শাহ এ এম এস কিবরিয়া স্মরণে

মোনায়েম সরকারমোনায়েম সরকার
Published : 28 Feb 2011, 06:11 AM
Updated : 27 Jan 2013, 07:41 AM

২৭ জানুয়ারি ২০০৫, রাত ৮টায় যখন সে দুঃসংবাদ এল, বিশ্বাসই হচ্ছিল না। কিবরিয়া সাহেবের তো হবিগঞ্জ থেকে ফিরে শুক্রবার সকালে আমাকে নিয়ে 'মৃদুভাষণ' পত্রিকার কভারের ডিজাইন ফাইনাল করার কথা। ৩১ জানুয়ারি সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভলপমেন্ট রিসার্চ আয়োজিত সেমিনারে 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সংস্কার' বিষয়ে মূল প্রবন্ধ পাঠ করবেন তিনি। বিভিন্ন পত্রিকায় এ নিয়ে সিরিয়াস লেখালেখি করছিলেন শামস কিবরিয়া। তাই প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানও চেয়ে নিয়ে এ বিষয়ে তাঁর একটি লেখা ছাপালেন তাঁর শেষযাত্রার আগের দিন।

আমি প্রস্তাব করেছিলাম, এ বিষয়ে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে একটি সেমিনার করার জন্য। তিনি রাজি হয়েছিলেন। তারপর সেমিনার পেপারও তৈরি করে ফেললেন। তাঁর মস্তিষ্ক খুব সক্রিয় ছিল। ওই বয়সেও দ্রুত লিখতে পারতেন। তাঁর ইংরেজি লেখা ছিল চমৎকার। সারাজীবন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে ইংরেজি ভাষায় লিখতেন। অভ্যাসমতো তিনি ওই সেমিনার পেপারটিও বাংলা ও ইংরেজিতে দু'ভাষাতেই তৈরি করেছিলেন। ফোনে তাঁর সঙ্গে সেমিনারের প্রস্তুতি নিয়ে কথা হয়েছিল। কিন্তু সিরডাপ মিলনায়তনে ৩১ জানুয়ারি ওই সেমিনারটি আমাদের আর করা হল না। এর আগেই চিরবিদায় নিলেন শামস কিবরিয়া।

১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভলপমেন্ট রিসার্চ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো শাহ এ এম এস কিবরিয়ার নেতৃত্বেই। তাঁর ইচ্ছায় আমি ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক পদের দায়িত্ব নিই। ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার ১০ বছরে অসংখ্য সেমিনার করেছি তাঁর নেতৃত্বে। মনোগ্রাফ, পুস্তক-পুস্তিকাসহ পঁচিশটি বই প্রকাশিত হয়েছে ফাউন্ডেশন থেকে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ওপর ২২ পর্বের সিডি-ডিভিডি নির্মিত হয়েছে। শামস কিবরিয়ার উৎসাহ ও প্রেরণায় বঙ্গবন্ধুর জীবনীগ্রন্থ প্রকল্পের পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজও সম্পন্ন করেছিলাম আমরা। বাংলা একাডেমির সঙ্গে চুক্তি মোতাবেক দেরিতে হলেও একাডেমি ২০০৮ সালের বইমেলায় তা প্রকাশ করেছিল। বইটির মুদ্রিত ৩,৫০০ কপি ইতোমধ্যে বিক্রি শেষ হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (প্রতিরোধ শিবির, মুজিবনগর সরকার ও শরণার্থী শিবিরের) ওপর তিনটি থিমেটিক ম্যাপ, আরও কত কী! কত স্মৃতি, কত কথা! ভাবতে গেলে এ বয়সেও বারবার শিশুর মতো কেঁদে উঠি।

সফল আমলাজীবন শেষে, ১৯৯১ সালে তাঁর আওয়ামী লীগে যোগদানের পেছনে আমারও বিশেষ ভূমিকা ছিল। শেখ হাসিনা তাঁকে দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য করতে দ্বিধা করেননি। তিনি সভানেত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা পদের দায়িত্বে আসীন হন তাঁর মেধা ও প্রজ্ঞার গুণে। ১৯৯৬ ও ২০০১-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরিচালনায় দলের পক্ষ থেকে মেধা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে আমিও নির্বাচন-পরিচালনা কাজে যুক্ত ছিলাম। সে সময় রাষ্ট্রপতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে অধিকাংশ সাক্ষাৎ-অনুষ্ঠানে তাঁর নেতৃত্বেই আমরা গিয়েছি। প্রেস মিট করেছি কতবার। দেখেছি তাঁর বুদ্ধিমত্তা, ধৈর্য, বলার ও বোঝানোর ক্ষমতা। ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে এসে আওয়ামী লীগ তাঁকে অর্থমন্ত্রী বানিয়ে যে ভুল করেনি, গোটা জাতি তা এখন স্বীকার করে। আমি অর্থনীতি ভালো বুঝি না। কিন্তু কিবরিয়া ভাই যখন বলতেন, পার্লামেন্টে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতেন কিংবা মৃদুভাষণে বসে বিভুরঞ্জন বা হাসান মামুনকে ব্রিফ করতেন- আমার কাছে তা খুব সহজবোধ্য মনে হত।

মৃদুভাষণ বের করার সময় তিনি আমার ওপরই নির্ভর করলেন বেশি। বললেন- যাদের নেয়া হল, আপনিই তো তাদের ভালো করে চেনেন। আমি হয়তো কাজের মধ্য দিয়ে চিনব। তিনি অল্পদিনেই তাদের চিনলেন, তাদের যোগ্যতায় আস্থা রাখলেন। মৃদুভাষণ অফিসে এলে প্রায়ই আমাকে যেতে বলতেন। বিদেশে গেলে বলতেন, আপনি সব দেখবেন। নিজের চেয়ার দেখিয়ে বলতেন, আপনি এখানে বসবেন। আমি জানি, অমন মর্মান্তিকভাবে তাঁকে হারিয়ে মৃদুভাষণ পরিবার কতটা বেদনার্ত। প্রিয় সম্পাদককে নিয়েই এখন তাদের লিখতে হচ্ছে। আর আমাকে ২০০৫ সালের ৩১ তারিখের সেমিনারটি বাতিল ঘোষণা করে পত্রিকায় প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়েছিল।

কিবরিয়া ভাইয়ের শরীর ভালো যাচ্ছিল না। দেশে ও বিদেশে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। আমাদের উৎকণ্ঠা ছিল। আবারও নির্বাচনে দাঁড়ানোর দৃঢ় ইচ্ছা ছিল তাঁর। আমি কিবরিয়া ভাইকে বলেছিলাম, নির্বাচন না করে '৯৬ সালের মতো অর্থমন্ত্রী হতে পারেন। তিনি বলেছিলেন, 'সরকার সাহেব, এমপি না হয়ে মন্ত্রী হলে অন্যেরা করুণার দৃষ্টিতে দেখে।' আমি বলেছিলাম, ২০০১ সালে তো নির্বাচন করে এমপি হয়েছেন।

দেশ নিয়ে, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর মধ্যে গভীর উৎকণ্ঠা ছিল। তিনি বলতেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় সংস্কার না হলে জনগণ চাইলেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পারবে না। হরতালে তাঁর ব্যক্তিগত আপত্তি ছিল, তারপরও তিনি বলতেন- ওরা যা করছে তাতে হরতাল ছাড়া করবেনটা কী। বেগম জিয়ার সরকারকে তিনি বলতেন, 'টেফ্লন সরকার।' বলতেন, এর গায়ে কোনো কিছুই যেনো লাগছে না, সব পিছলে যাচ্ছে।

দেশে মৌলবাদী উত্থানের শঙ্কা তাঁর মনে ছিল পুরোপুরি। বলতেন, মোনায়েম সাহেব, আপনি তো গ্রামে যান না। তাই বুঝতে পারছেন না, ভেতরে ভেতরে কী সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। গ্রামগঞ্জে সন্ত্রাসী মৌলবাদীরা মসজিদ ও মাদ্রাসাভিত্তিক ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। ক্ষমতায় গেলেও আমরা এই নেতিবাচক পরিবর্তনের ধারা ঠেকাতে পারব কিনা কে জানে। মাঝে মাঝে খুব হতাশও হয়ে পড়তেন। বলতেন, চলেন দেশ-টেশ ছেড়ে চলে যাই। ওরাই থাকুক এদেশে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা হামলায় কিবরিয়া ভাইয়ের সতর্কবাণীর কথা স্মরণ হয়েছিল।

এসবই বলতেন, কিন্তু তাঁর কাজকর্মে হতাশার কোনো ছাপ দেখতাম না। দারুণ প্রত্যয়ী হয়ে তিনি লিখতেন, বক্তৃতা করতেন। হবিগঞ্জে জীবনের শেষ যে বক্তৃতা করেছেন, তাতেও রয়েছে সে প্রত্যয়ী মনোভাব। 'বাংলাদেশের সামাজিক বিবর্তন কি পশ্চাতমুখী?' শিরোনামে তাঁর শেষ যে অসমাপ্ত লেখাটি পাওয়া গেছে, তা পড়লে তাঁর উৎকণ্ঠার কথা বোঝা যায়। মৃদুভাষণ লিখেছে- 'উদ্বিগ্ন মানুষের পাশে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁকে বেশিদিন দাঁড়িয়ে থাকতে দেয়া হল না।'

কিন্তু দেখতে তো পাচ্ছি, শামস কিবরিয়ার মৃত্যু গোটা জাতিকেই কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বিদেশেও এর তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁর মতো একজন সজ্জন মানুষকে যদি এভাবে হত্যা করা হয়, তাহলে এদেশে কে নিরাপদ? দেশের ভবিষ্যৎই বা কী? কে একজন যেন বললেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার চেয়েও বেশি প্রতিক্রিয়া ও সহানুভূতির জন্ম দিয়েছে কিবরিয়া-হত্যাকাণ্ড। তাঁর নৃশংস হত্যাকাণ্ডে উদ্বেলিত হয়েছে জাতি ও বিশ্ব জনমত। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেমে এসেছিলেন রাস্তায়। সরব প্রতিবাদও জানানো হচ্ছে একের পর এক হরতাল করে। দেশের বিশিষ্টজনেরাও প্রতিবাদে মুখর হযেছিলেন। শাহ এ এম এস কিবরিয়ার মতো মানুষের হত্যাকাণ্ডে তাঁরা বুঝতে পারছেন দেশ কোনদিকে যাচ্ছে।

মেধাবী ছাত্র, রাষ্ট্রদূত, পররাষ্ট্র সচিব, অর্থনীতিবিদ, সাবেক অর্থমন্ত্রী এসব অভিধা ছাড়িয়ে তিনি একজন প্রাজ্ঞ দেশপ্রেমিক রাজনীতিক ও দার্শনিক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তাই মানুষের শোকে-অশ্রুতে মহীয়ান হয়ে উঠেছে কিবরিয়া ভাইয়ের আত্মদান। আমরা তাঁর প্রিয়জনেরাও শোক ভুলে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হওয়ার অবকাশ পাচ্ছি যেন।

কিবরিয়া পরিবারের সদস্য বিশেষ করে আসমা ভাবী, ড. রেজা ও ড. নাজলী শোককে শক্তিতে পরিণত করে দেশে-বিদেশে যে সাহসী প্রতিবাদী ভূমিকা রাখছেন- তা কিবরিয়া ভাইয়ের আপসহীন সংগ্রামী ভূমিকারই প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। তাঁর স্মরণে দেশে-বিদেশে শোকসভা, প্রতিবাদসভা, সমাবেশ, মিছিল, হরতাল, মৌনমিছিল, রক্তের অক্ষরে স্বপথের সাক্ষর অভিযানে লক্ষ লক্ষ সাক্ষর সংগৃহীত হয়েছে। সর্বোপরি, দেশে-বিদেশে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সংবাদমাধ্যমে সাংবাদিক, কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবীরা যেসব সম্পাদকীয়, প্রবন্ধ ও নিবন্ধ লিখেছেন এর সংখ্যা আমার সংগ্রহেই রয়েছে দু'শতাধিক। ২৭ জানুয়ারি ২০০৬ সালে শামস কিবরিয়ার ওপর আমার সম্পাদনায় স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

বায়ান্নয় শহীদদের রক্ত প্রতিষ্ঠা করেছিল মাতৃভাষার মর্যাদা। মতিউর-আসাদের রক্ত স্বাধিকার আন্দোলনকে করেছিল বেগবান। বঙ্গবন্ধু-হত্যা, জেলহত্যার মাধ্যমে স্বাধীনতার ধারাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা হচ্ছিল। নূর হোসেন-ডা. মিলনের মৃত্যু গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি করেছিল। ২০০৫-এর সূচনায় প্রিয় কিবরিয়া ভাইয়ের মৃত্যু, ক্ষণজন্মা কিবরিয়ার আত্মদান জাতিকে স্বাধীনতার মূলধারায় অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে পুনঃস্থাপনে শক্তি যোগাবে- এ বিশ্বাসই এখন আমাদের পথ দেখাচ্ছে। কিবরিয়া ভাইয়ের আদর্শ আমাদের নিরন্তর প্রেরণার উৎস হয়ে থাকুক।

মোনায়েম সরকার : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও রাজনৈতিক কর্মী।