ক্রিকেট কলঙ্কের বরপুত্র শ্রীনিবাসন

ফয়সাল মাহমুদ পল্লব
Published : 6 April 2015, 05:36 AM
Updated : 6 April 2015, 05:36 AM

২০১৪ সালের ২৬ জুন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বভার দেয়া হয় বাংলাদেশের পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে। সেই সময়ে আইসিসির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান ভারত ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক প্রধান এন শ্রীনিবাসন । আইসিসির ১১তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন আ হ ম মুস্তফা কামাল।

প্রায় মাসখানেক পূর্বে শুরু হয় ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে বড় আসর বিশ্বকাপ ক্রিকেট-২০১৫। বরাবরের মতো এবারো এর আয়োজন করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)। শুরুতে খেলা ভালভাবে চললেও বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বিতর্কের শুরু হয় ১৯ মার্চ। ওইদিন বাংলাদেশ ভারতের মধ্যকার কোয়ার্টার ফাইনাল খেলায় অভিযোগের আঙুল ওঠে আম্পায়ারদের বিরুদ্ধে। বিশ্বব্যাপী শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। কোটি কোটি দর্শক এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তোলে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে।

ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে প্রভাব খাটিয়ে এই ক্রিকেট আসর থেকে বাংলাদেশকে বাধ্যতামূলক বিদায় জানিয়েছে বলে ক্ষোভে ফেটে পরে সারা বাংলাদেশ। পরে ভারতীয় ও বাংলাদেশিদের মধ্যে বাকযুদ্ধও শুরু হয়।

এ বিষয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশের হয়ে খোলামেলা কথা বলেন মুস্তফা কামাল। তিনি বাজে আম্পায়ারিং নিয়ে কথা বলায় শ্রীনিবাসন দুঃখিত হন এবং কামালের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলেন যে কামাল ভারত বিরোধী কথা বলছেন। কিন্তু মুস্তফা কামাল বরাবরই বিষয়টি অস্বীকার করে আসছেন।

আইপিএলে স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারির হোতা এই শ্রীনিবাসন নিজ দেশের বোর্ড থেকে বিতর্কিত হয়ে এবার কলঙ্কের স্বাক্ষর রাখলেন আইসিসিতেও। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আইসিসি সভাপতি মুস্তফা কামালকে বাদ দিয়ে চ্যাম্পিয়নদের হাতে নিজে বিশ্বকাপ ট্রফি তুলে দিয়ে ফের বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান নিলেন বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির চেয়ারম্যান শ্রীনিবাসন। তার কলঙ্কের দাগ লাগিয়ে দিলেন ২০১৫ ক্রিকেট বিশ্বকাপে। আর তার এ দাদাগিরির সমালোচনায় মুখর হয়েছে খোদ ভারতেরই বিভিন্ন গণমাধ্যম। তারা তাদের বিভিন্ন প্রতিবেদনে শ্রীনিবাসনকে শব্দধোলাইও করেছে।

ভারতীয় 'আনন্দবাজার পত্রিকা' মুস্তফা কামাল ও শ্রীনিবাসনের কথোপকথন নিয়ে লিখেছে- 'শনিবার রাতে আইসিসির জনাকয়েক সদস্যকে নিয়ে বৈঠক করেন শ্রীনিবাসন। সেখানেই কামালকে বলে দেন যে, আইসিসি'র কোড অব কন্ডাক্ট ভাঙার অভিযোগে আপনাকে আমরা ট্রফিটা দিতে দেব না। কামাল অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, মিস্টার শ্রীনিবাসন, আজকের দিনে আইসিসি প্রেসিডেন্ট কে? শ্রীনি বলেন, আপনি। কালকে আইসিসি প্রেসিডেন্ট কে থাকবে? শ্রীনি বলেন, আপনি। তাই যদি হয় তাহলে আমি বিশ্বকাপ তুলে দেব না কেন? শ্রীনি তখন বলেন, উত্তরটা আপনাকে আগেই দেওয়া আছে।' পত্রিকাটি মুস্তফা কামালের পূর্ণাঙ্গ বক্তব্যও প্রকাশ করেছে। সেখানে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, 'ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করিনি, আইসিসির বিরুদ্ধে করেছিলাম।'

এবিপি নিউজ লিখেছে, 'তার (কামালের) মন্তব্যের জেরেই প্রকাশ্যে আসে আইসিসির ভিতরের অন্তর্দ্বন্দ্ব। নজিরবিহীন এই ঘটনার পর ফের প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা, ভারতীয় বোর্ডের পর সবার অলক্ষ্যে এবার কি আইসিসির রিমোট কন্ট্রোলও পকেটে পুরে ফেললেন নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন?'

'এই সময়' পত্রিকা লিখেছে, 'ভারতীয় বোর্ডে তার একাধিপত্য ধাক্কা খেতে পারে, কিন্তু আইসিসিতে যে তিনিই সম্রাট, এমসিজিতে তা দেখিয়ে দিলেন আইসিসি চেয়ারম্যান শ্রীনিবাসন।'

এছাড়া ইংরেজি টেলিগ্রাফ, এনডিটিভিসহ প্রায় অধিকাংশ ভারতীয় গণমাধ্যম বেশ গুরুত্ব দিয়ে সংবাদটি প্রচার করেছে। পুরস্কার বিতরণীতে ঘটে যাওয়া লজ্জাজনক ঘটনাটির পুঙ্খাণুপুঙ্খ তুলে ধরেছে। একইসঙ্গে আইপিএল ফিক্সিংয়ে তাকে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের কাছে অভিযুক্ত করার বিষয়টি সবিস্তারে বর্ণনা করেছে প্রভাবশালী এ ইংরেজি দৈনিকটি।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবর অনুয়ায়ী আইসিসি সভাপতি আ হ ম মুস্তফা কামালকে তার পদ থেকে সরিয়ে দিতে সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী ডেভ রিচার্ডসনকে নির্দেশনা দিয়েছেন আইসিসি চেয়ারম্যান ও কার্যকরী প্রধান নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন। ফাইনালে পুরস্কার অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না জানানোয় কামাল ক্ষুব্ধ হওয়ায় এবং আম্পায়ারিং ও আইসিসির বিপক্ষে মিডিয়ায় বক্তব্য রাখায় তার বিরুদ্ধে শাস্তিস্বরূপ এই অ্যাকশন শ্রীনিবাসনের। ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল ভারত-বাংলাদেশের কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচ নিয়ে। ম্যাচে ভারতের পক্ষে বেশকিছু উদ্ভট সিদ্ধান্ত নেয় দুই আম্পায়ার ও ম্যাচ রেফারি। কার্যতই বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আম্পায়ারদের সামান্য সমলোচনা করেন আইসিসি সভাপতি ও বিসিবির সাবেক প্রধান মুস্তফা কামাল। এ বিষয়ে অসন্তুষ্টি জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।

সবমিলিয়ে এবারের বিশ্বকাপে তিক্ত অভিজ্ঞতার সৃষ্টি হয়েছে ক্রিকেটপ্রেমীদের মাঝে। আর তা সৃষ্টির নেপথ্যে বাংলাদেশ-ভারত কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে আম্পায়ারের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। আর এই বিতর্কের উনুনে ঘি ঢেলেছেন স্বয়ং আইসিসি চেয়ারম্যান শ্রীনিবাসন।

ভারতীয় বংশোদ্ভূত শ্রীনিবাসনের এমন আচরণে ক্রিকেটে নিশ্চয় একটি নেতিবাচক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে এতে কোন বিতর্ক নেই। এ বিতর্ক থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে আইসিসি সভাপতি আ হ ম মুস্তফা কামাল বুধবার বাংলাদেশে ফিরে বিমানবন্দরে এক সংবাদ সম্মেলনে শ্রীনিবাসনের বিষয়গুলো আরো স্পষ্ট করেছেন এবং সেই সাথে তিনি আইসিসির সভাপিত পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণাও দিয়েছেন।

ক্রিকেটপ্রেমী দর্শকরা আশায় আছেন শ্রীনিবাসনের দিকে। তিনি আইসিসি থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিবেন বলে অনেকের ধারণা। আর এ ঘোষণা আসা প্রয়োজন বলেও মনে করছেন ক্রিকেটবোদ্ধারা। কারণ, ক্রিকেটের মতো একটি ভদ্র ও জনপ্রিয় খেলা একজন শ্রীনিবাসনের জন্য বিতর্কিত হোক এটা আশা করেন না তারা। তবে ক্রিকেট ইতিহাসে শ্রীনির নাম যে কলঙ্কের কালিমায় লেখা থাকবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সবার প্রত্যাশা শ্রীনির কালো হাত থেকে ক্রিকেট রক্ষা পাবে। বিতর্ক নয়, খেলা হয়ে উঠুক আনন্দের-উচ্ছাসের।