বিলুপ্তপ্রায় বেদে সম্প্রদায় ও ডাকাতিয়া পাড়ের স্মৃতি

ফিরোজ মিয়াজী
Published : 23 June 2018, 07:06 AM
Updated : 23 June 2018, 07:06 AM

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে ডাকাতিয়ার অদূরেই আমাদের গ্রাম। ছোটবেলায় প্রাইমারিতে পড়ার সময় নদীর পাড় ধরে  স্কুলে যাওয়ার পথে সারিবাঁধা নৌকাগুলো দেখতে পেতাম। নৌকাগুলো নদীর পাড় থেকে একটু দূরে খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা থাকতো।

নৌকাগুলো কেবলই একটি নৌকা ছিল না, সেগুলো ছিলো একেকটি ঘর, একেকটি পরিবারের আশ্রয়স্থল। ওরা ভাসমান বেদে সম্প্রদায়। আমাদের এলাকায় ওদের বলে 'বাইদা'।

তখন দেখতাম বেদে মহিলারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ম্যালামাইন, সিরামিকস ও স্টিলের বাসন-কোসন বিক্রি করতো। এসব পণ্য টুকরিতে ভরে তারা মাথায় করে ফেরি করে বেড়াতো। এই টুকরিগুলোর অনেক ওজন ছিলো। বহন করতে কষ্টই হতো বেদে মহিলাদের।

তাদের কেউ বাড়ি বাড়ি গিয়ে সিংগা লাগাতো। সিংগা লাগানো হলো শরীরের কোনো অঙ্গের ব্যাথা দূর করার একটি পদ্ধতি। বেদেদের মতে, এই পদ্ধতিতে গরুর সিং বা তার মত কোনো বস্তুর দ্বারা ব্যাথার স্থানে ব্লেড দিয়ে দাগ কেটে বিষরক্ত টেনে বের করে আনা হয়।

তাদের কাউকে সাপের খেলা দেখাতেও দেখতাম। এগুলোই ছিলো মূলত তাদের জীবিকার প্রধান মাধ্যম।

বেদে পুরুষদের তেমন কাজকর্ম করতে দেখতাম না। মহিলাদের উপার্জনেই তাদের পরিবার চলতো। বলা যায় এটাই তাদের রীতি। তবে মাঝে মাঝে দেখতাম পুরুষরা ভাঙ্গারির ব্যবসা করতো। তারা গ্রামে গিয়ে কটকটি বিক্রি করে ও টোকাইয়ের মত সংগ্রহ করে বেড়াতো। আবার কেউ কেউ ভাড়ায় রিকশাও চালাতো।

বেদে মহিলাদের কাউকে গ্রামের সহজ-সরল মহিলাদের নানাভাবে প্রতারিত করে টাকা পয়সা ও চাল-ডাল আত্মসাত করতেও দেখা যেতো। আর পুরুষদের কেউ কেউ ভাঙ্গারি জোগাড় করতে গিয়ে বাড়ির আসবাবপত্র চুরি করতো।

বর্তমানে এই বেদে সম্প্রদায়কে আর তেমনভাবে নদীর পাড়ে দেখা যায় না। শুনেছি তাদের অনেকেই এখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় সমাজের মানুষদের সাথে মিলেমিশে বসবাস করা শুরু করেছে। তবে কিছু এখনো আগের মতই রয়ে গেছে।

এবার ঈদে বাড়ি গিয়ে নদীর পাড়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম। বেদেদের একটি মাত্র নৌকা চোখে পড়লো। এক বেদে মহিলাকে দেখলাম নৌকার ভেতর চুলায় রান্না করছে।

বর্তমানে গুটিকয় যেসব বেদে আছে, তাদেরকে আগের মত করে জীবিকা উপার্জন করতে দেখা যায় না। বর্তমানে এদের বেশিরভাগকেই ভিক্ষাবৃত্তি আর বিভিন্ন প্রতারণার আশ্রয় নিতে দেখা যায়। সাপের বাক্স নিয়ে মানুষকে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করে অনেকে। যদিও প্রায় সময়ই বাক্সে সাপ থাকে না।

এছাড়া হিজড়া সম্প্রদায়ের মত হাটে-বাজারে মৌন চাঁদাবাজিও করে তারা।

এবার বাড়ি গিয়ে তাদের প্রতারণার শিকার হয়েছি আমি নিজেই। হাজীগঞ্জ শহরে রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় এক বেদে তরুণী সাহায্য চাইলো। বললাম ভাংতি নেই। তার হাতে অনেকগুলো টাকা ছিলো। সেগুলো দেখিয়ে বললো তার কাছে ভাংতি আছে। পরে একশ টাকার নোট দিয়ে বললাম দশ টাকা রেখে বাকিটা ফেরত দাও। কিন্তু পুরো নোটটাই সে রেখে দিলো। 'আমি যদি তোর বোন হতাম, আত্মীয় হতাম' – এসব নানা কথা বলে সে একশ টাকা রাখাকে জায়েজ করার চেষ্টা করলো অনেকক্ষণ এবং একসময় চলেও গেলো।

অভাবে স্বভাব নষ্ট। তাদের বেলায়ও সেটাই ঘটেছে। এখন আর সাপের খেলা, সিংগা লাগানোর তেমন চল নেই। তাই জীবন জীবিকার স্বার্থেই অনেকে এই যাযাবর জীবন ছেড়ে সমাজে বসবাস শুরু করেছে। যে কারণে এই সম্প্রদায়ের অনেকটাই বিলুপ্তি ঘটেছে। কিন্তু ক্ষুদ্র যে অংশটা রয়ে গেছে তারা জীবিকার জন্য এসব প্রতারণাকেই বেছে নিয়েছে।

কিন্তু কতদিন এভাবে চলা যায়? একসময় হয়তো চিরতরেই হারিয়ে যাবে এই সম্প্রদায়টি। ডাকাতিয়ার পাড়ে গিয়ে দেখবো একটি নৌকাও আর অবশিষ্ট নেই।