যে বিজয়ে জাতির মুক্তি

সাজেদুল আমিন চৌধুরী রুবেল
Published : 16 Dec 2015, 10:32 AM
Updated : 16 Dec 2015, 10:32 AM

এবার এমন একটি সময়ে বিজয় দিবস উদযাপিত হতে যাচ্ছে যখন সারা বিশ্ব জঙ্গি তৎপরতায় অস্থির। আমাদের দেশও এ রাহুদশা থেকে মুক্ত নয়। তবে যে দলটি কখনো জঙ্গিবাদকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেয়নি, বরাবরই জিহাদ ঘোষণা করে আসছে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে, সৌভাগ্যক্রমে সে দলটিই আজ দেশের শাসন ক্ষমতায়। এ দলের নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছিলো, জনগন বিজয়ের লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল। যে মহান নেতা অপরিসীম সাহস, ত্যগ তিতিক্ষা ও দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে বাঙ্গালি জাতিকে একটি মানচিত্র উপহার দিয়ে যেতে পেরেছিলেন, তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। শত প্রতিকূলতার মাঝেও জঙ্গি দমন সহ দেশকে উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর যে নিরলস প্রচেষ্টা তা সত্যি অভূতপূর্ব। যারা প্রত্যক্ষ ভাবে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত কিংবা পরোক্ষভাবে পর্দার আড়াল থেকে জঙ্গিবাদকে মদদ দিতে কলকাটি নাড়ায় তাদের কেউই এ সরকারের আমলে রেহাই পাচ্ছেনা। এমনকি আজ থেকে ৪৪ বছর আগে মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ডে যারা লিপ্ত ছিল তাদেরকেও বর্তমান সরকার কোন রকমের ছাড় দিচ্ছেনা। দেশি বিদেশি রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এদেরকে আইনের আওতায় এনে দণ্ড কার্যকর করার মধ্য দিয়ে সরকার অন্তত তাই প্রমান করতে সক্ষম হয়েছে।

তবে এ জন্য সরকারকে অনেক খড়কুটো পোহাতে হয়েছে। পিচ্ছিল পথ বেয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছাতে এখনো বার বার হোঁচট খেতে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। কারন যে আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা হয়েছিলো, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর তা সবই হারিয়ে যায় সামরিক শাসনের করাল গ্রাসের ভেতর। পবিত্র সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে এর মুলমন্ত্রকেই ভূলুণ্ঠিত করেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা যাবেনা মর্মে "ইনডেমনিটি" নামের এক ইতিহাস নিকৃষ্টতম আইন করেই ক্ষান্ত থাকেননি জিয়া সাহেব, তিনি স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার ও আলবদরদের রাজনীতিতে টেনে এনে নিজে দল গঠন করেন এবং পরবর্তীতে তাদেরকে মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করার সুযোগও তিনি করে দেন। শুধু তাই নয় রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে এনে জামাই আদরে রাখলেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত, মুসলিমলীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করলেন। বড্ড ঠাণ্ডা মাথায় মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার সহ অনেক সামরিক অফিসারকে হত্যা করেন।

ক্ষমতাকে জায়েজ করার জন্য অর্থ ও অস্ত্রের জোরে সেনাছাউনিতে গড়ে তোলা হল রাজনৈতিক দল। জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এরশাদ সাহেবও একই পথ অনুসরণ করলেন। সামরিক সংস্কৃতিতে গড়ে উঠা এসব দলের বস্তুত কোন মৌলিক ধ্যান ধারণা ছিলোনা। ভিন্ন ভিন্ন দল থেকে আসা ওইসব সুযোগসন্ধানী নেতাদের মতাদর্শ বা রাজনৈতিক দর্শন মোটেও এক ছিলোনা। প্রবাসে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত লোকজন কোন একটি এলাকায় বসবাস শুরু করলে যেমন "মাল্টি কালচার" (মিশ্র সংস্কৃতি) গড়ে উঠে তেমনি সেনানায়কদের ওই দলগুলোর মাঝেও বিরাজ করে একই ধরনের অবস্থা। ফলে দেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অর্থাৎ কোন ক্ষেত্রেই দেশ আশানুরূপ ভাবে এগিয়ে যেতে পারেনি।

সেনাশাসকদের মরণকামড় থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করার জন্য দেশের মানুষ আবারো জেগে উঠলো। অনেক আন্দোলন ও রক্তপাত হল। অবশেষে নূরহোসেন, ডাঃ মিলন, প্রমুখের আত্মত্যগের বিনিময়ে দেশ গনতন্ত্র ফিরে পেলো।

গণতান্ত্রিক ধারায় বাংলাদেশ জাতীয়তা বাদী দল বিএনপি দুবার ক্ষমতায় গেলেও তারা তাদের অতীত মতাদর্শ থেকে একচুলও বিচ্যুত হয়নি। জিয়াউর রহমান ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য দেশবিরোধী রাজাকারদের দুধকলা দিয়ে পোষেছে, নিষিদ্ধ জামায়াতকে রাজনৈতিক ভাবে পুনর্বাসন করেছে তেমনি বেগম জিয়াও একই উদ্দেশ্যে জামায়াতকে হাতছাড়া করেননি। তার কৃপায় রাজাকাররা মন্ত্রী হয়েছে, ওদের গাড়িতে দেশের পতাকা পত পত করে উড়েছে। শুধু তাই নয়, দেশের মূলধারার রাজনীতির সাথে যে দলটি সম্পৃক্ত সে দল অর্থাৎ বাংলাদেশ আওয়ামীলীগকে চিরতরে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য শেখ হাসিনা সহ দলের সকল জ্যাষ্ঠ নেতাদের হত্যা করার পরিকল্পনায় আরেকটি ঘৃণিত ২১ আগস্টের জন্ম দেয়।

কথায় আছে, "রাখে আল্লাহ মারে কে"। এতো কিছুর পরও আওয়ামীলীগকে নিধন করা গেলনা। পরবর্তীতে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসে দলটি। আওয়ামীলীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের হাল ধরেন। তিনি ক্ষমতায় এসেই দেশকে উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার বিচার সহ দেশ ও মানবতা বিরোধী '৭১ এর আলবদর রাজাকারদের বিচারের আওতায় এনে দেশকে কলঙ্ক মুক্ত করতেও সক্ষম হন।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের জন্য একটি গোষ্ঠী উঠেপড়ে লেগেছিল। জঙ্গি কার্যক্রম চালিয়ে দেশকে অচল করে দেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু হাসিনা সরকার অত্যন্ত কৌশলে ও দক্ষতার সাথে তা দমন করতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে পালাক্রমে কয়েকজন ব্লগার ও দুই বিদেশীকে হত্যার মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল ও সরকারকে বিপদ্গ্রস্থ করার হীন চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিলো মহলটি। কিন্তু এতেও ফলাফল অশ্বডিম্ব ছাড়া কিছুই হয়নি। জাতি হিসেবে বিদেশীদের কাছে আমাদের মাথা কিঞ্চিৎ হেট হয়েছে বটে, কিন্তু সরকার বহাল তবিয়তে নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলছে।

বিএনপি জামায়াতের জঙ্গি কার্যক্রম সরকারকে মূলত কোন রকমের বেকায়দাতেই ফেলাতে পারেনি। কারন একটাই- বাংলাদেশের শান্তিকামী জনগন এসবে বিশ্বাসী নয়। ত্রিশ লাখ শহীদ আর দু লাখ মা- বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া দেশটি সিরিয়া, ইরাক কিংবা আফগানিস্তানের মতো হয়ে যাক তা বাংলার জনগন কশ্মিন কালেও চায়না। তাই শত চেষ্টা করলেও ওরা কোনদিন কামিয়াব হতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস হয়না।

তবে সরকারকে মনে রাখতে হবে, " ঘরের শত্রু বিভীষণ।" এমনও অনেকে থাকতে পারেন যারা আওয়ামীলীগের পোশাক পড়ে বিএনপি জামায়াতের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। এদের ব্যপারে সরকারকে বড্ড সতর্ক থকতে হবে। কারণ, ওরা মীরজাফরের জাত। যেখানে খায় সেখানেই মল ত্যাগ করে।

দলের ভেতরে অনেক ক্ষমতাবান ব্যক্তি আছেন যারা স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত। ক্ষমতার অপব্যবহার করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। কিছু কিছু নেতা, উপনেতা, পাতিনেতা বা টাউট শ্রেণীর লোকও রয়েছে যারা দলের নাম ভাঙ্গিয়ে চুরিচামারি ও বাটপাড়িতে লিপ্ত থাকে নিজেদের আখের গোছানোর জন্য। ওদের কুকর্মের জন্য সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়। সকল অর্জন ম্লান হয়ে যায়। তাই ওদের ব্যপারে সরকারকে গা ছাড়া ভাব দেখালে চলবেনা। বরং শক্ত হাতে ওদেরকে দমন করতে হবে। সরকার যদি সত্যি সত্যি "দুষ্টের দমন আর শিষ্টের লালন" নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে এগিয়ে চলেন ও দুর্নীতির মূল উৎপাটনে আঘাত হানতে সক্ষম হন তবে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ দরদী এ সরকার যে যুগ যুগ ধরে অবস্থান করবে সাফল্যের বিজয় চূড়ায় তাতে কোন সন্দেহ নেই।

উপসংহারে বলবো, ৪৪ বছর ধরে জাতি বিজয় দিবস পালন করে আসছে বটে কিন্তু প্রকৃত বিজয়ের স্বাদ কখনো উপলব্ধি করতে পারেনি। এক ধরনের অপূর্ণতা বুক ভারী করে তুলত। হৃদয়ে ঘটাত জ্বালাময়ী পীড়ন। স্বাধীন দেশের পবিত্র মাটিতে ৭১এর হিংস্র অসুরদের অস্তিত্ব মানুষকে হতবিহবল করে তুলত। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য জাতিকে নতুন মাত্রা দান করে। বিশেষ করে ২০১৩ সালের ১০ ডিসেম্বর কসাই কাদের মোল্লা ও এ বছর ১১ এপ্রিলে ঘৃণিত গুপ্ত ঘাতক কামরুজ্জামানের ফাঁসি এবং পরিশেষে গত ২১ নবেম্বর রাতে একই সময়ে একই জায়গায় দুই কুখ্যাত রাজাকারের অবিশ্বাস্য দ-কার্যকর করার মধ্য দিয়ে সরকার যে নববিজয়ের ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তা সত্যি অতুলনীয়। এ বিজয় জনমনে যে আনন্দ উচ্ছ্বাস ও রোমাঞ্চকর অনুভুতির সৃষ্টি করেছে তা যেন ৭১ এর বিজয়ের আনন্দের চেয়েও কোন অংশে কম নয়।

বিজয়ের এ ধারা জলন্ত মশাল হয়ে যুগ যুগ উত্তাপ ছড়িয়ে যাক, তবেই কেবল জাতির মুক্তি।

লিমরিক, আয়ারল্যান্ড
১৫/১২/১৫