝে।

স্বাস্থ্যখাতে বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রসর দাবিদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত মারা গেছেন প্রায় দুই লক্ষের মতো মানুষ। জানুয়ারির শেষ দিকে সংখ্যাটা পৌঁছাবে তিন লক্ষে। দেশটিতে চাকুরি হারিয়ে বহু মানুষ আজ দিশেহারা। যাদের চাকুরি আছে, তাদের মধ্যে আবার অনেকের বেতন হ্রাস করা হয়েছে—যা কিনা তাদেরকে ঠেলে দিয়েছে চরম দরিদ্র অবস্থানে।

ট্রাম্পের চার বছর সময়কালে একদিকে যেমন বিস্তার লাভ করেছে বর্ণ বৈষম্যবাদ, তেমনি বন্ধ হয়নি পুলিশ কর্তৃক বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড। এ সমস্ত হত্যাকাণ্ডের অসমানুপাতিক হারে বড় শিকার হলেন কৃষ্ণাঙ্গসহ অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী। ওয়াশিংটন পোষ্টের হিসাব অনুযায়ী শুধু ২০১৯ সালেই বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৯৯৩ জন।

এমন পরিস্থিতিতে ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ৫৯তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এমতাবস্থায়, একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো প্রেসিডেন্টের পক্ষে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া অনেকটাই অসম্ভব। ফলে, অনেকেই ভাবতে শুরু করেছেন নির্বাচনে হয়ত ট্রাম্পের শোচনীয় পরাজয় ঘটবে। কিন্তু আসলেই কি বিষয়টা তাই?

ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মনোনয়ন দিয়েছে রাজনৈতিক ভাবে দুর্বল, প্রায় ৭৮ বছর বয়সী জো বাইডেনকে। শারীরিক ভাবেও তিনি কিছুটা অসুস্থ্য। তার দুইবার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার হয়েছে। ১৯৭২ সাথে গাড়ি দুর্ঘটনায় তিনি তার ৩০ বছর বয়সী স্ত্রী এবং ১৩ বছর বয়সী কন্যাকে হারান। ২০১৫ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তার এক পুত্র সন্তান মারা যায়।

এসব ঘটনায় মানসিক ভাবেও বাইডেন কিছুটা বিপর্যস্ত। এক পর্যায়ে তিনি রাজনীতি থেকে দূরে থাকবেন এমনও ভেবেছিলেন। তদুপরি, এ বছরের মার্চে টারা রীড নামে একজন নারী অভিযোগ আনেন যে, ১৯৯৩ সালে সিনেটর থাকাকালীন সময়ে বাইডেন তাকে যৌন হেনস্থা করেছেন। অবশ্য একাধিক যৌন হেনস্থার অভিযোগ রয়েছে ট্রাম্পের বিরুদ্ধেও।

বাইডেন তার রানিং মেট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসাবে বেছে নিয়েছেন ভারতীয়-আমেরিকান এবং মধ্যপন্থী হিসাবে পরিচিত কমলা হ্যারিসকে—যদিও বড় দাগে তিনি আসলে ডানপন্থারই সমর্থক। কমলা অবশ্য নিজেকে কৃষ্ণাঙ্গ বলে পরিচয় দিতেই পছন্দ করেন, তার বাবা কৃষ্ণাঙ্গ হবার কারণে। ১ শতাংশ ভারতীয় জনগোষ্ঠীর চেয়ে বর্ণগত ভাবে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ, জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে নিজের পরিচতি তুলে ধরতে পারাটা রাজনৈতিক ভাবেও সুবিধাজনক। কমলার বয়স যখন সাত বছর তখন তার বাবার সাথে মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে। এরপরে তিনি মায়ের কাছেই বড় হয়েছেন।

খ্রিস্টিয় মূল্যবোধ প্রভাবিত মার্কিন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এখনো কোনো নারীকে প্রেসিডেন্ট হবার যোগ্য মনে করেনি। মার্কিন ইতিহাসে ভিক্টোরিয়া উডহল হলেন প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। ১৮৭২ সালে নারীরা ভোটাধিকার পাবার অনেক আগেই প্রতিবাদী প্রার্থী হিসাবে নতুন গঠিত সমঅধিকার দল থেকে তিনি প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়িয়ে যান। তার এ সিদ্ধান্তে রক্ষণশীল মার্কিন সমাজ নড়েচড়ে বসে। "অশালীনতা" ছড়ানোর অভিযোগে নির্বাচনের কয়েক দিন পূর্বে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

মূলধারার কোনো দল নারীকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দিতে সময় নেয় ২০১৬ সাল পর্যন্ত। ওই বছর হিলারী ক্লিনটন ডেমোক্র্যাটিক পার্টি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং পরাজিত হন। অথচ গত শতাব্দীর ষাটের দশকে শ্রীলঙ্কার শ্রিমাভো বন্দরনায়েক, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী এবং ইসরায়েলর গোল্ডামায়ার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সে সমস্ত দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এমনকি পাকিস্তান, বাংলাদেশ, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলিম প্রধান দেশগুলিতেও নারীরা প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন বা করছেন।

নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর মতো, যারাই রানিং মেট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসাবে নারীদের বেছে নিয়েছিলেন, তারাও সবাই পরাজিত হয়েছেন। কমলা হ্যারিসের পূর্বে মার্কিন ইতিহাসে মাত্র দুইজন নারী মূলধারার দল থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছেন। ১৯৮৪ সালে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ওয়াল্টার ম্যান্ডেল প্রথমবারের মতো সবাইকে চমকে দিয়ে কংগ্রেসওম্যান জেরালডিং ফেরারোকে তার রানিং মেট হিসাবে ঘোষণা করেন। এরপর ২০০৮ সালে রিপাবলিকান পার্টির সিনেটর জন ম্যাককেইনের রানিং মেট হিসাবে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আলাস্কার গভর্নর সারাহ পলিন।

রানিং মেট হিসাবে জো বাইডেন বেছে নিয়েছেন ডানপন্থী চিন্তাধারার কমলা হ্যারিসকে। ডেমোক্র্যাটিক নেতৃত্ব দলের মধ্যে বাম চিন্তাধারার উত্থান নিয়ে চিন্তিত। একটি পুঁজিবাদী রাজনৈতিক দলের মাঝে বাম চিন্তাধারার লোকজনের এত ব্যাপক সমাবেশ কিভাবে ঘটছ, এ বিষয়টা তাদেরকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে।

প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায় বার্নি স্যান্ডার্স সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে খুব শক্তিশালী প্রার্থী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাকে যেকোনো মূল্যে ঠেকানো ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জন্য জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জন্মসূত্রে ইহুদী বার্নির সমাজতান্ত্রিক পরিচয় ছাড়াও আরেকটি পরিচয় হল, তিনি ধর্মে বিশ্বাস করেন না।

মার্কিন নির্বাচনে ধর্ম একটা বড় নিয়ামক। এ পর্যন্ত নির্বাচিত সকল প্রেসিডেন্টই মূলধারার খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। ২০১২ সালে মর্মন ধারার খ্রিস্টান মিট রমনি রিপাবলিকান দল থেকে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছিলেন। সব ঘরানার মুসলিমরা যেমন আহমদিয়া জামায়াত বা কাদিয়ানীদের মুসলমান মনে করেন না; তেমনি, খ্রিস্টানরা লেটার ডে সেইন্টস বা মর্মনদের খ্রিস্টান মনে করেন না।

টমাস জেফারসন, আব্রাহাম লিঙ্কন এবং উইলিয়াম হাওয়ার্ড টাফট নাস্তিক ছিলেন বলে অনেক মনে করেন। তবে মার্কিন রাজনীতির বাস্তবতার কারণে প্রকাশ্যে তারা তাদের ধর্ম বিশ্বাসের বিষয়টা উল্লেখ করেননি। বস্তুত এ কারণে বার্নিও নিজেকে নাস্তিক না বলে প্রচলিত বা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ধর্মে বিশ্বাস করেন না, এভাবেই তার ধর্ম বিশ্বাস তুলে ধরেন। কিন্তু সমস্যা হয়েছে আরেক জায়গায়। সেটা হল, অন্য প্রেসিডেন্টদের ধর্ম বিশ্বাস যাই হোক, তাদের সবারই বেড়ে ওঠা খ্রিস্টান পরিবারে। অপরদিকে, ইহুদী পরিবারে বেড়ে উঠবার ফলে খ্রিস্টীয় মূল্যবোধ প্রভাবিত মার্কিন সংস্কৃতিতে বার্নি অনেকের জন্যই বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।

বার্নির বড় সমর্থক গোষ্ঠী, যারা বাম-প্রগতিশীল হিসাবে পরিচিত, তারা বাইডেনের মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে খুবই ক্ষুব্ধ। এদের কিছু ভোট নিঃসন্দেহে গ্রিন পার্টির প্রার্থী হাওয়ি হকিন্স এবং অ্যাঞ্জেলা ওয়াকারের বাক্সে যাবে, যদিও বার্নি ট্রাম্পকে পরাজিত করবার জন্য বাইডেনকেই ভোট দিতে বলছেন। এর বিপরীতে ট্রাম্প সমর্থকদের কোনো ভোট লিবেরাটেরিয়ান দলের নারী প্রার্থী, ক্লেমসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জো জোরগেনসন এবং তার রানিং মেট, স্পাইক কোহেনের বাক্সে যাবে না।

ভারতীয় আমেরিকানদের ভোটের সিংহভাগই পাবেন ট্রাম্প। ভারতীয়রা এখানে নিজস্ব সংস্কৃতি ধরে রেখে প্রভাবশালী শ্বেতাঙ্গ সংস্কৃতির সাথে মিশে যেতে পারঙ্গম। যার ফলে তাদের উন্নতিও ঘটেছে শণৈ শণৈ। ক্ষমতাকেন্দ্রের আশেপাশে থাকতেই তারা স্বাছন্দ্য বোধ করেন। ভারতীয়দের বড় অংশটি সযত্নে কৃষ্ণাঙ্গদের থেকে নিজেদেরকে দূরে রেখে শ্বেতাঙ্গদের নিজেদের পরম মিত্র ভাবতে পছন্দ করেন এবং বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের বিচার করেন। সবরকম বামপন্থী মতাদর্শ থেকেও তারা দূরত্ব বজায় রাখেন।

ভারতীয়সহ উপমহাদেশের অন্য অংশের "হিন্দুত্ববাদীদের" ভোটও পাবেন ট্রাম্প। এর মূল কারণ কাশ্মীর, চীন ইত্যাদি ইস্যুতে ট্রাম্পের শক্তভাবে মোদীর পাশে দাঁড়ানো। অপরদিকে কাশ্মীর, নাগরিকত্ব আইন ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করায় ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে তারা "হিন্দুত্ববাদের" জন্য বিপদজনক মনে করেন। যদিও ভারতীয় ভোট মাত্র ১ শতাংশের কিছু বেশি, কিন্তু যে কয়টি অঙ্গরাজ্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, সে সমস্ত রাজ্যে ভারতীয় আমেরিকানদের বড় অংশটি বাস করেন। ফলে তাদের ভোট নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে।

"হিন্দুত্ববাদীদের" বিপরীতে সবরকম "ইসলামপন্থীদের" ভোট পাবেন বাইডেন। দীর্ঘদিন ধরে "ইসলামপন্থীরা" আমেরিকার যে আনুকূল্য পেয়ে আসছিল ট্রাম্প ক্ষমতায় আসাতে তার অনেকটাই খর্ব হয়েছে। তাই তাদের পছন্দ বাইডেনকে। তারা আশা করছেন, বাইডেন ক্ষমতায় আসলে তারা আবার সেই "স্বর্ণযুগে" ফিরে যেতে পারবেন।

এদিকে ডেমোক্র্যাটরা মনে করছেন নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হবে। কারচুপি করে ট্রাম্পকে জিতিয়ে আনা হবে। এর কিছু আলামতও ইতোমধ্যে দেখা গেছে। পোস্টাল ভোট নিয়ে গোলমাল করার উদ্যোগ নিয়েছিল ট্রাম্প প্রশাসন—এ খবরও এসেছে মিডিয়াতে।

জো বাইডেন সম্প্রতি এক টকশোতে স্পষ্ট করে বলেছেন, ট্রাম্প এ নির্বাচন চুরি করতে যাচ্ছেন। অপরদিকে, ট্রাম্পও বলছেন, একমাত্র কারচুপির মাধ্যমেই তাকে পরাজিত করা সম্ভব। তিনি আশঙ্কা করছেন, আমেরিকার নির্বাচনী ইতিহাসে এটি হয়ত সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত নির্বাচন হবে। এ ধরনের আশঙ্কা কারণ হল, বাংলাদেশ বা ভারতের মতো কোনো একক কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভোট গ্রহণ করা হয় না।

বাংলাদেশে নির্বাচনে যেমন ভারতের হস্তক্ষেপ, এ ইস্যু নিয়ে খুব শোরগোল হয়—এদেশেও এটা শুরু হয়েছে। মার্কিন নির্বাচনের ইতিহাসে এ বিষয়টা আগে কখনো ছিল না। ট্রাম্প নির্বাচনে বিজয়ী হবার পর আনা হয় রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগ। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয় যে, তিনি রাশিয়ার হস্তক্ষেপে এবং সহায়তায় নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। এবার রাশিয়ার বিপরীতে ট্রাম্প এনেছেন গণচীনকে। তিনি বলতে চাচ্ছেন, গণচীন চায় বাইডেন জিতে আসুক। অপরদিকে, বাইডেন শিবির বলছে, রাশিয়া চেষ্টা করছে ট্রাম্পকে জিতিয়ে আনতে।

তবে আমার মনে হয়েছে, রাশিয়া এবং চীন, দুই দেশই চাচ্ছে ট্রাম্প জিতে আসুক। কেননা, ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকার মানে হচ্ছে আমেরিকা দুর্বল হওয়া আর আমেরিকা যত দুর্বল হবে, রাশিয়া এবং চীন তত লাভবান হবে। এদিকে ভারতের মোদী সরকারও চাচ্ছে ট্রাম্পই যাতে জয়লাভ করে। কেননা, বাইডেন নির্বাচিত হলে ভারতের নানা "হিন্দুত্ববাদী" প্রকল্প মার্কিন প্রশাসনের প্রশ্ন এবং সমালোচনার মুখোমুখি হতে পারে।

অপরদিকে, বাংলাদেশ সরকারের জন্যও সব দিক থেকে ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকলেই সুবিধা। ওবামা আমলের মতো গণতন্ত্র, মানবাধিকার, অধ্যাপক ইউনুস এসব বিষয় নিয়ে লেকচার ট্রাম্প আমলে বাংলাদেশ সরকারকে শুনতে হয়নি। আর এ বিষয়টাতেই ট্রাম্পকে নিয়ে মার্কিন স্টাবলিশমেন্টের সমস্যা।

মার্কিন রাজনীতিতে ট্রাম্পের ডান বা দক্ষিণপন্থা, বর্ণবাদী বা জেনোফোবিক (বিদেশী ভীতি) নীতি–এসব কোনো কিছু নিয়েই স্টাবলিশমেন্টের মাথা ব্যথা নেই। তারা যে বিষয়টা নিয়ে উদ্বিগ্ন সেটা হল, বিশ্ব রাজনীতিতে অপর দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ট্রাম্পের আগের সরকারগুলির মত মাথা ব্যথা না থাকা। ট্রাম্পের বিশ্ব রাজনীতি থেকে আমেরিকাকে ক্রমশ গুটিয়ে আনবার নীতির ফলে বিশ্বে আমেরিকার প্রভাব বজায় থাকবে কিনা, এ প্রশ্নে মার্কিন স্টাবলিশমেন্ট খুব উদ্বিগ্ন। বস্তুত এ কারণেই স্টাবলিশমেন্ট, এবং ফক্স বাদে সমস্ত মূলধারার মিডিয়া চাচ্ছে ট্রাম্প যাতে ক্ষমতা থেকে বিদায় হন।

সম্পূর্ণ বিপরীত ধারার ট্রাম্প এবং বার্নি–দু'জনেই স্টাবলিশমেন্টের কাছে অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। ট্রাম্প চাচ্ছেন বিশ্ব রাজনীতি থেকে আমেরিকাকে বিযুক্ত করে খ্রিস্ট ধর্মভিত্তিক, বর্ণবাদী, জেনোফোবিক আমেরিকার পুনুরুদ্ধার। অপরদিকে বার্নি চান, যে মৌলিক ভিত্তির উপর আমেরিকা দাঁড়িয়ে আছে, সেটাকেই উপড়ে ফেলে আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক রুপান্তর।

বার্নির সমাজতান্ত্রিক নীতির কারণে স্টাবলিশমেন্ট চাচ্ছিল না বার্নি ডেমোক্র্যাটিক দল থেকে মনোনয়ন পাক। তারা এ বিষয়টাতে সফল হয়েছে। বার্নিকে নির্বাচনী দৌড় থেকে সরিয়ে দেয়া গিয়েছে। এখন তারা চাচ্ছে ট্রাম্প যাতে আবার নির্বাচিত হয়ে না আসতে পারেন। এ জন্য নানা জরিপে দেখানো হচ্ছে এবং হবে, বাইডেন এগিয়ে রয়েছেন। মিডিয়া, চিন্তক গোষ্ঠী এবং স্টাবলিশমেন্টের বাধার মুখে দাঁড়িয়ে ২০১৬ সালে ট্রাম্প জিতে এসেছিলেন। কিন্তু এবারও তিনি জিতে আসতে পারবেন কি?

অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সব মিলিয়ে ট্রাম্প অত্যন্ত দুর্বল এবং ব্যর্থ একজন প্রার্থী। এত ব্যর্থতা নিয়ে কারো দ্বিতীয় মেয়াদে জিতে আসার কথা না। কিন্তু বাস্তবতা হল তার বিরুদ্ধে যিনি প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন সেই বাইডেনকে অনেকে ট্রাম্পের চেয়েও দুর্বল প্রার্থী হিসাবে মনে করেন। তদুপরি, একজন অশ্বেতাঙ্গ নারীকে রানিংমেট হিসাবে নেয়াটা মার্কিন সমাজের রক্ষণশীল এবং খ্রিস্টীয় মৌলবাদী অংশটি–যাদের বিশাল ভোট ব্যাঙ্ক রয়েছে তারা পছন্দ করছে না।

রিপাবলিকানদের মতো ডেমোক্র্যাটরাও সেই কর্পোরেট আমেরিকারই প্রতিনিধিত্ব করেন। অনেক সময় তারা সেটিকে নানা সুন্দর কথার মোড়কে আড়াল করবার চেষ্টা করেন। ফলে অনেক আমেরিকানের কাছে এ বিষয়টা প্রতীয়মান হয়েছে যে, ডেমোক্র্যটরা ক্ষমতায় আসলেও দেশের তেমন কোনো অর্থবহ পরিবর্তন আসছে না। এছাড়া ট্রাম্প এ ধারণাটা সমাজের একটা বড় অংশের মাঝে প্রোথিত করতে সমর্থ হয়েছেন যে, জনগণের করের ডলার বিশ্বের মোড়লগিরি করবার পিছনে ব্যয় করলে, তার মূল ভুক্তভোগী হন জনগণ।

ডেমোক্র্যাটদের অন্য দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সরকার পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো শুধু বাম শিবিরে নয়, ডান এবং দক্ষিণপন্থী শিবিরের অনেকেই পছন্দ করছেন না। তদুপরি, উদ্দীপনা প্যাকেজের অংশ হিসাবে দ্বিতীয়বারের মতো প্রত্যেক নাগরিককে এককালীন ১২০০ ডলার দেবার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, ডেমোক্র্যাটরা এর সাথে আরো নানা কিছু যুক্ত করবার ফলে, সে পরিকল্পনা আপাতত ভেস্তে গেছে। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে চাকুরি হারানো এবং বেতন কমে যাওয়া বহু মার্কিনি এ চেক না পাবার জন্য ডেমোক্র্যাটরা দায়ী বলে মনে করেন। এটিও আগামী নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের ভোট দেবার সিদ্ধান্তকে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করবে।

সিনিয়র বুশ হলেন এখন পর্যন্ত সর্বশেষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি ক্ষমতার দুই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। ১৯৯২ সালে নির্বাচনে তিনি বিল ক্লিন্টনের কাছে পরাজিত হন। ১৯৯২ এর পর থেকে আর কোনো ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকেই পরাজিত করা যায়নি। তার মানে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে গত আঠাশ বছরে মার্কিন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্ষমতাশীন প্রেসিডেন্টকে দুই মেয়াদে কাজ করবার সুযোগ দেবার একটা ট্র্যাডিশন দাঁড়িয়ে গেছে। তাই এ সমস্ত কিছু মিলে অস্বাভাবিক কিছু ঘটে না গেলে, ট্রাম্পই পরবর্তী চার বছরের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন।