চলতি সংসদেই মানবতাবিরোধী আইন সংশোধন করুন

সাজেদুল আমিন চৌধুরী রুবেল
Published : 9 Feb 2013, 06:02 PM
Updated : 9 Feb 2013, 06:02 PM

মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধী হিসেবে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায় দেশের বৃহৎ অংশকে আশাহত করেছে। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে দেশে বিদেশে বসবাসরত কোটি বাঙ্গালি হৃদয়ে। অপ্রত্যাশিত খবরটি শুনে সবার মতো আমিও ব্যথিত হয়েছি। তবে অতি উৎসাহী কিংবা আবেগপ্রবণ অনেকের মতো পাইকারি হারে সরকারকে দোষারোপ করে তাঁদের সকল অর্জনকে ম্লান করে তোলা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছি। আমি যেখানে বসবাস করি অর্থাৎ আয়ারল্যান্ডে নেতৃস্থানীয় কিছু লোকের সঙ্গে কথা বলে এ রায় সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তাঁরাও সরকারের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে এক ধরনের ইঙ্গিত সুচক সন্দেহ পোষণ করেন। দেশেও সাধারন জনতা থেকে শুরু করে ফেসবুক, ব্লগ প্রভৃতি সামাজিক মাধ্যম গুলো রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সরকারকেই অধিকাংশে দায়ী করেছে। কেউ কেউ সরকারকে জামায়াতপোষক বা এ দলের সাথে সমঝোতাকারী কিংবা জামায়াত ভীরু বলে খেদোক্তি করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। কেউ আবার খোদ প্রধানমন্ত্রীকেই অকথ্য ভাষায় তুলোধুনো করে ছেড়েছেন। এখানেই শেষ নয়। অনেকে শেখ হাসিনার সরকারের বিরদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে আগামীতে ভোট না দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন ও অন্যকেও আহ্বান জানিয়েছেন।

জাতি হিসেবে আমরা খুবই আবেগপ্রবণ। কিন্তু আবেগ দিয়ে কবিতা, উপন্যাস সৃষ্টি করা গেলেও বিচারে আবেগের স্থান নেই। আবেগপ্রসুত বিচার সাধারণত সঠিক হয়না। কসাই কাদেরের অপ্রত্যাশিত রায়ে তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় আবেগতাড়িত হয়ে আমরা যেভাবে সরকারের প্রতি সন্দেহের তীর ছুঁড়ে অনাস্থা জ্ঞাপন করছি তা কেবল এ সরকার ও দেশের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ নয় বরং আমাদের প্রত্যাশিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগই একমাত্র শাসক দল যা কিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে সক্ষম ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। চল্লিশ বছর ধরে কতো দলই তো ক্ষমতায় এলো, গেলো। কই! এ বিচার নিয়েতো কেউ মাথা ঘামায়নি। বিচার তো দুরের কথা, লক্ষ মানুষের রক্তে কেনা সংবিধানটিকে কলমের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করে নিষিদ্ধ রাজাকারদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধীদের দলে ভিড়িয়ে মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছে। রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে এনেছে। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে, যা এখনো অব্যাহত। মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বর্তমান বিচার প্রক্রিয়াকে ভণ্ডুল করার জন্যও ওদের কুটিল চক্রান্তের কোন শেষ নেই। সুতরাং, আমরা যে যাই বলিনা কেন, রাজাকার, আলবদর-আলশামস তথা মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সম্পন্ন করতে হলে আওয়ামী সরকারের কোন বিকল্প নেই।

তবে হ্যাঁ, কাদের মোল্লার অপ্রত্যাশিত রায়টি নিয়ে সরকারের প্রতি জনমনে যে ধিক্কার, বিদ্বেষ, অসন্তোষ ও সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে তা সরকারকে অবশ্যই হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। জামায়াতের সাথে সরকারের গোপন আঁতাতের যে দূষিত খবর বাতাসে ছড়িয়েছে সে দায় থেকেও সরকারকে মুক্ত প্রমান করতে হবে। অন্যথায় কাদের মোল্লা তথা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবীতে প্রদীপে প্রজ্বলিত শাহবাগ স্কয়ারে উত্তাল জনতার যে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন তা ক্রমান্বয়ে দূর্বার বেগে সরকারের দিকেই ধাপিত হবে। তাই লাখো মানুষের দাবী ও অনুভূতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই সরকার বিবেচনায় নেবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।

যেদিন এ রায় প্রকাশ পেয়েছে সেদিনই সরকার ও আওয়ামীলীগের তরফ থেকে প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়েছে, তারা এ কলঙ্কিত রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে। কিন্তু পত্রপত্রিকা পড়ে যতোটুকু জানতে পেরেছি তা হল যে মামালা গুলোর বিপরীতে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন জেলের রায় হয়েছে সে রায়ের বিরুদ্ধে আসামি আপিল করতে সুযোগ পেলেও বাদী বা রাষ্ট্র পক্ষের ক্ষেত্রে সে রকম কোন সুযোগ নেই। যদি এটাই প্রকৃত আইন হয়ে থাকে তাহলে যে মামলাটিতে কাদের মোল্লা খালাস পেয়েছে কেবলমাত্র সেই মামলাটির উপর ভিত্তি করেই সরকার পক্ষ আপিল করতে সক্ষম হবে। কিন্তু একবার যে মামলায় একজন বেকসুর খালাস পেয়েছে সেই একই অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসিতে ঝোলানো মোটেই সহজ কাজটি নয়। সে ক্ষেত্রে যে মামলাগুলোতে কাদের দণ্ড পেয়েছে সেই দণ্ডিত রায়ের বিরুদ্ধেও আপিল করার জন্য সুযোগ বা ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। এ জন্য যদি মানবতাবিরোধী আইনে কোন সংশোধন বা সংযোযন ঘটাতে হয় কিংবা নতুন করে আইন প্রনয়ন করার প্রয়োজন হয় তবে তাই করতে হবে।

আশার কথা, আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৭৩- এর আপিল আইন সংশোধনের জন্য সরকার চিন্তা করছে বলে জানিয়েছেন আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম আজ মিডিয়াকে জানান। আইনমন্ত্রী দেশে এলেই এ ব্যাপারে চুরান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বলেছেন। তাঁর এ বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে বলতে চাই, দয়া করে মোটেও কালক্ষেপন করবেননা। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে পরে পস্তাতে হয়। তাই এ চলতি সংসদ অধিবেশনেই এ ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন করুন।

শাহবাগ চত্বর থেকে দেশে বিদেশে বসবাসরত প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাঙ্গালির হৃদয় চত্বরে কসাই কাদেরের ফাঁসির দাবীটি গর্জে উঠছে। আবাল বৃদ্ধ বনিতার উপস্থিতে লাখো মানুষের যে মহাসম্মেলন সেখানেও কেবল ওই একটি দাবীই আকাশে বাতাসে প্রকম্পিত হচ্ছে – কাদের মোল্লা সহ সকল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই। নতুন প্রজন্ম সহ স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির এ দাবী ও প্রত্যাশাকে বাস্তবায়নের দায়িত্ব এখন সরকারের। কোন ভুল চিন্তা বা মোহের বশে সরকার এ বিরল সুযোগকে হাতছাড়া করবেননা বলেই আমার বিশ্বাস।