সময়ের শ্লোগানঃ দিস ইস নট আওয়ার ফেস

সাজেদুল আমিন চৌধুরী রুবেল
Published : 25 Oct 2012, 04:43 PM
Updated : 25 Oct 2012, 04:43 PM

সপ্তাহ তিনেক আগে এক ইন্ন্ডিয়ান বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আয়ারল্যান্ডের একটি দর্শনীয় স্থানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক আমেরিকান পর্যটকের সঙ্গে পরিচয়। কথায় কথায় ভদ্রলোক আমাদের আদি নিবাস জানতে চেয়ে উত্তরের অপেক্ষা না করেই অনেকটা হিউমার সেন্স মিশিয়ে তিনি নিজেই বললেন, "পাকিস্তানি নওতো!" দুজনেই একসঙ্গে মাথা নেড়ে "না" সুচক উত্তর দিয়ে আমাদের পরিচয় তুলে ধরে আমি তাঁকে বললাম, পাকিস্তানি হলেই বা ক্ষতি কি! সকল পাকিস্তানি তো জঙ্গি নয় কিংবা সকল জঙ্গি-ইতো আর পাকিস্তানি নয়। "ভেরি স্মার্ট!" বলেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "তোমাদের বাংলাদেশ তো এখনো বেশ ভাল। আলকায়দা বা জঙ্গি সম্পৃক্ত কোন সন্ত্রাসি কর্ম কাণ্ডের খবর আমার নজরে পড়েছে কিনা তা আমি মনে করতে পারছিনা।"

ভদ্রলোক আয়ারল্যান্ডে এসেছিলেন নিছক ভ্রমনের জন্য। কথা বলে বুঝা গেল তিনি হাই প্রোফাইল সম্পন্ন বিশেষ কেউ নন। সাধারন শ্রেণীরই আওতাভুক্ত এক আমেরিকান নাগরিক। বহু বছর বিদেশ যাপনের অভিজ্ঞতা থেকে অন্তত এটা উপলব্ধি করতে পেরেছি শুধু ওই একজন আমেরিকানই নয়, ইউরোপ, আমেরিকা সহ সারা বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই বাংলাদেশকে ধর্ম প্রিয় ও শান্তি অন্বেষণকারী দেশ হিসেবেই জানত। দেশের ভেতরে মাঝে মধ্যে জঙ্গি কার্যক্রম মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ ছিল এ বদনাম থেকে অনেকটাই মুক্ত। কিন্তু গত ১৭/১০/১২ এর ঘটনায় বিশ্ব দরবারে দেশটির চেহারা ভিন্ন ভাবে প্রতিফলিত হল। একুশ বছরের বাংলাদেশী তরুন কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিস নিউ ইয়র্কে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে চাইলে এফবিআই (মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা) ও সিটি পুলিশ তাকে হাতে নাতে ধরে ফেলে এবং সারা পৃথিবীর গনমাধ্যমে তা লিড নিউজ আকারে প্রকাশ পায়। এফবিআইয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী এ তরুনকে আলকায়দা সংশ্লিষ্ট এক সন্ত্রাসি হিসেবে উল্লেখ করে প্রচারমাধ্যমে খবরটা প্রকাশ পাওয়ায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিশ্ব দরবারে মারাত্মক ভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে।

নাফিস আলকায়দা সংশ্লিষ্ট জঙ্গি কিংবা অন্ধ জিহাদি যাই হোকনা কেন সেটা বড়ো কথা নয়। একজন বাংলাদেশী হয়ে সে যে জঘন্যতম হটকারিতার আশ্রয় নিয়েছে সেটাই চরম সত্যি। ফেডারেল ব্যাংক উড়িয়ে দেয়ার মতো ঘৃণ্য প্রচেষ্টার খবর বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ায় প্রতিটি প্রবাসী বাঙ্গালীকে আজ চরম বিব্রতকর অবস্থার মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে। পত্রিকায় দেখা গেল, আমেরিকান বাঙ্গালি কমিউনিটিতে বিরাজ করছে চাপা আতংক ও থম থমে অবস্থা। নাফিসের ঘটনার সংবাদ সম্পর্কে স্কুলের বাঙ্গালি ছেলেমেয়েরা অবহিত কিনা সে বিষয়েও শিক্ষকরা তাদের কাছ থেকে জানতে চাচ্ছেন। এ ধরনের অসস্তিকর পরিবেশের মোকাবেলা করা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য বড়ই কষ্টের। আমেরিকার বাঙ্গালি অধ্যুষিত এলাকা গুলোতে ধিক্কার ও বিদ্রোপাত্মক শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে বিদেশিরা বাঙ্গালি অস্তিত্বে আঘাত হানছে বলেও খবর পাওয়া গেছে। ঘটনাটি আমেরিকা কেন্দ্রিক বলে ওখানকার বাঙ্গালিদের ভয়ানক নাজুক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে সত্যি, কিন্তু বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকল বাঙ্গালি অভিবাসীর উপরই এর নেতিবাচক প্রভাব কমবেশি পড়ছে। এমনকি খোদ আমাকেও সহকর্মীদের কাছে নাফিস বিষয়ক কিছু কৌতোহলী প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়েছে।

নাফিসের এ অপকর্ম সাধনের অপচেষ্টা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বিরাট মন্দা প্রভাব ফেলার আশঙ্কা রয়েছে। প্রবাসে চাকরির বাজারে স্বকীয় গুনের জন্য বাঙ্গালিদের বেশ সুনাম থাকলেও বর্তমান বৈরী পরিস্থিতিতে তা মলিন হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। অভিবাসী হিসেবে যারা বর্তমানে বেকার অবস্থায় আছেন তাদের যেমন চাকরি-বাকরি পেতে কষ্ট হবে ঠিক তেমনি নতুন করে কর্মসংস্থান নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানোটাও হবে খুব কঠিন। এমন অনেক অভিবাসী যারা যুক্তরাষ্ট্র সহ পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোতে স্থায়ী অধিবাসী বা নাগরিকত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াধীন আছেন তাও বাধাগ্রস্থ হওয়ার যথেষ্ট সম্ভবনা রয়েছে। শিক্ষারত ছাত্রদের স্থায়িকরনের ক্ষেত্রে যে আইনের শীতিলতা কিংবা অবৈধ ভাবে বসবাসরতদের বৈধকরণের যে অঘোষিত নীতিমালা সেসব থেকেও বাঙ্গালিরা বঞ্চিত হতে পারেন বলে আপাত দৃষ্টিতে ধারনা করা যায়। নতুন করে স্টুডেন্ট ভিসা সহ ট্যুরিষ্ট বা বিজনেস যে কোন ভিসা পেতেই পোহাতে হবে হাজারো অযাচিত ঝামেলা, এতে কোন সন্দেহ নেই। মোট কথা, বিদেশী রেমিটেন্স বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মারাত্মক ভাবে ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াল নাসিফের এ ঘটনা।

একুশ বছরের নাফিস বুঝেই হোক বা না বুঝেই হোক এফবিআইয়ের কৌশলী ফাঁদে পা দিয়ে বাঙ্গালীর মুখে যে চুনকালি দিয়েছে তা অত সহজে মুছে ফেলার নয়। তারপরও আমাদেরকে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবেনা। প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটনে রাষ্ট্রীয় ভাবে সচেষ্ট ভুমিকা পালন করতে হবে। সত্যি যদি সে আলকায়দা সংশ্লিষ্ট জঙ্গিবাদের পুজারি হয়ে থাকে তবে সম্প্রতি আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাফিস ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতার কথা বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাকে আমরা স্বাগত জানাই। এতে ভূলুণ্ঠিত ভাবমূর্তি পুরোপুরি ফিরে না পেলেও বিশ্বে অন্তত এতোটুকু প্রতিয়মান হবে নাফিসদের মতো বিপথগামীরা আলকায়দার প্রেমে হাবুডুবু খেলেও গোটা দেশ বা জাতি তাদেরকে ধিক্কার জানিয়ে প্রত্যখান করতে সক্ষম। পক্ষান্তরে আওয়ামীলীগের একজন মধ্যম সারির নেতা নাফিসের ব্যপারে কথা বলতে গিয়ে একটি বিশেষ দলকে দায়ী করে যে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন তা অবশ্যই পরিতাজ্য। এ ধরনের একটি স্পর্শকাতর বিষয়কে রাজনীতির চেরাবালিতে গুলিয়ে ফেলা যে মোটেও শোভকর নয় তা আমাদের রাজনীতিবিদদের অবশ্যই উপলব্ধি করা উচিত।

খবরে প্রকাশ, নাফিস বড়ো ধরনের কোন নাশকতা ঘটানোর পূর্বপরিকল্পনা নিয়েই আমেরিকাতে পাড়ি জমায় গত জানুয়ারিতে। এ বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। প্রকৃতপক্ষেই যদি সে ওই হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থের জন্য দেশ ছেড়ে যেতো তাহলে বাংলাদেশ থেকে কিংবা আমেরিকাতেই বসবাসরত শক্তিশালী কোন নিজস্ব লোকের দক্ষ ও সুপরিকল্পিত হাত তার পেছনে কাজ করতো। এফবিআইয়ের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে ইঁদুর ছানার মতো তাকে ধরা পড়তে হতোনা। হতে পারে, নাফিস আমেরিকান বিদ্বেষী জিহাদি মনোভাব সম্পন্ন এক তরুন। দুনিয়া কাঁপানো কোন ধ্বংসাত্মক কাজ করাও ছিল তার লক্ষ্য। কিন্তু এসব করতে গেলে যে শক্তি-সামর্থ্য, পরিপক্কতা বা মুন্সিয়ানা ও অর্থনৈতিক যোগানের প্রয়োজন তার কি আদৌ কোনটা ছিল? আজ নিউ ইয়র্কে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যংক উড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টায় এক হাজার পাউন্ড ওজনের যে বিস্ফোরক দ্রব্য ও ভ্যানের কথা বলা হচ্ছে সেগুলোর যোগানদাতা কারা তা আমরা সবাই জানি। পত্রিকায় যে দুজন বন্ধুবেশি বাংলা ভাষাভাষী এফবিআই এজেন্টের কথা উঠে এসেছে তারা যদি নাফিসকে নিয়ে ব্যাঙের মতো খেলা না খেলতেন তাহলে হয়তোবা তাকে এতো দ্রুত আলকায়দা সংশ্লিষ্ট ঘৃণ্য জঙ্গি অপবাদ নিয়ে বিশ্ব দরবারে আত্মপ্রকাশ করতে হতোনা। কিংবা নাফিস তার পিচ্ছিল পথ পরিক্রমায় অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার আগেই বার বার হোঁচট খেতে খেতে হয়তো এক সময় হাফিয়ে উঠতো। চারপাশের অসংখ্য প্রতিকুলতার মুখে পরাস্ত হয়ে অপকর্মের স্পৃহা হারিয়ে আপন মনেই সঠিক পথে ফিরে আসতো। আজ নাফিসের আলকায়দা সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসের খবর বিশ্ব মিডিয়াকে আজান দিয়ে যেভাবে প্রচার করতে হচ্ছে তখন হয়তো তার কোন প্রয়োজনই হতোনা কোনদিন।

ভারতীয় প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাসের গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করবো। বহু বছর আগে পড়া। উপন্যাসটির নাম মনে নেই। গ্রামের এক মেধাবী তরুন উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতায় ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে আসে। প্রথম দিনেই সাক্ষাৎ মেলে এক নকশাল নেতার। ভর্তি সহ হোস্টেলে সিট পাইয়ে দেয়ার লোভ দেখিয়ে দলে টানে। সময়ে অসময়ে মিচিল মিটিং এ যাবারও তাগাদা দেয়। এভাবে এক পর্যায়ে দলীয় ক্যাডার থেকে সন্ত্রাসীতে পরিনত হয়। কোন এক রাজনৈতিক দাঙ্গায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার সময় তার পা গুলিবিদ্ধ হয়। কেটে ফেলার প্রয়োজন হয় পুরো পা। পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বারো বছর জেল কেটে অবশেষে স্ক্রেচে ভর দিয়ে হেঁটে আসে প্রিয়ার কাছে। লেখাপড়া তো দুরের কথা বিপন্ন জীবন নিয়ে বেঁচে থাকাটাই যেন হল তাঁর দায়!

গল্পের এ তরুণটির মতো নাফিসের জীবনে এরকম অন্ধকার নেমে আসুক তা আমরা কখনো চাইনা। আশার কথা, যুক্তরাষ্ট্র সরকার তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করেছেন বলে গত ২২/১০/১২ এর পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। সঠিক তদন্ত সাপেক্ষে যদি সে নির্দোষ প্রমানিত হয় তবে যাদের অপব্যাখ্যা বা ভুল তথ্য পরিবেশনের ফলে তার তথা বাঙ্গালি জাতির গায়ে জঙ্গিবাদের দুর্গন্ধ লেগেছে তাদেরকে যেমন বিচারের কাটগরায় দাঁড় করানোর দাবী থাকবে ঠিক তেমনি দোষী সাব্যস্ত হলে তারও দৃষ্টান্ত মুলক বিচার হোক তাই আমরা চাই। গত রবিবার আমেরিকার সবচেয়ে পুরনো সংগঠন লীগ অফ আমেরিকা "সন্ত্রাসী হামলার" পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছেন নাফিস আমাদের পরিচয় নয়। দিস ইস নট আওয়ার ফেস। আমি মনে করি সংগঠনটির সাথে সুর মিলিয়ে প্রবাসে বসবাসরত প্রতিটি বাঙ্গালিরই উচিত নিজস্ব অবস্থান থেকে বিদেশীদের কাছে এ বার্তাটি শ্লোগানাকারে পৌঁছে দেয়া – দিস ইস নট আওয়ার ফেস।