হিন্দি ছবি উড়ান: উড়াল দেবার গল্প

ফাহিম ইবনে সারওয়ার
Published : 30 March 2011, 02:57 PM
Updated : 30 March 2011, 02:57 PM

২০১০ সালের অন্যতম আলোচিত হিন্দি ছবি উড়ান (Udaan)। মাত্র ৩ কোটি রুপি বাজেটের এই ছবি তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিভিন্ন পুরষ্কার অনুষ্ঠানে সব পুরষ্কার জিতে। ৫৬তম ফিল্মফেয়ার এ্যাওয়ার্ডের সেরা ছবি (সমালোচক) সহ ৭টি পুরষ্কার। ১৭তম স্টার স্ক্রিণ এ্যাওয়ার্ডে সেরা ছবি, সেরা পরিচালক সহ ৪টি পুরষ্কার। কি এমন আছে এই ছবিতে যা বিগ বাজেটের ছবিতে নেই? যেটা একটা সিনেমায় থাকা জরুরি, সেটাই পুরোপুরিভাবে আছে এই ছবিতে। সেটা হচ্ছে সুন্দর একটা গল্প, তার সাথে তাল মিলিয়ে প্রত্যেকটি অভিনেতা, অভিনেত্রীর সাবলীল অভিনয়।

ছবির শুরু গভীর রাতে চার কিশোরের (রোহান, বিক্রম, বিনয়, মানিন্দার) হোস্টেল থেকে পালিয়ে সিনেমা হলে গিয়ে বড়দের (adult) সিনেমা দেখতে যাওয়া নিয়ে। সেখানে তাদের সাথে অনাকাঙ্খিতভাবে দেখা হয় তাদের হোস্টেল ওয়ার্ডেনের সাথে। ফলাফল চারজনই স্কুল থেকে বহিষ্কার!

এরপর থেকেই মূলত সিনেমা শুরু। ছবির প্রধান চরিত্র ১৭ বছরের রোহান (রজত ভার্মেজা)। মা মারা যাবার পর রোহানের বাবা (রনিত রায়) রোহানকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেয় এবং তারপর ৮ বছর তাদের আর দেখা হয়নি। রোহানের বাবা স্বভাবে বদরাগী এবং কঠোর নিয়ম মেনে চলা একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ, যিনি মধ্যব্ত্তি বাবার কঠোর শাসনে বড় হয়েছেন এবং নিজের ছেলেদেরকেও সেভাবেই মানুষ করতে চান।

তাই ৮ বছর পর বাবার সাথে দেখা হওয়ার পরও ট্রেন স্টেশন থেকে বাসায় যাওয়া পর্যন্ত বাবা-ছেলের মধ্যে কোন কথা হয়না, এমনকি কুশল বিনিময়ও নয়। বাসায় পৌঁছে রোহান আবিস্কার করে তার ৬ বছর বয়সী সৎ ভাই অর্জুনকে। বাবার দ্বিতীয় বিয়ে এবং ভাইয়ের কথা জানতোই না রোহান!

রোহানের ইচ্ছে লেখক হবার, তাই সে চায় সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করতে। আর রোহানের বাবা মধ্যবিত্তের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে একগুয়েভাবেই চান ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে।

বাবার নিয়ম মেনে রোহানকে প্রতিদিন ভোরে উঠে বাবার সাথে যেমন দৌড়ের পাল্লা দিতে হয় তেমনি বাবার ইচ্ছেমতই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হয়, সাথে বাবার ফ্যাক্টরিতে কাজ। বাবা এবং ছেলের দূরত্ব বাড়তেই থাকে ক্রমশ। এমনকি বাবাকে 'বাবা' ডাকতেও মানা। বাবার আদেশক্রমে দুই ভাই বাবাকে 'স্যার' সম্বোধন করে। একদিন স্কুলে মারামারি করে বসে রোহানের ছোট ভাই অর্জুন। যার কারনে ব্যবসার জরুরি কাজ ফেলে তার বাবাকে যেতে হয় স্কুলে। প্রতিক্রিয়ায় বাসায় পৌছে বাবার বেল্টের মার খেয়ে অর্জুন অজ্ঞান হয়ে পড়লে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে রাখতে হয় অর্জুনকে চিকিৎসার জন্য। এসময়ে ছোটভাইয়ের সাথে দূরত্ব কমে আসে রোহানের এবং সে দেখতে পায় তার মত করেই বড় হচ্ছে অর্জুন, যেখানে অর্জুনের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার কোন মূল্য নেই।

এভাবেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে দিন কাটতে থাকে রোহানের। সে ভেবেছিলো যখন পরীক্ষায় পাশ করতে পারবেনা, তখন হয়তো তার বাবা বুঝবে সে কি চায়? কিন্তু যখন রোহানের রেজাল্ট আসে তখন পড়াশোনা বন্ধ করে ফ্যাক্টরিতে ফুলটাইম কাজ করার সিদ্ধান্ত দেয় তার বাবা। সেদিন রাতেই তাদের বাবা বলে যে হতাশা এবং একাকিত্ব তাকে পুরোপুরি গ্রাস করে নিয়েছে তাই সে ছেলেদের সাথে দূর্ব্যহার করে। এর সমাধান হিসেবে সে তার তৃতীয় বিয়ের কথা জানায় দুই ছেলেকে। সেই মায়ের সাথে এক সৎ বোনও আসে রোহান-অর্জুনদের পরিবারে।

এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার সুযোগ দুই ভাইয়ের কারোরই ছিলোনা। দুই ভাইয়ের হয়ে বলতে গিয়ে
রোহানের ছোট চাচাও অপমাণিত হয়ে ফিরে যায়। আর তার সাথে সাথে রোহানের কবিতার খেরোখাতা পুড়িয়ে দেয় তার বাবা।

রোহান আর তার কাঙ্থিত জীবনে ফিরে আসার কোন সম্ভাবনা দেখতে পায়না। মুম্বাইয়ে থাকা সেই স্কুলের তিন বন্ধুর সাথে ফোনে কথা হলে জানতে পারে তিনজন মিলে একটা রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছে। রোহান ঘর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বাবা বাধা দিতে গেলে বাবার গায়ে হাত তুলে রোহান পালাতে চায়। ছেলেকে ধরার জন্য পেছনে পেছনে রোহানের বাবা দৌড়াতে থাকলেও জীবনে প্রথমবার বাবাকে হারিয়ে দেয় ছেলে। মুম্বাই যাবার আগে ছোটভাই অর্জুনকে সাথে নিয়ে যায় রোহান, আর ১৮তম জন্মদিনে বাবার দেয়া ঘড়ি এবং চিঠি, 'আমাদের কখনো খোঁজার চেষ্টা করবেন না স্যার।'

রনিত রায় এখানে যে বাবার চরিত্রটি অসাধারণ অভিনয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন সেই বদরাগী বাবার শাসনে কিংবা ইচ্ছায় হয়তো আমাদের অনেকেরই শৈশব, কৈশোর, যৌবন কেটেছে। সিনেমাটা দেখতে দেখতে হয়তো মনে হতে পারে আমারই গল্প, হয়তো রোহানের মত উড়াল দেবার ইচ্ছাও হতে পারে।

ছবির কাহিনী লিখেছেন বিক্রমাদিত্য মোতওয়ান এবং অনুরাগ কাশ্যপ।
পরিচালনা করেছেন বিক্রমাদিত্য মোতওয়ান।
সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন অমিত ত্রিবেদি।
ছবিটি প্রযোজনা করেছেন সঞ্জয় সিং, রণি স্ক্রুওয়ালা এবং অনুরাগ কাশ্যপ।