বিজয়ের প্রদীপ্ত অঙ্গীকার

সাজেদুল আমিন চৌধুরী রুবেল
Published : 14 Dec 2011, 05:06 PM
Updated : 14 Dec 2011, 05:06 PM

বেশ ক' বছর আগের কথা। ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্র তখন। ফজরের নামাজ শেষান্তে বাসায় ফিরছিলাম। শীতের সকাল। পথিমধ্যে দেখতে পেলাম চটের বস্তা পরিহিত এক বৃদ্ধ লোককে হেঁটে যেতে। কমর গুঁজো করে ভদ্র লোক হাঁটছিলেন। স্বভাবগত ভাবে একটু কৌতূহলী বিধায় আমি এগিয়ে গেলাম ভদ্রলোকের কাছে। আমাকে দ্রুত অনুসরণ করতে দেখে তিনি থেমে গেলেন। মনে হল তিনি আমার কৌতহলী মনোভাবের কথা বুঝতে পেরেছেন। কাছে গিয়ে কথা বললাম। জানতে পারলাম সন্তান-সন্ততি থেকে বিচ্ছিন্ন তিনি এক অসহায় মুক্তিযোদ্ধা। শ্রদ্ধায় মাথা নোয়ালাম। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বললেন আদিবাস জামালপুর জেলার কোন এক গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের সময় গুলিবিদ্ধ হন। এখনো সে চিহ্ন বহন করে চলেছেন। সহযোদ্ধাদের মমতাময়ী প্রচেষ্টায় বেচে যান তিনি। স্বাধীন দেশে হাড় কাঁপানো শীতের রাস্থায় ঘুরে ঘুরে তিনি মনে করেন সে সময়ে বেঁচে গিয়ে যেন এখনো মরে আছেন। মুক্তিযুদ্ধে সফল এ নায়ক জীবন যুদ্ধে যেন এক পরাজিত সৈনিক। তাইতো রূঢ় বাস্তবতার মুখুমুখি দাঁড়িয়ে এ মহান মুক্তিযোদ্ধা আক্ষেপ করেন এভাবে, "তখন মরে গেলেই হয়তবা বেঁচে যেতাম।"

আমি ঐ বুড়ো ভদ্রলোককে কোন সদুত্তর দিতে পারিনি তখন। সবে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। সহযোগিতা করার মতো বর্তমান পরিস্থিতি বা সক্ষমতা কোনটাই ছিলনা আমার। করুনা করে নয়, আবেগে বিগলিত হয়ে একান্তই শ্রদ্ধাবনত চিত্তে আমার গা থেকে খোলে জিন্সের জ্যাকেটটি দিতে চাইলে জোরালো প্রতিবাদি কণ্ঠে নিতে অস্বীকৃতি জানান। অসহায় এ মানুষটির জন্য কিছুই করে উঠতে পারিনি আমি। জানিনা আজ তিনি কোথায় কিভাবে কিংবা আদৌ বেঁচে আছেন কিনা! মাঝে মধ্যে স্মৃতির ডায়রিতে ঘটনাটি নাড়া দিয়ে উঠলে এখনো বিবেক পীড়ায় তাড়িত হই।

এ বছরের গোঁড়ার দিকে ছুটিতে দেশে গিয়েছিলাম। জুরাইন থেকে ফকিরাপুল যাব বলে একদিন রিক্সায় চেপে বসি। যানজটের শহর ঢাকায় একবার জটে পরলে সে জট খুলে বেরিয়ে যাওয়া যে এক মহা ভাগ্যের ব্যাপার। আমার আরোহণ কৃত রিক্সাটি জটের রোষানলে পতিত হয়ে ধোলাই খাল রোড পর্যন্ত গিয়ে থেমে যায়। অগত্যা কি আর করা! অদুরে প্রবাহমান নর্দমার দুর্গন্ধ থেকে নিজেকে এড়ানোর জন্য নাকে রুমাল চেপে বসেছিলাম। যে নর্দমার বিশ্রী দুর্গন্ধে বমি হওয়ার মতো উপক্রম হয় তার উপরে রক্ষিত পাটাতনে ছেঁড়া কাথা-বালিশ বিছিয়ে দিব্যি শুয়ে থাকতে দেখা গেল এক প্রৌঢ় মহিলাকে। জটে বসে থেকে সময় নষ্ট না করে রিক্সা চালককে উপযুক্ত ভাড়া চুকিয়ে মহিলার কাছে যাই। আমার কৌতোহলি দৃষ্টি তাকেও অনেকটা কৌতোহলি করে তোলে। "চাচি" সম্ভোদন করে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলে উত্তর না দিয়ে বিগলিত কান্নায় ভেসে যান। যে কান্নার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে হাজারো আকুতি।

আমার মতো স্যুট কোট পরা এক ভদ্রলোককে এত কাছে পেয়ে ভদ্র মহিলা আবেগটাকে সামলাতে না পেরে কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন। ৭১'এর স্মৃতি নাড়া দিয়ে উঠল। নেত্রকোনার এ মহিলা কান্না বিজড়িত কণ্ঠে স্মৃতি রোমন্তন করতে গিয়ে তার জীবনের খণ্ডিত ইতিহাস আমাকে শুনালেন। সংগ্রামের সময় তাদের গ্রামের সেরা রাজাকারের বাড়ীতে বুয়ার কাজ করতেন। সে সুবাদে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বা রাজাকারদের পরিকল্পনার কথা গোপনে মুক্তিবাহিনীদের কাছে পাচার করে দিতেন। একদিন ধূর্ত রাজাকারের হাতে ধরা পরেন। আর যায় কোথায়! বেঈমানির সাজা হিসেবে সম্ভ্রম হারাতে হল। পাশবিক নির্যাতনে মরতে মরতে যেন বেঁচে গেলেন তিনি। তারও একই কথা, এ বাঁচা তো বাঁচা নয়। নিষ্ঠুর নিয়তিকে দোষরোপ করে আবারো কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন তিনি। কথা না বাড়িয়ে আমার সঙ্গী ছোট ভাই আকাশকে মহিলার হাতে ১০০০ টাকা গুজে দেয়ার ঈশারা করে দ্রুত প্রস্থান ঘটালাম।

প্রিয় পাঠক, এসব নতুন কিছু নয়। নিত্যদিনের চিত্র। রাস্থাঘাটে, ফুটপাতে, অলিতে-গলিতে, বস্তিতে, বাস স্ট্যান্ডে কিংবা রেল স্টেশনে এসব ভোখা নাঙ্গা ক্ষুধার্ত চেহারার অভাব নেই। পূর্ণিমার চাঁদ যেমন ওদের কাছে জলসানো রুটি ঠিক তেমনি "স্বাধীনতা", "বিজয়" এ শব্দ গুলোও ওদের কাছে অনেকটা মৃত চাঁদের মতো।

স্বাধীনতা প্রাপ্তির চার দশকে বিজয় উদযাপন করতে গিয়ে সরকার, বিরোধী দল সহ অন্যান্য রাজনৈতিক ও সামাজিক দলের নেতা-নেত্রী ও সুশীল সমাজের নেতৃ বৃন্দ সভা সেমিনারে যোগ দিয়ে বক্তৃতার মঞ্চ কাঁপাবেন। শহীদদের রোহের মাগফেরাত কামনা করে মুক্তিযোদ্ধা, বিরঙ্গনা ও শহীদ পরিবারের প্রতি হৃদয়ের তাবৎ মমতা ও ভালোবাসা বিলিয়ে দিয়ে সহযোগিতার উদার বাক্য ছুঁড়বেন। উপচে পরা এ ভালোবাসার লাইফ টাইম কেবলি যেন ঐ বিজয় সন্ধার সভা-সেমিনার পর্যন্তই। বিগত চল্লিশ বছরের ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা অন্তত তাই বলে।

এ ভণ্ডামি, এ কপটতা আর কত কাল? শুধুই কথার ফুলঝুরি দিয়ে সস্তা লোভ দেখিয়ে ওদেরকে এভাবে ঠকিয়ে জাতি কতোটুকুই বা লাভবান হতে পেরেছে! প্রকৃত হিস্যে থেকে কাউকে বঞ্চিত করলে মহান আল্লাহ তায়ালাও যে অসন্তুষ্ট হন। আমাদের এসব একবার ভাবা উচিত।

স্বাধীনতার পরো অনেক পট পরিবতন ঘটেছে। রক্তের দাগ শুকুতে না শুকোতেই আবারো রক্ত বন্যায় প্রবাহিত হয়েছে বুড়িগঙ্গা। সে রক্ত পানকারী কিছু কুকুরের লেজ ধরে বাংলার আকাশে আবির্ভাব ঘটেছে ধূর্ত শেয়ালদের। তারা মুরগীর ছানা গুলোকে সারা জীবনের জন্য বশীভূত করার পায়তারা চালায়। সিংহ বিহীন বনে শেয়ালের বিরুদ্ধে কথা বলে সে সাধ্যি কার! অবশেষে মুরগী ছানার ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হয়ে পালাক্রমে দেশে এলেন পণ্ডিত শেয়াল বাবুরা। স্বীয় স্বার্থে পাণ্ডিত্যের জাহির ঘটালেন মুক্ত রাজনিতিকরনের মাধ্যমে। গুহা থেকে বেরিয়ে এলো এক দল ইদুর। শেয়াল আর ইদুর মিলে সিংহ পুরুষের বিচার রহিত করে সংবিধানকে কলঙ্কিত করেই ক্ষান্ত থাকেনি, এতে ধর্ম ও সাম্প্রদিয়কতার বীজ ঢুকিয়ে এর আদর্শ ও মুল মন্ত্রকে চিবিয়ে চিবিয়ে খায়।

এর পরের ইতিহাস অনেক চরাই-উৎরাই ও নির্মমতার ইতিহাস। মির্জা, মিলন, লিটন ও নুরহোসেনের ত্যাগ ও আত্মাহুতির ইতিহাস। গণআন্দোলনের ইতিহাস। যা জাতিকে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে আজকের প্রেক্ষাপটে। আজ যারা ক্ষমতায় তারা নিজেদেরকে গনতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধ পক্ষের সরকার বলে দাবি করে। মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ ও শহীদ পরিবারকে যথার্থ মুল্যায়নে সক্ষম না হলেও তাদের এ দাবী একেবারেই নিরর্থক নয়। দেশের স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার বিচারের মাধ্যমে জাতিকে গ্লানিমুক্ত করে এবং যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিচারের কাটগরায় দাঁড় করানোর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ দাবির সত্যতা কিছুটা হলেও প্রমান করতে সক্ষম হয়েছে তারা।

কিন্তু এ সরকারের জন্য এই যথেষ্ট নয়। সেই গোঁড়া থেকে আজ অবধি স্বাধীনতা ও মুক্তিযদ্ধের ইতিহাস ও সঠিক তথ্য বিকৃত ও অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায় ধুমায়িত। অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম নেই তালিকায়, কেউ আদতেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেননা কিন্তু ক্ষমতার দাপটে আজ বনে গেছেন বড় কর্তা মশাই। জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে যারা জাতিকে এনে দিয়েছে স্বাধীনতার লাল সূর্য, তাদেরকে পুনর্বাসন করার কোন সার্থক প্রক্রিয়া গ্রহন করতে দেখা যায়নি। এমন কি অনেক পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা মানবেতর জীবন যাপন করছে। কেউ রিক্সা চালাচ্ছে। কেউ রাগে, ক্ষোভে বা অভিমানে আত্মগোপন করে অসহায় জ্বালা নিয়ে রাস্থায় ঘুরছে বা পচা গলিত নর্দমার উপরে শুয়ে শুয়ে দিনাতিপাত করছে। কেউ আবার তাদের ব্যবহার করে আঙ্গুল ফুলে বট গাছ হচ্ছে। আর এসব হচ্ছে কেবল অসম রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রতিযোগিতায়। ফলে নব প্রজন্মরা প্রতারিত হচ্ছে তাদের জন্মভূমির সঠিক তথ্য ও তত্বগত জ্ঞান থেকে।

অদ্যাবধি কোন সরকারকে সরেজমিনে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে অসহায় অভিমানি মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করে তালিকায় লিপিবদ্ধ করার কোন সঠিক প্রক্রিয়া আমরা দেখতে পাইনি। শহীদ বা তাদের পরিবারের জন্য কোন সাহসী বা প্রশংসনীয় উদ্যোগ খুব বেশী একটা চোখে পরেনা। অতীত সরকার গুলোর কথা বাদ দিলাম। আমরা বিজয়ের চার দশক এমন এক সময়ে পালন করতে যাচ্ছি যখন দেশে একটি গনতন্ত্র ও স্বাধীনতার পক্ষের সরকার বিদ্যমান। তাই বর্তমান সরকারকে বলবো, শুধু কথায় ছিঁড়ে ভরেনা। মঞ্চ কাঁপিয়ে শুধু বক্তব্য নয়। মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের সঠিক মুল্যায়ন, নিখুঁত ভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কারয সম্পন্ন করা, অতঃপর সকল হিংসা দ্বেষ ভুলে সত্য, ন্যায়, সুন্দর, কল্যান ও মূল্যবোধের অনুশীলনে ব্রতী হয়ে স্বীয় জাতিসত্ত্বাকে বিশ্ব মানচিত্রে মাথা তুলে দাঁড়াতে এগিয়ে নিয়ে যাবেন- এই হোক চল্লিশ বছরের বিজয় ফুর্তির এক প্রদীপ্ত অঙ্গীকার।