হোটেল শ্রমিকদের মানবেতর জীবন ও ছাঁটাই

ফজলুল কবির মিন্টু
Published : 21 May 2018, 08:36 AM
Updated : 21 May 2018, 08:36 AM

সম্প্রতি চট্টগ্রামে হোটেল শ্রমিকদের তিনটি সংগঠন – হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট শ্রমিক ইউনিয়ন, হোটেল শ্রমিক লীগ এবং জাতীয়তাবাদী হোটেল শ্রমিক দল মিলে গঠন করে হোটেল শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ। তাদের পক্ষ থেকে  ১৫ মে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সম্মুখে এক মানববন্ধনে এই রোজার মাসে কোন শ্রমিক ছাঁটাই না করা এবং ঈদ বোনাস দেওয়ার দাবি জানানো হয়।

হোটেল শ্রমিকদের দাবি যৌক্তিক এবং ন্যায়সংগত হলেও এই ব্যাপারে রাষ্ট্র, মালিক ও সুশীল সমাজ কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। ফলে এই বছরও হোটেল শ্রমিকেরা বিগত বছরের মতই  ছাঁটাইয়ের কবলে পড়ে আর্থিক সংকটে পড়বে বলে ধারনা করা যায়।

রিপোর্ট অন মনিটরিং অফ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভে (এমইএস) ২০০৯, অর্থ মন্ত্রণালয়, এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১১, জুন প্রকাশিত নানা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে হোটেল রেস্তোরাঁ ও দোকানে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৮২ লাখ। এর মধ্যে শুধু হোটেল শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ২০ লাখ হোটেল শ্রমিক রোজার মাসে চাকরি হারায়।

বাংলাদেশের সকল শ্রমিক এবং মালিকদের জন্য একটি শ্রম আইন আছে। মালিক এবং শ্রমিক প্রত্যেকেই এই আইন মেনে চলতে বাধ্য। কিন্তু হোটেল শ্রমিকরা যেন শ্রমিকই নয়। হোটেল মালিকরা যেন সকল আইনের উর্ধে। ফলে এখানে মালিকরা শ্রম আইনের কোন তোয়াক্কাই করেনা।

হোটেল শ্রমিকদের নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র দেয়া হয়না। সবেতন কোনো ছুটি নেই। এমনকি সাপ্তাহিক কিংবা উৎসব ছুটিও নেই। কারও কখনো ছুটির প্রয়োজন হলে অন্য আরেক জনকে বদলি দিতে হয় অথবা বিনা বেতনে ছুটি পাওয়া যায়। নিয়মিত ১২-১৩ ঘণ্টা কাজ করতে হয় কিন্তু কোন ওভারটাইম ভাতা পাওয়া যায়না। মালিকের ইচ্ছার উপর তাদের চাকরির স্থায়িত্ব নির্ভর করে। মৌখিক আদেশেই শ্রমিকের চাকরি চলে যায়। ১৭-১৮ বছর চাকরি করলেও কোনো ক্ষতিপূরণ কিংবা সার্ভিস বেনিফিট দেওয়া হয় না। তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ নির্বিকার। যেন তাদের কোন দায়িত্ব নাই। সহজ উত্তর লোকবলের অভাবের কারনে সব প্রতিষ্ঠানকে তদারকির আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছেনা। প্রতিকারের জন্য শ্রম আদালতে মামলা করলে মালিক ভূক্তভোগী শ্রমিককে তার কর্মচারী হিসাবেই স্বীকার করে না। যেহেতু হোটেল শ্রমিকরা নিয়োগপত্র ও পরিচয় পত্র পায়না, শ্রমিকের পক্ষেও নিয়োগকর্তা চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তার উপর শ্রম আদালতে বিচারক শূন্যতা, মামলার জট, মামলার দীর্ঘসূত্রিতা তো আছেই।

বছরের দশ-এগার মাস এভাবেই তাদের জীবন চলে। কিন্তু রমজান মাস আসলে তাদের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে পড়ে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশ। অধিকাংশ মানুষ রোজা রাখে ফলে দিনের বেলায় হোটেল বন্ধ রাখতে হয়। ব্যবসা মন্দা যায় এমন অজুহাতে মুষ্টিমেয় কিছু প্রতিষ্ঠিত হোটেল ছাড়া অধিকাংশ হোটেলে বেআইনিভাবে এক থেকে দেড় মাসের জন্য শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়। শ্রমিকরা বেতন-বোনাস কিছুই পায়না।

লক্ষণীয় বিষয় ব্যবসা মন্দার কথা বলা হলেও রোজার মাসে হোটেলের মেরামত কাজ হয়। হোটেল রঙ করা হয়। হোটেল চিক চিক করে। নতুনভাবে সাজে হোটেল। কেবল শ্রমিকরা চাকরি হারায়। হোটেল শ্রমিকদের চেহারা ক্রমশ মলিন হতে থাকে।বেশি কথা বললে বাকি ১১ মাসও চাকরি না দেওয়ার হুমকি আসে মালিকের কাছ থেকে। ফলে চুপচাপ মেনে নেয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় থাকেনা।

রমজান মাস, সিয়াম সাধনার মাস। সবাই চেষ্টা করে এই মাসে অন্য সময়ের তুলনায় সাধ্য অনুযায়ী ভাল খাবার খেতে। পরিবার-পরিজন নিয়ে একটু ভাল থাকতে। কিন্তু হোটেল শ্রমিকের ঘরে থাকে হাহাকার। ঈদের দিন সবাই আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠে। সবাই নতুন জামা কাপড় পড়ে। কিন্তু অধিকাংশ হোটেল শ্রমিকের ঘরে ঈদের আনন্দ থাকেনা। সন্তানদের গায়ে ঈদের নতুন জামা থাকেনা। অনেকে স্ত্রী সন্তানদের সামনে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারেনা। যেন জীবন যুদ্ধে পরাজিত এক সৈনিক।

সংবিধানের ১৪ এবং ১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিককে শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তি এবং যুক্তি সঙ্গত মজুরীর মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। রাষ্ট্র তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে আন্তরিক হবে এমনটিই আশা করে সংশ্লিষ্ট সকল মহল।