রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে, বন্ধু হিসেবে দারুণ ছিল খোকা

শিমুল সালাহ্উদ্দিন
Published : 31 Dec 2011, 02:48 PM
Updated : 4 Nov 2019, 04:05 PM

মুক্তিযোদ্ধা রাজনীতিবিদ সাদেক হোসেন খোকার প্রয়াণের খবরে তাঁর কলেজজীবন থেকে বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু-র সাথে আলাপ করেছেন শিমুল সালাহ্উদ্দিন

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: বাচ্চু ভাই, সাদেক হোসেন খোকা মারা গেলেন। ক্যান্সার ছিল। আপনারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। আপনি উনাকে কিভাবে চিনতেন? প্রথম কবে দেখেছেন?

নাসির উদ্দিন ইউসুফ: আমরা তো কাছাকাছি জায়গায় বড় হয়েছি। আমি পল্টনে, সাদেক হোসেন খোকা টিকাটুলিতে, মায়ারা হচ্ছে ওয়ারীতে। আমরা তো এভাবে বলা যায় একসাথে বড় হয়েছি, বেড়ে উঠেছি। আমরা কলেজে থাকতে, জগন্নাথ কলেজে, তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: শুধুই পরিচয় না বন্ধুত্বও ছিলো? মানে একসাথে পড়েছিলেন যেহেতু, বন্ধুত্বও তো ছিল!

 নাসির উদ্দিন ইউসুফ: হ্যাঁ, অবশ্যই। ষাটের দশকের যে আন্দোলন, ঊনসত্তুরের গণ আন্দোলন,মধ্য ষাটের আন্দোলন, আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, স্বাধীকারের আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন— এ আন্দোলনগুলিতে আমরা জগন্নাথ কলেজ থেকে যোগদান করি। একসাথেই কাজ করতাম। সেখানে যে রাজু ভাই কিছুদিন আগেই মন্ত্রী ছিলেন টেলিফোনের (ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন মন্ত্রী, নরসিংদী ৫ আসনের সাংসদ, এখন একটু অসুস্থ, উনার আন্ডারেই আমরা আন্দোলন করেছি। আন্দোলনের মধ্য দিয়েই একটা বন্ধুত্ব আমাদের গড়ে উঠেছিল।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন:সংগ্রামের মধ্যে বন্ধুত্ব-তো অসামান্য বন্ধুত্ব হবার কথা। আর সে উত্তাল সময়!

নাসির উদ্দিন ইউসুফ: ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানে আমরা একসাথে আন্দোলন করেছি। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তখন। বাম সংগঠন আমি করতাম, খোকা করতো, এমনকী মায়াও করতো। আমরা পরবর্তী পর্যায়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যখন যাই তখন খোকাও যায়। সে আলাদা যায়, আমি আলাদা যাই, মায়া আলাদা যায়, দস্তগীর গাজী, শাহাবুদ্দিন,রাজা আলাদা যায়, আজম খান আলাদা যায়। ঢাকা থেকে আমরা সবাই আলাদা আলাদা যাই, ওখানে গিয়ে আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হয়। তার মধ্যে কেউ বর্ডারে লড়াই করেছে, ফিরে এসে দেশে অপারেশন করে গেছে, আবার গেছে ট্রেনিং এ ফিরেছে। এমন হয়েছে। এরপর খালেদ মোশাররফ যখন ছোট ছোট গ্রুপ করেন, তখন তার একটা গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়েছেন সাদেক হোসেন খোকা। তার সাথে একটা দল এসেছিল আঠারো-কুড়িজনের, তাদের আলাদা দায়িত্ব ছিল ঢাকায় কিছু অপারেশনের। আমাদের গ্রুপের যেমন ছিল, মায়া, দস্তগীররাও এসেছে। আরবান গেরিলা হিসেবে তারা অসম সাহসিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছে। ফলে যুদ্ধের সময় খোকার সাথে আমার খুব একটা দেখা হয়নি। একবার শুধু একটা জায়গায়, দেখা হয়েছিলো, সেটি একটি অপারেশনকে কেন্দ্র করে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: সেই অপারেশনটার কথা কি আপনার মনে আছে বাচ্চু ভাই?

নাসির উদ্দিন ইউসুফ: মনে আছে। স্পুটনিক বলে আমাদের এক বন্ধু আছে, গোপীবাগের,তারা এসেছিল, সেপ্টেম্বর মাসে একটা ইলেকশন হবার কথা ছিল পাকিস্তানে, আমাদের তখন ওই ইলেকশন কমিশন অফিসটা উড়িয়ে দেবার কথা ছিল। তো আমার এখনো মনে আছে, আমরা গেছি এক্সপ্লোসিভ বসাবো এজন্য, গিয়ে দেখি স্পুটনিক এবং খোকা এরা আছে। তখন রাস্তায় দাঁড়িয়েই কথা হচ্ছে, যার যার কমাণ্ডারের কী নির্দেশ তা নিয়ে। হাতে দুজনেরই মিষ্টির প্যাকেট। খোকার হাতে একটা মিষ্টির প্যাকেট ছিল, আমার হাতে একটা মিষ্টির প্যাকেট। আমারটা হচ্ছে আলাউদ্দিনের মিষ্টির আর খোকার হাতে গোপীবাগের মোড়ে যে আছে, জলখাবারের মিষ্টির প্যাকেট।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন:প্যাকেটে নিশ্চয়ই মিষ্টি নাই!

নাসির উদ্দিন ইউসুফ: আরে না। এক্সপ্লোসিভ। তো আমি কথা বলে বুঝলাম উই ক্যাইম ফর সেইম অপারেশন। তখন কমাণ্ডের নির্দেশে আমি তখন চলে এসেছি, যে ওকে, তোমরা করো। ওরা করেছিল সাকসেসফুলি। আর আরেকটা অপারেশন, ডিএফপি অপারেশন, শান্তিনগরে পাকিস্তান সরকারের যে পাবলিকেশন, সেটাও কিন্তু ওরা করেছিল। শান্তিনগরের মোড়ে ছিল ডিএফপি। আলোচিত অপারেশন ছিলো এসব।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: বাচ্চু ভাই,আলোচিত মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা দীর্ঘসময় বিএনপির রাজনীতি করেছেন, ঢাকার মেয়র ছিলেন,বলা হয় জনপ্রিয় এবং সফল মেয়র ছিলেন, আপনার বন্ধু মানুষ, তার রাজনীতিকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

নাসির উদ্দিন ইউসুফ: এখানে এসেই আমাদের আসলে বন্ধুর সাথে মতানৈক্য হয় আমার। ৭৫ এর পরেই। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নিয়ে কিছু মতবিরোধ হয় বাচ্চুর সাথে আমার। আমি তখন রাজনীতি ছেড়েই দিয়েছি। কিন্তু বন্ধুত্বটা ছিলো সবসময়। বিএনপির রাজনীতিতে তার সক্রিয় অংশগ্রহণও একটা বড় কারণ। ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতি করছে, আর আমি সবসময় বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতির পক্ষের মানুষ। নাটক এবং টেলিভিশনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ার কারণে এবং সংস্কৃতিকর্মী আমরা সবাই সবসময় তাই। এখন পর্যন্ত এটাই আমি পারসু (Persue) করি। ফলে ইসলামকে নিয়ে এসে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এর যে রাজনীতি বিএনপি করেছে এই দেশে আমি তো সেটার বিরোধিতা করি, ফলে আমাদের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ছিল, সেটা সত্যি।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কি ব্যক্তিসম্পর্কেও প্রভাব ফেলেছে?

নাসির উদ্দিন ইউসুফ: কিছুটা ফেলেছে। তবে আমাদের যখন দেখা হয়েছে তখন খোকা খুব আন্তরিক ছিল সবসময়। আর ও যখন মেয়র হয়েছে, তখন একবার মুক্তিযোদ্ধাদের ডেকেছে, আমি গিয়েওছিলাম। সেখানে আবার জয় বাংলা ও জাতির পিতা বলা নিয়ে আপত্তি ওঠাতে পরের বছর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই আমরা যাইনি। ষোলই ডিসেম্বরে মেয়র হিসেবে সিটি কর্পোরেশন থেকে তারপরও একটা অনুষ্ঠান খোকা করতো, সেটা তার ভালো উদ্যোগ ছিল, কিন্তু আমরা কিছু মৌলিক জায়গায়, ওই যে বললাম জয় বাংলা ও জাতির পিতা ইস্যুতে একমত না হতে পারায় যাইনি। রাজনৈতিক বিবেচনা যদি বাদ দেই, বন্ধু হিসেবে ভালো বন্ধু ছিলো, মানুষ হিসেবে ডাউন টু দ্য আর্থ ছিল, একেবারে সাধারণ হকার থেকে শুরু করে বাসার কাজের লোক, গৃহকর্মী থেকে সবার সাথে তার দারুণ সম্পর্ক ছিলো, সে মেনটেইন করতো। দোকানদার থেকে শুরু করে সবার সাথে দারুণ সম্পর্ক ছিল, এটা খোকার একটা বড় গুণ। রাজনীতিতেও এজন্যই সে সফল হয়েছে। তবে জামায়াতে ইসলামীকে সাথে নিয়ে আটদলীয়, ৯৬ থেকে ২০০১, আটদলীয় যে জোট- সে জোটের ঢাকা মহানগরের সে যখন সভাপতি ছিল, তখন মুজাহিদ-কে সে সাথে নিয়েছে, মানে জামাতকে সে শেল্টার দিয়েছে, এইটিতে আমাদের খুবই আপত্তি ছিল।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: কিন্তু উনি যে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে বিএনপির জামাত পৃষ্ঠপোষকতার যে প্রকল্প, তা বাস্তবায়নের মূল কুশীলবদের একজন তিনি—

নাসিরউদ্দিন ইউসুফ: আমি তাই বলছি। এবং এ কারণে ওর প্রতি আমার ক্ষোভ আছে। বন্ধু হিসেবে বলি,মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বলি, মেয়র হিসেবে বলি, আমরা যেমন তার সাফল্যের গল্প বলি, রাজনৈতিকভাবে এটি কিন্তু তার ব্যর্থতার একটি উদাহরণ আমি মনে করি।

তারপরও বন্ধু হিসেবে আমি মনে করি,খোকা একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একাত্তরে ভালো ভূমিকা পালন করেছে, পরবর্তীতে আমাদের মধ্যে নানা মতানৈক্য হয়েছে, কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্কটা একেবারেই মুছে যায়নি, মরে যায়নি। খুব ক্ষীণ হয়েছে কিন্তু মরে যায়নি। তার মৃত্যুর কথা শুনে আমার খুবই মন খারাপ হয়েছে। একাত্তরের সতীর্থ হারানো বড় কষ্টের। তার মৃত্যুতে আমি তার পরিবারকে সমবেদনা জানাই, এবং দুঃখপ্রকাশ করছি। আমার খারাপলাগা তো থাকবেই। কলেজজীবন থেকে আমরা বন্ধু।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: স্বাভাবিক। বাচ্চু ভাই, মুক্তিযুদ্ধে সাদেক হোসেন খোকা, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া,রাইসুল ইসলাম আসাদ, ক্র্যাক প্লাটুনের আপনারা যারা ছিলেন—

নাসির উদ্দিন ইউসুফ: আমি, মানিক, আসাদ একসঙ্গে ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে। আমরা গিয়েছি মে মাসে। মায়ারা গিয়েছে এপ্রিল মাসে। সাদেক হোসেন খোকারাও গিয়েছে মে-জুন মাসে। গাজী গোলাম দস্তগীর, ফতেহ আলী এরা আমাদের আগে গেছে। কারো অবদানই মুক্তিযুদ্ধে খাটো করে দেখার সুযোগ নাই।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: বিডিনিউজের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ বাচ্চু ভাই।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ: তোমাকে ধন্যবাদ শিমুল।