প্লিজ প্রধানমন্ত্রী, এখনো সময় আছে

সাজেদুল আমিন চৌধুরী রুবেল
Published : 7 Oct 2011, 04:51 PM
Updated : 7 Oct 2011, 04:51 PM

পেশাগত ব্যস্ততায় দরুন যথাসময়ে সঠিক লিখাটা লিখে উঠতে পারিনা। লোকাল ট্রেনের মতোই যেনো আমার লেখার গতি। লেখক হিসেবে এটা আমার এক ধরনের ব্যর্থতাই বলা চলে।

কিছুদিন আগে জাতীয় শোক দিবসে ১৫ আগষ্টের উপর একটি লিখা লিখতে গিয়েও শেষ করতে পারিনি। শেষ করবো করবো ভাবতে ভাবতে সামনে চলে এলো ঈদ। ভাবলাম লিখবো ঈদ নিয়ে। তাও আর হয়ে উঠেনি। দু'টি দিন ছুটি পেয়েও লিখার জন্য দু' মিনিট বাজেটে রাখতে পারিনি। নিজের বাসায় আথিয়তার পর্ব শেষ করে বন্ধু-বান্ধবের বাসায় বেড়িয়ে ও স্কাইপের বদৌলতে বিনা পয়সায় ঘন্টার পর ঘন্টা দেশে কথা বলে দু' টো দিন শেষ করে দিলাম। তবে ঈদের দিন সন্ধ্যার আড্ডাটা ভালোই জমেছিল। ডোরাডয়েলে এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে পেলাম সস্ত্রীক রেজা ভাইকে। ভদ্রলোক এখানে লিমরিক ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সাইন্সে পিএইচডি করছেন। স্ত্রী কানাডায় ইউনির্ভাটি অব রিজায়নাতে মাইক্রোবায়োলজিতে। আমি ভেবেছিলাম তার স্ত্রী হয়তো কানাডাতেই আছেন। কিন্তু তিনি স্বামীর টানে টানা দু' সপ্তাহের ছটি নিয়ে আয়ারল্যান্ডে আসেন ঈদ করতে। তাদেরকে দেখে আমার খুব ভালো লাগলো। রেজা ভাই আমার সাথে কোলাকোলি শেষ করে বললেন, 'বাংলানিউজে আপনার লেখা পড়লাম। আপনি যে লিখেন তাতো জানতাম না। তার আক্ষেপ-লেখালেখির ওপর তিন মাসের একটি কোর্স করেও একটি 'ল' লিখতে পারেন নি। আমার কেনো জানি মনে হলো- তার মতো ব্রিলিয়েন্ট লোক লিখলে জাতি সত্যি উপকৃত হতো।

তার স্ত্রীর সাথে কথা বলে বুঝা গেলো আয়ারল্যান্ডের জীবনযাত্রার মান কানাডার চেয়েও ব্যায়বহুল। হাউজ রেন্টসহ দ্রব্যমূল্যের দাম প্রায় অর্ধেক বললেই চলে। কানাডিয়ানরা ওয়েল কামিং এর ক্ষেত্রে আইরিশদের তুলনায় অনেক বেশি উদার বলে মনে হলো তার কাছে।

গল্প করার লোভ সংবরণ করতে না পেরে তাদেরকে নিয়েই গেলাম আরেক বন্ধু বর আসলামের বাসায়। তার স্ত্রী জলি ভাবি এক শরিফা মহিলা। শুধু গল্পে পেট ভরবে না। তাই নাছোড়বান্দা তিনি, না খাইয়ে ছাড়বেন না। আমি ভর্তা প্রিয় লোক বলে এতো রিচ ফুডের ভিড়েও কয়েক আইটেমের ভর্তা বানালেন। ভাবির দেশীয় রান্না আর আমার স্ত্রীর বাড়ির পেছনের সব্জি বাগান, এসব দেখলে ভাবাই যাবে না আমরা বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়ে আছি। খেয়েদেয়ে আড্ডা শেষ করে প্রায় শেষ রাতে বাড়ি ফিরলাম।

ফিরে যাই ১৫ আগষ্টে কথায়। ওই দিন মনটা ভালো ছিল না, সাথে মেজাজটাও। শোক দিবস পালনের জন্য আয়ারল্যান্ডস্থ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ডাবলিন শাখার উদ্যোগে মিলাদ, আলোচনা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছিলো। আহবায়ক মিরাজ ভাই বেশি ক'বার টেলিফোনে অনুরোধ করেছিলেন এ সভায় যোগদানের জন্য। পেশাগত দায়িত্বকে অবহেলা করতে না পেরে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও এ অনুষ্ঠানে যোগদান করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। হোটেল জব করি। ব্যবসা যখন রমরমা তখন আঠারো-বিশ ঘন্টা কাজ করেও ম্যানেজমেন্টকে খুশি করা যায়না। আবার ব্যবসায় যখন ভাটা পড়ে তখন আট ঘন্টার স্থলে চার ঘন্টা কাজ করে চলে গেলেও দোষ নেই।

১৫ আগষ্ট ডে অফ অনুরোধ করেও ছুটি পাওয়া যায়নি। ফাইভ স্টার হোটেল। হাই প্রোফাইল সম্পন্ন কিছু ভিআইপি গেষ্ট আসবেন। সিনিয়র স্টাফদের একজন হিসেবে তাঁদের তদারকি করার দায়িত্ব আমার উপরো বর্তায়। এফএন্ডবি ডিপার্টমেন্টে চাকরি করার সুবাদে বিল ক্লিনটন, টাইগার উড থেকে শুরু করে আমাদের ডক্টর ইউনুস পর্যন্ত এ ধরনের ভিআইপিদের অনেককে খুব কাছ থেকে তদারকি করার সৌভাগ্য আমার হয়।

দু' হাজার চারের শেষ দিকে ডঃ ইউনুস আমেরিকান ভিআইপি প্রতিনিধি দলের সাথে আমার হোটেলে আসেন এবং রেস্টুরেন্টে আমাকে প্রথম দেখতেই বলে উঠলেন, 'আরে মিয়া তুমি এখানে?' ইচ্ছে করছিলো পশ্চিমা কায়দায় গ্রিটিংস না করে সাদাসিধে এই মানুষটিকে পা ছুঁয়ে সালাম করতে। হোটেল-রেস্টুরেন্টে কিছু বাধ্যবাধকতা বা বিধিমালা থাকে বলে তা আর হয়ে উঠেনি।

হোটেলে আগত ভিআইপি প্রতিনিধিদের একজন মি. রেড ফিসার। কানাডিয়ান সাংবাদিক। কিছু কিছু চেহারা আছে দেখলেই শ্রদ্ধা জাগে। আমার মনে হলো তিনিও সেই দলেরই একজন। তাঁর দেখবাল করার দায়িত্ব আমার উপর। তদারকির ফাঁকে ফাঁকে আলাপচারিতার মাধ্যমে যখন জানলেন আমি বাংলাদেশি তখনি চোখ থেকে হাই পাওয়ারের চশমাটা খুলে আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললেন,-'জাতি হিসেবে তোমরা খুবই অতিথি পরায়ন ও বিনয়ী হলেও অকৃতজ্ঞ।' কথাটা কাঁটার মতো আমার আঁতে বিধলো। পলাইট কনভারসেশন যেখানে আমার ক্যারিয়ারের ক্রেডিবিলিটি বাড়ায় সেখানে উত্তেজিত হয়ে বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার কোনোই অবকাশ নেই। নিজেকে বড় কষ্টে সামলে নিয়ে তাঁকে বুঝতে না দিয়ে ঠোঁটে স্মিত হাসির রেখাটা রেখেই প্রশ্ন করলাম, 'কেনো স্যার?' বললেন, বিশ্বে যে ক'জন নেতার আবির্ভাব ঘটেছে তাঁদের মধ্যে তোমাদের মুজিব (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) একজন। যাঁর নেতৃত্ব ও নামের উপর তোমরা স্বাধীনতা পেলে, জাতি ও জাতীয়তবাদ নিয়ে গর্ব করার সুযোগ পেলে সেই মহান লোকটিকে তোমরা বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা করে দিলে!

অবাক বিষ্ময়ে ঐ বিদেশি লোকটার কথা শুনলাম। একটু আগেই তাঁর প্রতি যে বিরক্তি ও ঘৃণার উন্মেষ ঘটেছিলো তা যেনো উবে গেলো কর্পুরের মতো। সেনসেটিভ বিষয় বলে কথা না বাড়িয়ে শুধু বললাম 'ইউ আর রাইট, মি. ফিসার।' বুকটা হালকা হতো যদি এক ধলা থুথু দিতে পারতাম ঐ সব বিপথগামী কুলাঙ্গারদের (যারা এখনো জীবিত) যারা বঙ্গবন্ধুর মতো মহান মানুষটিকে নির্মমভাবে হত্যা করে দেশকে লেপন করেছে কলঙ্কের কালিমায় আর জাতিকে বানিয়েছে অকৃতজ্ঞ।

প্রিয় পাঠক, এ পর্যন্ত লিখেই লেখাটি ড্রয়ারবন্দি করে রেখে দিই। ব্যক্তিগত ঝামেলা ও ব্যস্ততার দরুন এর সমাপ্তি রেখা টানতে পারিনি। ৪ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১১টায় লন্ডন থেকে স¤প্রচারিত একটি টিভি চ্যানেলে শোয়েব আহমদ চৌধুরীর উপস্থাপনায় 'স্ট্রেইট ডায়ালগ' নামের রাজনৈতিক টকশোটি দেখছিলাম। এতে অতিথি হিসেবে এলেন ডঃ অলি আহমেদ । ভাবলাম, আমার বাসি লিখাটায় জনাব অলির কিছু টাটকা কথা সংযোজন করে চালিয়ে দিতে পারলে মন্দ হয়না।

কথায় কথায় মুখে আল্লাহ-রাসুলের নাম এনে নিজেকে একজন খাঁটি মুসলমান দাবি করে সাবেক এ মন্ত্রী যেভাবে কথা বলেছেন, তাতে মনে হয়েছে তিনি যেনো কেবল আওয়ামী লীগের বদনাম ও বিএনপির সাফাই গাইতেই এসেছেন এ অনুষ্ঠানটিতে। অথচ কিছুদিন আগেই গোস্বা করে বিএনপি থেকে বেরিয়ে এলডিপি প্রতিষ্ঠা করেন। সে বিষয়ে আজ আর যাবোনা। টকশোতে যেসব কথা বলেছেন তার কিঞ্চিত পরিমান পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চাই।

আলোচনার শুরুতেই তিনি বলেছেন, দেশ আজ মহা সংকটে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বর্তমান সরকারের পতন অনিবার্য। গত বিএনপি সরকারের আমলে জলিল সাহেবও এ ধরণের একটি মন্তব্য করেছিলেন- তা তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে কিভাবে তিনিও এ ধরনের একই কথার পূনরাবৃত্তি করছেন, উপস্থাপক শোয়েব জানতে চাইলে উত্তরে বলেন,'তার অন্তরাত্মা বলছে, স্বয়ং আল্লাহ তার কানে বার্তা পাঠিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তিনি বঙ্গবন্ধু বলতে নারাজ। তার ব্যাখ্যা- 'বঙ্গবন্ধু' তো তাঁর নাম নয়। তাঁর নাম শুধুই শেখ মুজিবুর রহমান।

তৃতীয়ত: মুক্তিযুদ্ধ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে হয়নি। তার ভাষায়, তিনি কি করে নেতৃত্ব দেবেন! যুদ্ধ চলাকালীন সময়তো শেখ মুজিবতো পাকিস্তানের জেলে বন্দি ছিলেন।'

বাহ, কর্ণেল সাহেব, বাহ! খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাও আপনি! তো অলি আল্লাহর খাসবান্দা অলি সাহেবকে বলি, আল্লাহর সাথে আপনার কানেকশন এতোই যখন প্রবল তাহলে ডিসেম্বর পর্যন্ত এতো দীর্ঘ সময় নেয়ার কি প্রয়োজন! দু' একদিনের মধ্যে সরকারকে উচ্ছেদ করে দেশকে মহাসংকটের হাত থেকে রক্ষা করাই শ্রেয় নয় কি? তাছাড়া রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য টাই কোট পড়ে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর কি দরকার? একটি লাল সালু কিনে চট্টগ্রামের কোন পাহাড়ি ছুঁড়ায় গিয়ে বসে পড়ুন। ভালো করতে পারবেন।

দেশে-বিদেশের লক্ষ কোটি জনতা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানে। শেখ মুজিবকে নতুন করে 'বঙ্গবন্ধু' বা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী নেতা হিসেবে পরিচয় করানোর কোনোই আবশ্যকতা নেই। আপনার মতো একজন কর্ণেলের বিতর্কিত মন্তব্যে কি-ই বা যায় আসে!

আল্লাহওয়ালা কায়দায় কথা বলে নিজেকে বার বার খাঁটি মুসলমান বলেছেন। অথচ মিডিয়ার উদারতার সুযোগ নিয়ে কাণ্ডজ্ঞানহীন ভাবে মিথ্যেচার করেছেন। 'জন্মিলে মরিতে হবে' পড়েছেন নিশ্চই। যে আল্লাহ কানে বার্তা পাঠিয়েছেন বলে দাবি করেছেন, তাঁর কাছেই কিন্তু কৃতকর্মের জবাবদিহি করতে হবে একদিন। সাধু সাবধান!

দেশ খুব ভালো চলছে। সরকার ধোয়া তুলসী পাতা তা' আমি বলবো না। পাগলা ঘোড়ার মতো দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, আইনশৃংখলার চরম অবনতি, সন্ত্রাস-রাহাজানি ও খুনের ব্যাপকতা, শরণকালের মতো যোগাযোগ ও রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা, ঘুষ-দুর্নীতির ব্যপকতা, শেয়ার মার্কেটে কেলেংকারি, পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব প্রভৃতি সমস্যার কবলে দেশ জর্জরিত। মোটেও ভালো নেই দেশ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই- দয়া করে জেদাজেদি করবেন না। দেশ বিদেশে আপনার অনেক শুভাকাঙ্খি আছেন যাঁরা আপনার বা আপনার সরকারের গঠনমুলক সমালোচনা করছেন। তাঁদেরকে ভুল বুঝবেন না। তাঁরাতো কেবল জনগণের অন্তরের অনুভূতিটা আপনার সামনে তুলে ধরতে চান। তাঁরা আপনাকে ও আপনার বাবাকে ভালোবাসেন, আওয়ামী লীগকে ভালোবাসেন। ওরাই আপনার সত্যিকারের বন্ধু। যারা স্বার্থের মোহে, ক্ষমতার লোভে আপনার আশেপাশে ঘুর ঘুর করছে, মুসাহেবি ও চাটুকারিতার মাধ্যমে আপনাকে ভুল পথে পরিচালিত করতে চাচ্ছে, ওদেরকে সময় থাকতে বের করুন। ওরা আপনার মঙ্গল চায়না। দুঃসময়ে ওদের লেজও ধরতে পারেবন না।

এক মহান নেতার শিল্পিত বিকাশ আপনি। রাজনৈতিক দূরদর্র্শিতার অভাব আছে আপনার, ভাবতে কষ্ট হয়। মনে রাখতে হবে, মানুষের ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও ইমেজ এক বড় জিনিস। আপনি যেসব আলালদেরকে নিয়ে কেবিনেট গঠন করেছেন তাদের অনেকেই অখ্যাত, অপরিচিত ও অপরিপক্ক।

গুনধর আবুলের কাহিনী ঘরে বাইরে কোথাও এখন আর অজানা নয়। এসব আবোল-তাবোল লোকদের দিয়ে আর যাই হোক, কেবিনেট চালানো যায় না। তাই দয়া করে শুধু এসব অপদার্থ মন্ত্রীদের স্মার্ট না বলে যোগ্য, বলিষ্ট ও সৎ লোকদের নিয়ে মন্ত্রী সভাটাকে ঢেলে সাজান। কাদাছুরাছুরির রাজনীতি পরিহার করুন। এতে জাতি উপকৃত হবে। দেশ বাঁচবে। গণতন্ত্র সুসংহত হবে। আবারো সমুজ্জ্বল হবে আপনার ভবিষ্যৎ। এখনো সময় আছে। আর দেরি নয়! প্লিজ, আমার মতো লোকাল ট্রেনের গতিতে এগুবেন না। ভাবছেন ছোট মুখে বড় কথা বলছি! ভাবতে পারেন। আমি যে এক পাগল, এখনো প্রায় প্রতি রাতেই বউয়ের বকুনি খেয়েও আপনার বাবার ৭ মার্চের ভাষণটি শুনে ঘুমুতে যাই।

***
পুনশ্চঃ লেখাটি কিছুদিন আগে অন্য একটি মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছিল কিন্থু বিডির পাঠকদের সৌজন্যে আবারো প্রকাশে উদ্যোগী হলাম।