নারী নিপীড়কদের মুখোশ উন্মোচন করুন ফেসবুকে

ফিরোজ মিয়াজী
Published : 29 March 2018, 03:34 AM
Updated : 29 March 2018, 03:34 AM

বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ মানুষের সহজাত ধর্ম। এটা খোদা প্রদত্ত। এই আকর্ষণ যার মাঝে নেই তার ডাক্তার দেখানো উচিত। সমাজে চলতে ফিরতে আমরা এই আকর্ষণের কিছু স্বাভাবিক নমুনা দেখতে পাই। বাসের সীটে একজন বুড়ো মানুষকে বসতে দেয়ার চেয়ে একজন যুবতী নারীকে বসতে দিতে বেশি আগ্রহী হই আমরা অনেক সময়। এটা সেই আকর্ষণের দরুণই হয়ে থাকে। দেখতে খারাপ হলেও এটা অন্যায় নয়। এই আকর্ষণ ছাড়াও নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানের কারণে আমরা বয়স্ক পুরুষটির আগে বয়স্ক নারীটিকে সবসময় অগ্রাধিকার দেই। চলতে ফিরতে এমন অহরহ চিত্র যখন দেখি, তখন ভাবি আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের সিংহভাগ উপাদানের অবক্ষয় ঘটলেও নারীর প্রতি পুরুষের এই সম্মানটা এখনো অতটা ক্ষয়ে যায়নি।

কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা আমার সেই ভাবনা আর বিশ্বাসকে অনেকটাই নড়বড়ে করে দিয়েছে। নারী হেনস্তার এই ভয়াবহ ঘটনাগুলো এত ব্যাপকভাবে আগে দেখা যায়নি। ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত দুটি হচ্ছে- গত ৭ মার্চ একটি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের দ্বারা রাস্তায় কয়েকজন নারীকে হেনস্তা এবং গত শুক্রবার রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার চাঁদনী চক মার্কেটে ইডেন কলেজের তিনজন ছাত্রী ও তাদের দুই আত্মীয়াকে দোকান-কর্মচারী কর্তৃক হেনস্তার ঘটনা।

চাঁদনী চকের ঘটনাটি প্রথম জানতে পারি ভুক্তভোগী এক ছাত্রীর ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে। ঘটনাটি পড়ে পুরো স্তম্ভিত হয়ে যাই। কোনো কারণ ছাড়া নারীদের সাথে এমন নিকৃষ্ট আচরণও করতে পারে মানুষ? মেয়েটির স্ট্যাটাসের কিছু অংশ না পড়লে আসলে ঘটনার ভয়াবহতা সম্পর্কে আন্দাজ করা কঠিন হবে। মেয়েটির স্ট্যাটাসের কিছু অংশ ছিলো এমন-

"…..সময়টা ছিল আজ বিকেল বেলা, চাঁদনী চক মার্কেটের সামনে। একেবারে রাস্তার পাশেই এই দোকানটা। আমি, আমার দুই ফ্রেন্ড, আম্মু আর আমার দুইটা খালামনি মিলে গাউসিয়াতে শপিং করতে গিয়েছিলাম। অনেক অনেক ভীড় ছিল। ভীড়ে আমি আর আমার ফ্রেন্ড আম্মুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। আম্মু আর খালামনিরা এই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে কল দিয়ে বলে- রাস্তার পাশের দোকানের সামনে আছে তারা। এখানে উল্লেখ্য- দোকানে কোনো কাস্টমারই ছিল না। আর উনারা কাস্টমারের প্রবেশপথে দাঁড়ায়নি, পিলার ঘেষে দাঁড়িয়েছিলো। অনেকক্ষণ খোঁজার পর আমরা তাদের পেলাম দোকানের সামনে। আমরা উনাদের নিয়ে মার্কেটের ভেতরে ঢুকবো এমন সময়ে ভেতর থেকে দোকানের এক কর্মচারি বলল- মাইয়া মানুষ জাগায় জাগায় দাঁড়াইয়া রঙ্গলীলা করে, হুদাহুদি বোরকা পড়ে, রাস্তায় তো ঠিকই ***(প্রকাশের অযোগ্য) বাইর হয় (আমার আম্মু আর খালামনি বোরকা পড়া ছিল)! এটা শুনে দোকানের সব কর্মচারী সজোরে হেসে উঠল!

"আমি আম্মুকে বলি, শুনছো কি বলসে? এমন সময় ভিতরের এক কর্মচারি বলে- যান যান, দোকানের সামনে দাঁড়াইয়া আছেন, সরেন, কাস্টমার আইব জায়গা খালি করেন। আমি সে কর্মচারিকে বললাম- এভাবে কথা বলতেসেন কেন আপনি? কাস্টমারদের সাথে এভাবে কথা বলে? কর্মচারি জবাবে বলল- (প্রকাশ অযোগ্য) কাস্টমার আপনেরা, … । এ কথা শুনার পর আমি ক্ষেপে গিয়ে বললাম- একটা থাপ্পড় দিব! বেয়াদব! এভাবে কথা বলতেসেন কেন? লোকটা তখন বিশ্রি ভাষায় একটা গালি দিয়ে বলে তোরে থাপ্পড় দিমু। আমাগো দোকানের সামনে খাড়ায়ে ধমকি দেস। …."

মেয়েটি তার স্ট্যাসের শেষের দিকে লিখেছে, এক পর্যায়ে দোকানের কর্মচারিরা তাদের শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে পর্যন্ত হাত দিয়েছে। এসময় পাশে দাঁড়ানো লোকেরা এমনকি নারীরাও তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। উল্টো পুরুষের সাথে 'ঝামেলা করায়' তাদেরকেই দোষারোপ করেছে।

ইডেন পড়ুয়া তিন ছাত্রী ও তাদের আত্মীয়ের সাথে দোকানের কর্মচারিদের এমন অকল্পনীয় আচরণ আসলে বিশ্বাস করার মত না। আমার এক বড় আপা ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকলে হয়তো আমি মেয়েটির পুরো স্ট্যাটাস বিশ্বাসও করতাম না। আপার তথ্যমতে এই স্ট্যাটাসের এতটুকুও মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত নয়।

শুধু তাই নয়, সেদিন আমার আপার সাথেও খারাপ আচরণ করেছে সেখানকার আরেকটি দোকানের কর্মচারি। আপা আমার কাছে দোকান কর্মচারির আচরণের বর্ণনা দিতে গিয়ে এতটাই উত্তেজিত হলেন যে, বললেন, তখন যদি কোনো পুরুষ মানুষ আমার সাথে থাকতো তাহলে ঐ দোকান কর্মচারীর লাশ পড়ে যেতো!

গত ৭ মার্চের ঘটনাগুলোও আমরা সবাই জানি। সেদিন একটি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দলের মহাসমাবেশে যোগ দিতে যখন রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মিছিল নিয়ে যাচ্ছিলো, তখন তাদের দ্বারা বেশ কয়েকজন নারী হেনস্তার শিকার হয়। ভুক্তভোগী নারীরা প্রত্যেকেই সেদিন ফেসবুকে তাদের হ্যারাসমেন্টের বিবরণ দিয়েছিলেন। রাগে ক্ষোভে ভুক্তভোগী একজন তো ফেসবুকে লিখেছেন- 'যেই দেশে জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে মেয়ে মলেস্ট করে সে দেশে আমি থাকবো না'।

এছাড়া গত ২০ মার্চ নারী হেনস্তার এরকম আরেকটি ঘটনাও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। রাস্তা পার হওয়ার সময় জনৈক ব্যক্তি কর্তৃক ছোট বোনের যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঘটনা ফেসবুকে নিজের আইডিতে লিখেছেন বড় বোন। রাগ আর ক্ষোভ মিশ্রিত তার স্ট্যাটাসের শুরুটাই ছিলো 'এটা স্রেফ জানোয়ারের দেশ'।

উপরের সবগুলো ঘটনার একটি পজেটিভ দিক হলো ভুক্তভোগী কেউই মুখ বুজে নীরবে তাদের প্রতি করা অন্যায়কে সহ্য করেনি। তারা সবাই এটার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। তারা তাদের প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুককে। যেখানে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে হাজার হাজার প্রতিবাদকারী। তারা মুহুর্তেই ঘটনাগুলোকে ভাইরাল করেছে এবং ভুক্তভোগীদেরকে যুগিয়েছে সাহস।

চাঁদনি চকের ঘটনাটি ঘটে গত শুক্রবার। সেটাতে ভুক্তভোগী এক ছাত্রী মামলা করে শনিবার। সেদিনই দোকানের চার কর্মচারিকে পুলিশ গ্রেফতারও করে। আমি নিশ্চিত যে ভুক্তভোগী মেয়টি একদিন পরে থানায় গিয়ে মামলা করার সাহস পেয়েছে কেবলমাত্র ফেসবুকে বন্ধু ও শুভাকাঙ্খীরা সাহস যোগানোর কারণেই। আর পুলিশও তড়িত গতিতে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করেছে ঘটনাটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণেই।

৭ মার্চের ঘটনাটিও ফেসবুকের কল্যাণেই ছড়িয়েছে। ঘটনাগুলো এতটাই ভাইরাল হয়েছে যে স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এতে হস্তক্ষেপ করেছেন। তিনি বলেছেন, নারী হেনস্তার সিসিটিভি ফুটেজ তাদের হাতে পৌঁছেছে এবং অচিরেই অপরাধীদের গ্রেফতার করবেন। যদিও এরপর আর তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে কিনা তার কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

যৌন হয়ারনী করা সেই চার দোকান কর্মচারি (ভিডিও থেকে নেয়া)

এই দুটি ঘটনার ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি ফেসবুক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এমনকি ফেসবুকে না আসলে এই ঘটনাগুলো আমরা জানতেই পারতাম না। মামলা হতো না, অপরাধীরা গ্রেফতারও হতো না। আর ভুক্তভোগীদেরকে এই বেদনাদায়ক ঘটনাগুলো কুরে কুরে খেতো সারাটা জীবন।

কিন্তু কথা হলো, নারী হ্যারেশমেন্টের এমন অসংখ্য ঘটনা থেকে কতগুলো আমরা এভাবে জানতে পারছি? কতগুলো ঘটনা ভুক্তভোগীরা প্রকাশ করছে? সেটা কত শতাংশ হবে, এক শতাংশও কি হবে? এর জবাব পাওয়া যায় সর্বশেষ ঘটনাটি অর্থাৎ নিজের ছোট বোনের হ্যারাসমেন্ট নিয়ে যিনি ফেসবুকে লিখেছেন তার কাছ থেকে। নিজের ছোট বোনের হ্যারাসমেন্টের পোস্ট দেয়ার কয়েকদিন পর তিনি আরেকটি স্ট্যাটাসে লিখেছেন-

"আমি প্রচণ্ড অবাক হয়ে লক্ষ্য করছি এই হ্যারেসের পোস্ট দেয়ার পর হাজার হাজার মানুষ আমাকে টেক্সট করছে। সব আমি দেখার ফুসরতও পাচ্ছিনা! তাদের কেউ মেয়ে, কেউ ছেলে। তারা সবাই বলছে তাদের হ্যারাসমেন্ট হবার কথা, আর সেই সময় আর দশটা মানুষ এগিয়ে না এসে কিভাবে চুপচাপ দেখে মজা নিছে তার কথা। ছেলেরা বলছে তার বোন, তার ওয়াইফের হ্যারাসের কথা! কি লজ্জা,অপমান, আর কষ্টই না মেশানো ছিল তাদের কথায়!"

যেসব নারীরা তাদের প্রতি এমন হ্যারাসমেন্টকে অতি কষ্টে গোপন রেখেছেন- ভাবছেন, প্রকাশ করে কী লাভ হবে, কিংবা আপনি বিচার পাবেন না বা অপরাধীরা অনেক ক্ষমতাবান- তাদেরকে বলবো, ফেসবুকে উন্মোচন করুন সেই অমানুষদের মুখোশ। দেখবেন আপনার পাশে এত এত মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে যে তা সেই ক্ষমতাবানদের ক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। বনানীর ধর্ষণকাণ্ডের হোতারা কিন্তু কম ক্ষমতাবান ছিলো না। তারাও কিন্তু রেহাই পায়নি আইনের হাত থেকে।

আপনি যদি ভাবেন যে, নিজের সম্মান, আব্রু রক্ষার্থেই নিজের হ্যারাসমেন্ট বা যৌন নিপীড়নের কথা গোপন রাখবেন, তাহলে ভুল করবেন। বিশ্বাস করুন এই গোপন রাখাটা আপানার মনে কখনোই প্রশান্তি দেবে না। এই বেদনাদায়ক ব্যাপারটি সারা জীবন আপনাকে কুরে কুরে খাবে। আপনার এই গোপন রাখাটা সেই অপরাধীকে আরো অপরাধ করার প্রতি কেবল উৎসাহই যোগাবে।

এখনই সোচ্চার হোন সমাজের এসব কীটদের বিরুদ্ধে। বেশি কিছু নয়, আপনার স্মার্ট ফোনটিকে কাজে লাগান। অপরাধী কিংবা সেই স্থানের ছবি তুলুন। তার ন্যুনতম পরিচয় জানুন। পারলে মোবাইলের সাউন্ড রেকর্ডার অন করে রেখে গোপনে তাদের নোংরা কথাগুলো রেকর্ড করুন। সাথে সাথে প্রকাশ করুন ফেসবুকে। পুলিশকে জানান। ছবি তোলা সবসময় সম্ভব হবে না। পুরো ঘটনার বিবরণ, স্থান, দোকান বা প্রতিষ্ঠানের নাম, ব্যক্তির নাম যতটুকু সম্ভব কালেক্ট করে ফেসবুকে লিখুন। পরিচিত বন্ধুদেরকে শেয়ার করতে বলুন। এভাবেই ফেসবুককে বানিয়ে তুলুন প্রতিবাদের ডিজিটাল হাতিয়ার। অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচনের স্থান। ফেসবুক হয়ে উঠুক প্রতিবাদের আরেক ভার্চুয়াল প্রেসক্লাব।