জিয়াকে বেগের চিঠিঃ খবরটির সত্যতা ও উৎস তুলে ধরা হোক

সাজেদুল আমিন চৌধুরী রুবেল
Published : 5 Feb 2013, 03:53 PM
Updated : 5 Feb 2013, 03:53 PM

'৭১এর মহান মুক্তিযুদ্ধে মেজর জিয়ার ভুমিকা নিয়ে কিছুদিন আগে কথা বলেছিলেন আমাদের মাননীয় আইন প্রতিমন্ত্রী। তিনি জিয়াউর রহমানকে পাকিস্তানের "গুপ্তচর" আখ্যায়িত করলে জনমনে তোলপাড় সৃষ্টি হলেও মন্ত্রীর এ কথায় সাধারন জনগন খুব একটা আস্তা আনতে পারেননি। কিন্তু এবার আরও এক ধাপ এগিয়ে আমাদের সময়ের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ বোরহান কবির কাগজে কলমে তা প্রকাশ করলেন। খবরটি প্রকাশের পর পরই ফেসবুক, ব্লগের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলো সহ সাধারন মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সংবাদটি যদি স্বচ্ছ বা প্রকৃতই সত্য হয়ে থাকে তবে ইতিহাসের চাকা অন্য ভাবে ঘুরবে। নায়ক খলনায়কের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে সন্দেহ নেই।

আমাদের সময় ডট কমে প্রকাশিত সংবাদটির শিরোনাম হচ্ছে "জিয়াকে লেখা কর্নেল বেগের চিঠি" যার প্রতিপাদ্য বিষয় সম্ভবত এখন আর কারো অজানা নয়। তবু আলোচনার স্বার্থে আমি আবারো কিঞ্চিৎ ভাবে তুলে ধরছি। কর্নেল বেগ একজন পাকিস্তানি আর্মি অফিসার যিনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ঠেকাতে মরিয়া হয়ে কাজ করছিলেন। পক্ষান্তরে মেজর জিয়াউর রহমান একজন বাঙ্গালি অফিসার। সেক্টর কমান্ডার ও মুক্তিযোদ্ধা। অথচ তাঁকেই ওই পাকি অফিসার ১৯৭১ সালের ২৯ মে একটি চিঠি লিখেন যেখানে ফুটে উঠেছে তাদের গোপন যোগসূত্রতার ইঙ্গিত। ওই চিঠিতে বেগ জিয়ার কাজের প্রশংসা করেন এবং দ্রুত তাঁকে নতুন কাজ (New job – পদোন্নতির ইঙ্গিত) দেয়ার কথা উল্লেখ করেন। স্ত্রী সন্তানদের কুশলাদি জানিয়ে উদ্বিগ্ন না হতে ও মেজর জলিল সম্পর্কে আরও সতর্ক থাকার পরামর্শের কথাও উল্লেখ রয়েছে ঐতিহাসিক এ চিরকুটটিতে। চিঠিটির সত্যতা স্বীকার করে নিলে এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, '৭১ এ জিয়াউর রহমান বাঙ্গালিদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে নেমেছিলেন বটে, কিন্তু কাজ করেছিলেন পাকবাহিনীর নিচক এজেন্ট হিসেবে। যার নামের সাথে রয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধার গর্বিত খেতাব সেই তিনি কিনা একজন কলঙ্কিত গুপ্তচর! ভাবতেও কষ্ট হয়! গা শিহরিয়া উঠে। ন্যুন্যতম দেশপ্রেমও যদি কারো মাঝে থেকে থাকে তাঁর পক্ষেও এমন আজ্ঞাবহ বৃত্যের মতো এভাবে পবিত্রতা নষ্ট করা সম্ভবপর নয়।

১৯৯৫/৯৬ সালের কথা। "ছন্দালোক" নামের একটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন বাজারে এসেছিল। অর্থনৈতিক দৈন্যতার জন্য এটি বেশিদিন বাজারে টিকে থাকতে পারেনি। ওখানে সহ সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেছিলেন কবি ও মুক্তিযোদ্ধা আওলাদ হোসেন। জানিনা ভদ্রলোক আজ কোথায় কিভাবে আছেন। কাপাসিয়ার মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা লিখতে গিয়ে তিনি কিছু রাজাকার (প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযোদ্ধা) চরিত্র তুলে ধরেছিলেন। পাকিদের কাছে রাজাকার সেজে মূলত তারা কাজ করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। দেশের জন্য। বাহ্যিক দৃষ্টিতে তারা রাজাকার হলেও বস্তুত তারা ছিলেন খাঁটি দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের সময়ে প্রকাশিত চিঠিটি পড়ে আজ এতো দিন পর মনে হল, রাজাকার সেজে যদি কেউ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার ভুমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন, তাহলে মুক্তিযোদ্ধার পোশাক পড়ে কেউ কেউ রাজাকার আলবদর কিংবা পাকিদের এজেন্ট বা গুপ্তচর হিসেবে কাজ করবেন তাতে আশ্চর্য হবার কি-ই বা থাকে!

'৭৫ এর ১৫ আগস্টের ঘটনায় নিজেকে রহস্যময় করে রাখা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা ও আটকদের মুক্তি দেয়া, গোলাম আযমকে পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে আনা, জামায়াতকে রাজনীতি করার সুযোগ দেয়া, স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী বানানো, সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মুছে ফেলা, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিভিন্ন ভাবে পুরস্কৃত করা ও ইনডেমনিটি বিলের মাধ্যমে তাঁর হত্যার বিচারকে বন্ধ করে দিয়ে জিয়াউর রহমান নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুললেও তাঁর মুক্তিযুদ্ধ ছিল প্রশ্নাতীত। বীর বাহাদুর মুক্তিযুদ্ধা হিসেবেই ছিল তাঁর খ্যাতি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি ছিলেন জেডফোর্সের একজন অধিনায়ক। অথচ তার প্রতি জনগনের এ বিশ্বাসকে তরমুজের পিসের মতো কেটে ফেলল প্রকাশিত একটি চিঠি। যা কিনা বিয়াল্লিশ বছর পর গুপ্তচরবৃত্তির অপবাদ দিয়ে নতুন ভাবে জনসমক্ষে উন্মোচিত করলো তাঁর চরিত্রের আসল স্বরূপ।

কিন্তু এরপরও কথা থেকে যায়। প্রকাশিত খবর বা চিঠিটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জনমনে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। সত্যিই কি কর্নেল বেগ মেজর জিয়াকে এ ধরনের কোন চিঠি লিখেছিলেন? নাকি নিচক রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য নোংরা কারসাজি মাত্র? সাধারণ মানুষের মনে এ ধরনের প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে বার বার। মনে রাখতে হবে, ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনা। আজ স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থের জন্য যদি কেউ এ ধরনের কৌটিল্যের আশ্রয় নিয়ে থাকে তবে তাঁকেও একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে নিশ্চিত। তাই খবরটির বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তোলার জন্য, দেশ ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস রক্ষার স্বার্থে প্রকাশিত এ ঐতিহাসিক চিঠিটির সত্যতা ও উৎস সম্পর্কে স্বচ্ছতার সাথে জনসমক্ষে বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরার জন্য আমাদের সময় কর্তৃপক্ষ কিংবা এর নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ বোরহান কবিরকে অনুরোধ জানাচ্ছি।