রাজনীতিকদের পরিমার্জিত ভাষায় কথা বলা উচিত

সাজেদুল আমিন চৌধুরী রুবেল
Published : 6 Feb 2012, 11:24 AM
Updated : 6 Feb 2012, 11:24 AM

ব্রিটিনে জনৈক নাগরিক ক্যাথি লউনি কতৃক সংকলিত ও ইমা ব্যারির সম্পাদনায় বিশ্বের প্রায় একশ শীর্ষ রাজনিতিবিদ, ইতিহাসবেত্তা, রাষ্ট্রনায়ক ও দার্শনিকদের বক্তব্য বা বক্তৃতার সমন্বয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়, যার নাম "Speeches that changed the world." বইটিতে প্লেটো থেকে শুরু করে মারটিন লুথার, জন এফ কেনেডি, জর্জ ওয়াশিংটন, জহরলাল নেহেরু সহ বর্তমান কালের আগ্রাসী শাসক হিসেবে পরিচিত প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ারের রাজনৈতিক বক্তব্য স্থান পেলেও অত্যন্ত দুঃখজনক ভাবে বলতে হয় আমাদের দেশের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কোন বক্তব্য বা ভাষণ সেখানে অনুপস্থিত। প্রতিবেশি দেশ ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কিত একটি ভাষণ জায়গা করে নিলেও বিশ্ব নন্দিত বাঙ্গালি নেতা শেখ মুজিবের কোন ভাষণ বইটিতে কেন নেই তার কারণ হিসেবে আমাদের রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা বা দীনতার পাশাপাশি যারা সম্পাদনা বা প্রকাশনার দায়িত্তে ছিলেন তাদের এক চক্ষু বিশিষ্ট নীতিকেও দায়ী করা যেতে পারে। আজ যেহেতু ভিন্ন বিষয়ে কথা বলবো তাই এ বিষয়ে বিষদ আলচনায় যাচ্ছিনা।

রাজনিতিকদের ইতিবাচক বক্তব্য, বিবৃতি বা ভাষণ যে একটি সমাজের, দেশের বা পৃথিবীর আমুল পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম সে বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে বইটির প্রকাশক একটি ভুমিকা লিখেন। যার আলোকে এর নামকরন করেন " Speeches that changed the world"

speech বা বক্তব্য হচ্ছে একটি মৌলিক গুন যার মাধ্যমে কোন ব্যক্তি জনসমক্ষে তার নৈতিকতার (Morality) পরিস্ফুরন ঘটাতে সচেস্ট হন। সুবচন, যথোপযুক্ত শব্দচয়ন ভাষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই মুখে মিষ্টি, তেতো, টক, জাল সবই আছে। সমাজের অনেক কৌটিল্য বা কুৎসিত জটিলতা এর মাধ্যমেই দূর করা সম্ভব। একজন ভাল ডাক্তার তার কথা বার্তা, আচারআচরন বা স্মাইলের মাধ্যমেই যেমন রোগীর অর্ধেক রোগ সারিয়ে তোলতে সক্ষম হন তেমনি একজন বক্তা তার বক্তব্যের মাধ্যমে সমাজের আমজনতার মধ্যে এর রেখাপাত ঘটাতে পারেন। যুদ্ধের মাধ্যমে যা জয় করা সম্ভব নয়, অনেক সময় সুবচন বা সুভাষণ দ্বারা তা সম্ভব হয়ে উঠে। এখানেই সুবচন বা সুভাষণের কৃতিত্ব।

আমাদের দেশে রাজনিতিকদের মধ্যে সুবচন বা সুভাষণের বড়ো অভাব। ফলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও পরমত সহিষ্ণুতার ঘাটতি দেখা দেয়। রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার সুত্রপাত হয়। অর্থনৈতিক স্থবিরতায় জাতি রুগ্ন হয়ে হারায় তার নিজস্ব ঐতিহ্য, সুনাম ও খ্যাতি।

ব্যক্তিগত ভাবে আক্রমণাত্মক, হিংসাত্মক বা প্রতিহিংসাপরায়ন মনোভাব সম্পন্ন বক্তব্য আমাদের দেশে নতুন কিছ নয়। দেশের প্রধান দুটো দলের শীর্ষ দুজন নেত্রীও এ রাহুদশা থেকে মুক্ত নন। একজন যদি বলেন আজ সূর্য পূর্ব দিকে উদিত হবে, অন্যজন ক্ষিপ্ত হয়ে বলবেন- না; সূর্য আজ পশ্চিম দিকে উদিত হবে। রাজনিতির এ বিপরিত মেরুকরনে দলের অন্যান্য নেতারাও পিছিয়ে নেই। তারাও তাদের নেত্রিদের আদর্শে (!) বিগলিত হয়ে সময়ে অসময়ে গরম গরম বক্তব্য প্রদান করে পত্রিকার হেডলাইন হন।

কিছুদিন আগে অলি সাহেবের বক্তব্য ও এর পরনতি সম্পর্কে সবাই আমরা ওয়াকিবহাল। এরও আগে লন্ডনে একটি টিবি চ্যানেলে সাক্ষাতকার দিতে এলে তিনি একই বক্তব্য প্রদান করেছিলেন। তখনই আশঙ্কা প্রকাশ করে তাকে আমি এ ধরনের স্পর্শকাতর ও বিতর্কিত মন্তব্য থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরধ করে একটি নিবন্ধ লিখি। কিন্তু কে শুনে কার কথা! এর কিছুদিন পর বিরোধী দলীয় চিপ হুইপ জয়নাল আবেদিন ফারুক সাহেব আমেরিকা থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে এসে আবারো গর্জে উঠলেন। প্রধানমন্ত্রীকে হুঁশিয়ারি উচ্চারন করে বলেন, "আমরা ক্ষমতায় গিয়ে আপনার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেবো।" হুইপ সাহেবের এ বক্তব্য কতটুকু শিষ্টাচার বহন করে তা আপনারাই বিবেচনা করবেন।

রাজনীতিবিদ নন, কলম পেশাদারী একজন বিখ্যাত কলামিস্ট। ব্যক্তিগতভাবে আমি তার একজন ফ্যান। অথচ ওই ভদ্রলোক মাস দুয়েক আগে প্রধান অতিথির ভাষণে খালেদা জিয়াকে রাজাকারদের তালিকায় এনে তাঁকেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাটগরায় দাঁড় করানর জন্য সরকারকে আবেদন জানিয়েছেন। তাঁর মতো একজন প্রথিতযসা বুদ্ধিজীবীর কণ্ঠে এ ধরনের কথা শুনে আমি হতবাক। মানলাম, খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে গরিমসি করছেন বা ঠেকাতে ব্যস্ত। তাই বলে তাঁকে যুদ্ধাপরাধী তালিকায় লিপিবদ্ধ করে বিচারকার্য সম্পন্ন করা কতটুকু বাস্তব সম্মত? ঘরেবাইরের কেউ কি এটাকে অত সহজে মেনে নেবেন? সরকার কোন কিছুর ভ্রুক্ষেপ না করে পাঘলা ঘণ্টা বাজিয়ে যদি তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেন তাহলে দেশটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কি ভাবা যায়! তাই বলবো, তাঁর মতো কোন জ্ঞানীগুণী কলম পেশাজিবির পক্ষে উস্কানিমুলক বক্তব্য বা থিউরি প্রদান করে সরকারের মাথায় এমন কোন ভূত চাপিয়ে দেয়া উচিত নয় যা কার্যকরী হলে দেশের বারোটা বেজে যাওয়ার আশঙ্ক থাকে।

সর্বশেষ আমাদের প্রিয় দাদা, ভাটি এলাকার কীর্তিমান পুরুষ। বলতে গেলে সদ্য অভিসিক্ত তিনি মন্ত্রিত্তের সাধুবাদে। সুরঞ্জিত বাবু। হ্যাঁ গত ০১/০২/১২ বুধবার তাঁর একটি বক্তব্য পত্রিকায় দেখতে পাই। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পৌরসভা পার্কে আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির ভাষণে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন, 'আপনার সেনা-অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে।' গণ-অভ্যুত্থানও ব্যর্থ হবে। দুই ক্লাস কম ম্যাট্রিক পড়ে গণ-অভ্যুত্থান করা যায় না।'

আমরা যতোটুকু জানি, মিঃ গুপ্তের একটি ইতিবাচক গ্রহণযোগ্যতা জনগনের কাছে রয়েছে। ক্লিন ইমেজের এ লোকটি দেশের একটি বৃহৎ দলের যেমন প্রতিনিধিত্ব করছেন তেমনি সরেকারেরও। তাঁর মতো একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রির পক্ষে এ ধরনের বেফাস কথা বলাটা মোটেও সমীচীন নয়। খালেদা জিয়া কয় ক্লাস পড়াশুনা করেছেন বা করেননি সেটা বড়ো কথা নয়। বিচার্য হল, তিনি দু দুবারের প্রধানমন্ত্রী, বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা। সুরঞ্জিত বাবুর মতো অনেক রাজনিতিবিদ, ডক্টর বা বুদ্ধজিবি ওই নেত্রীর আঙ্গুলের ইশারায় নতজানু হন। সুতরাং তাঁর "অল্প শিক্ষাকে" রাজনৈতিক বক্তব্যে টেনে এনে তাঁকে হেয় করার যে হীন প্রচেষ্টা তা মোটেও শুভ বুদ্ধি বা রুচিশীলতার পরিচয় বহন করেনা। বরং এতে নিজেকেই খাট করা হয়। এসব অযাচিত ও অপাংতেয় বক্তব্য নিজেদের অস্তিত্তের জন্য যেমন প্রশ্নবোধক তেমনি সমগ্র জাতির জন্যও বিপদজনক।

বিশ্বের প্রতিটি দেশেই রাজনৈতিক মতানৈক্য বিদ্যমান। ওখানেও বাকবিতণ্ডা, যুক্তিতর্ক হয়। আমেরিকা বা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের দিকে তাকালে দেখা যায় রাজনৈতিক নেতারা কিভাবে তর্ক যুদ্ধে লিপ্ত হন। তবে তা মোটেও শিষ্টাচার বহির্ভূত নয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায়ে রেখে রাজনৈতিক ভাষায় তাঁরা বক্তব্য দেন। বক্তব্য দানের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের রাজনিতিকদের মধ্যে যে দীনতা, হীনতা, অশ্রদ্ধাবোধ ও হিংসাত্মক মনোভাব কাজ করে তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পুরনো রাজনৈতিক কালচার বাদ দিয়ে ডিজিটাল যুগের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নত বিশ্বকে অনুসরণ করতে হবে এবং সর্বোপরি বক্তব্যের সময় শব্দচয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সংযমী ও সতর্কতা অবলম্বন করে পরিমার্জিত ভাষায় কথা বলতে হবে। এবং তা নিজের জন্য তো বটেই, দেশ ও জাতির জন্যও হবে মঙ্গলজনক।