জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতেই হবে

শাহীন রেজা নূর
Published : 7 Feb 2012, 05:19 PM
Updated : 10 Feb 2021, 08:20 AM

জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতেই হবে। ২০১৩ সালে হাইকোর্টের রায় অনুসারে নির্বাচন কমিশনে জামায়াতের নিবন্ধীকরণ অবৈধ বলে ঘোষিত। প্রায় সব শীর্ষনেতাই যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত। অনেকের ইতোমধ্যেই বিচার পর্বের শেষে ফাঁসিও কার্যকর করা হয়েছে। এখন দাবি উঠছে জামায়াতকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষিত করার।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পরই জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় বাংলাদেশে। কিন্তু দেশের প্রথম ফৌজি প্রশাসক জিয়াউর রহমান তার প্রতিপত্তি বৃদ্ধির জন্যই জামায়াতকে ফের মাথাচাড়া দেওয়ার সুযোগ করে দেন। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকিস্তানপন্থীদের রমরমা ফের শুরু হয় জেনারেল জিয়ার হাত ধরে। নিজের রাজনৈতিক আকাঙ্খা মেটাতে স্বাধীনতার শত্রুদের সঙ্গে হাত মেলান তিনি। স্বাধীনতার শত্রুদের মন্ত্রী করতেও জিয়া কুন্ঠিত হননি। দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে লুন্ঠিত করতেও পিছপা হননি তিনি। জিয়ার মতোই সামরিক উত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের প্রশ্রয় দিতে শুরু করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও। আর জিয়ার সহধর্মিণী খালেদা জিয়া জামায়াতকে সঙ্গী করেই বাংলাদেশে সরকার গঠন করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগকে অসম্মান করে পাকিস্তানপন্থী জামায়াতের নেতারাই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ভোগ করতে থাকে খালেদা জিয়ার কল্যাণে।

বিএনপির সৌজন্যেই বাংলাদেশে জামায়াতের বাড়বাড়ন্ত। তাদের ধৃষ্ঠতাও এক সময় মারাত্মক আকার নেয়। ফাঁসিতে লটকানোর আগে ২০০৭ সালে বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়েই তাই মহান মুক্তিযুদ্ধকে অসম্মান করারও সাহস পেয়েছিলেন জামায়াতের মহাসচিব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। মুক্তিযুদ্ধকে তিনি গৃহযুদ্ধ বলে কটাক্ষ করেন। বলেছিলেন, একাত্তরের কোনও যুদ্ধাপরাধীই নাকি নেই। পরে অবশ্য বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তাকে যুদ্ধাপরাধী প্রমাণ করে ফাঁসি দেওয়া হয়। জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে রাজনৈতিক পুনর্বাসন পেয়ে উল্টে পাকিস্তানের হয়েই সাফাই গাইতে শুরু করে জামায়াতে ইসলামী। ২০০৭ সালেই মুক্তিযুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ বলে বর্ণনা করে জামায়াত বুঝিয়ে দেয় তাদের কাছে পাকিস্তান ও ইসলাম সমার্থক। স্বাধীনতার এত বছর পরেও তারা পাকিস্তান ভাগের স্মৃতি ভুলতে পারছে না। তারা যে আজও স্বাধীনতাবিরোধী সেকথাও স্মরণ করিয়ে চলেছে জামায়াতের মুরুব্বিরা।

মহান মুক্তিযুদ্ধকে কোনদিনই সমর্থন করেনি জামায়াতিরা। ভারতের সার্বিক সহযোগিতায় পাকিস্তানি গণহত্যার বিরুদ্ধে লড়াই করে লাভ করা দেশের স্বাধীনতাকে চিরকাল অসম্মান করে চলেছে তারা। তাই একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকে প্রকাশ্যে গৃহযুদ্ধ বলার সাহস পেয়েছিল বিএনপির আমলে। যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত মামলায় বিচারপতিরা বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি কোনও সম্মানই নেই জামায়াতিদের। দেশের স্বাধীনতার প্রতি সম্মান নেই তাদের। জামায়াত ইসলামীর নেতাকর্মীরা ত্রিশ লক্ষ শহিদের প্রতি এখনও শ্রদ্ধা জানাতে রাজি নয়। তাই আদালত পরামর্শ দিয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল ও ব্যক্তিদের সরকারি, বেসরকারি এবং আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্ত সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক। কোনদিনও যাতে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি শীর্ষ পদে বসতে না পারে সেটাই সুরক্ষিত করতে বলেছিলেন সরকারকে।

বিচারপতিরা তাদের রায়ে বলেছিলেন, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও পিস কমিটির নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের মূল মদতদাতাই ছিল জামায়াত। পাকিস্তানের দখলদারি বজায় রাখতে জামায়াতই পাক-সেনাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে বাঙালি নিধনযজ্ঞে হাত মেলায়। যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াত মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের স্বীকৃতির বিরোধিতা করেও প্রচার চালায়। পাকিস্তানের মতো জামায়াতের নেতারা আজও মুক্তিযুদ্ধে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য ক্ষমা চায়নি। বরং তারা বলে চলেছে মুক্তিযুদ্ধ নাকি কোনও যুদ্ধই নয়। তাই যুদ্ধাপরাধীও নাকি নেই।

বাংলাদেশবিরোধী কার্যকলাপের জন্য ১৯৭১ সালেই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় জামায়াত। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সেই নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পরই ফের মাথাচাড়া দেয় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। ২৩ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে মুক্তি দেন জিয়া। এদের মধ্যে অনেকেরই যুদ্ধাপরাধ আগেই প্রমাণিত। ১৯৭৮ সালে গোলাম আযম পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। জিয়া ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রবর্তন করে জামায়াতকে মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহস যোগান। এর আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মাটিতে মৌলবাদীদের ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পাকিস্তানপন্থীরা আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু জিয়া তাদের পুনর্জীবন দান করে। বিএনপি আর সামরিক শাসকদের কাছ থেকে দু-দশকেরও বেশি সময় ধরে আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা পেয়ে বাংলাদেশের মাটিতেই ফুলে-ফেঁপে ওঠে জামায়াতিরা। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে জামায়াত বিএনপির জোটসঙ্গী হয়ে সরকার চালাবার সময় আরও বেশি করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়।

আর এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে জামায়াত নিজেদের আধিপত্য মারাত্মক বিস্তার করে। ব্যাংক, বীমা কোম্পানি থেকে শুরু করে গণমাধ্যমের ব্যবসাতেও নিজেদের পরিধি বিস্তার করতে সক্ষম হয় পাকিস্তানপন্থী এই দলটি। তাদের ক্যাডারদের এইসব সংস্থায় কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয় তারা। দেশে ও বিদেশে নিজেদের প্রভাব বাড়ে তাদের। ২০০৭-২০০৮ সালে সেনানিয়ন্ত্রিত তদারকি সরকারের আমলে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বহু শীর্ষনেতা-নেত্রী গ্রেপ্তার হলেও রহস্যজনকভাবে জামায়াতিরা ছাড়া পেয়ে যান। লক্ষ লক্ষ বাঙালি সেদিন নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন মহান স্বাধীনতার জন্য। তাদের এই আত্মত্যাগের বিরোধিতা করেও স্বাধীন দেশে বেশ বহাল তবিয়তেই ছিলেন জামায়াত নেতারা। এটা বাস্তব, জামায়াতিদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়েই চলেছিল জিয়া-এরশাদ-খালেদার আমলে। তাই স্বাধীনতা যোদ্ধাদের অসম্মান করার ধৃষ্টতা দেখাতে পেরেছিল জামায়াতের নেতারা। পাকিস্তানিরা গণহত্যা করলেও বিন্দুমাত্র দুঃখ প্রকাশ করার প্রয়োজনও বোধ করেনি তারা।

ইসলামী মৌলবাদের নামে পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনী ও ফৌজি প্রশাসকদের নজরদারিতে ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী, ছাত্র ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে বিনাশ করার কাজে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নেয় জামায়াত। তথাকথিত অখণ্ড পাকিস্তানের স্বার্থে জামায়াতের সহযোগী সংগঠন আল-বদর, রাজাকার, আল-শামস, পিস কমিটি সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানকে নিজেদের দখলে রাখতে জামায়াত ও তাদের সহযোগী সংগঠনকে অস্ত্র প্রশিক্ষণও দেয় পাক-সেনাবাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের সময় শয়ে শয়ে মানুষ খুন হন জামায়াতের হাতে। নারীরা নির্যাতিত হয় তাদের ষড়যন্ত্রে। বহু হিন্দুকে গায়ের জোরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। জামায়াতের প্রথম সারির নেতা গোলাম আযম, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লা, মুহম্মদ কামরুজ্জানাসহ অনেকেই যুদ্ধাপরাধের বিচারে অপরাধী প্রমাণিত। আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের শাস্তিও হয়েছে। ১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতার পর গোলাম আযমের নাগরিকত্বও বাতিল করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু জেনারেল জিয়া বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর এদের জামাই আদরে দেশে ফিরিয়ে আনেন।

দেশে ফিরে এই মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের অনেককে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় ভূমিকায় দেখা যায়। গণহত্যায় মুখ্য ভূমিকা নেওয়া দুই ঘাতক বাংলাদেশের মন্ত্রীও হয়েছেন। এ ধরনের ঘটনার বোধহয় বিশ্বে আর কোনও নজির নেই। তাই জামায়াতকে নির্মূল করাই এখন জরুরি। এটা ঠিক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শেষ হলে বহু জামায়াত নেতাকেই ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হবে। আইন কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। কিন্তু এতেই নির্মূল হবে না স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। কারণ পুরনো নেতারা ফাঁসিতে ঝুললেও তরুণ প্রজন্মের হাতে জামায়াত একই পথে চলবে। চলতে থাকবে পাকিস্তানপন্থীদের ষড়যন্ত্র। জামায়াতের দেশবিরোধী আদর্শ নতুন নেতৃত্বের হাতেও অটুট থাকে। পাকিস্তানের কুখ্যাত গোয়েন্দাসংস্থা আইএসআইয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী শক্তি মদত পাবে। মৌলবাদীদের কার্যকলাপ বাড়বে। সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চলবেই। বাংলাদেশে ইসলামী শাসন প্রবর্তনের নামে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দেশের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাবেই। কারণ এটাই জামায়াতের একমাত্র লক্ষ্য। একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে আজও মরিয়া তারা।

এ অবস্থায় দেশবাসী চান, জামায়াতকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক। নির্বাচনে লড়াইয়ের অধিকার কেড়ে নিয়ে কোনও লাভ নেই। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে নির্মূল করতে হবে। ৩০ লাখ বাঙালির হত্যাকারী, তিন লাখেরও বেশি নারী নির্যাতনকারীদের নির্মূল না করলে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মা শান্তি পেতে পারে না। স্বাধীন দেশে জামায়াত বা ইসলামী ছাত্র শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করলে ভবিষ্যতে ফের তারা মাথাচাড়া দিতে পারে। বিশেষ করে দেশনেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যে দ্রুতগতিতে উন্নয়নের মহাসড়ক দিয়ে এগিয়ে চলেছে, সেই উন্নয়নও বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে। পাকিস্তানপন্থী বা স্বাধীনতাবিরোধীদের পুরোপুরি নির্মূল না করতে পারলে শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার আসলে শান্তি পেতে পারে না। তাই বাংলাদেশের বহুমানুষই আজ চাইছেন জামায়াত ও ছাত্র শিবিরকে সর্বতোভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক।