গোলাম আজমকে নিয়ে আল জাজিরার মায়াকান্না ও আমাদের করনীয়

সাজেদুল আমিন চৌধুরী রুবেল
Published : 17 Feb 2012, 03:28 PM
Updated : 17 Feb 2012, 03:28 PM

সম্প্রতি আল জাজিরা গোলাম আযম বিষয়ক একটি প্রতিবেদন সমপ্রচার করে। বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকে তা প্রকাশ পেলে দেশে বিদেশে বসবাসরত অনেক বাঙ্গালীদের মধ্যে বেশ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠাও প্রকাশ করছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি হুবুহু তুলে ধরা হল – 'বাংলাদেশের সাবেক রাজনীতিবিদ গোলাম আযম ৪০ বছরেরও বেশি সময় আগে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের মুখোমুখি। ৮৯ বছর বয়সী গোলাম আযম হাঁটতে পারেন না, দেখতে পান না, এমনকি শুনতেও পান না। তা সত্ত্বেও ১০ জন সশস্ত্র পুলিশ কর্মকর্তা সার্বক্ষণিক তাঁকে পাহারা দিচ্ছেন।'

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, 'সম্প্রতি জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ এক শুনানিতে গোলাম আযম ও অন্য অভিযুক্তদের আটক করে রাখার বিষয়টিকে অযৌক্তিক ও আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী বলে অভিহিত করেছে।'

আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, 'যদিও আইনমন্ত্রী এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, এই ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নয়। এটি দেশীয় ট্রাইব্যুনাল। তাই যাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে, তাদের আটক অবৈধ নয়।'

প্রতিবেদনে শেষে গোলাম আযমের বিচার সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। আদালতের সিদ্ধান্ত যা-ই আসুক না কেন, এর পরিণতি হবে নাটকীয়। এটা অনেকের কাছেই সুবিচার বলে মনে হবে। কিন্তু পরিণতিতে দেশ নিপতিত হবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে।'

প্রকাশিত রিপোর্টটি সম্পর্কে আলোকপাত করার আগে আল জাজিরার দিকে একটু নজর দেই। স্যাটেলাইট এ টিভি চ্যানেলটির জনক হলেন কাতারের যুবরাজ হামাদ বিন খলিফা। একটি বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আল জাজিরার আত্মপ্রকাশ ঘটলেও চ্যানেলটি কালক্রমে সখ্য গড়ে তোলে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও টেররিজমের মতো অন্ধকার দুনিয়ার সাথে। হামাদ বিন খলিফা তার বাবাকে তোয়াক্কা না করে ১৯৯৫ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। জন্মলগ্ন থেকেই এ স্যাটেলাইট চ্যনেলটি বিভিন্ন বিতর্কিত, স্পর্শকাতর ও মিথ্যে খবর পরিবেশনে লিপ্ত হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে খোদ আরববিশ্ব সহ পাশ্চাত্যের অনেক দেশও চ্যানেলটির প্রতি ক্ষেপে যায় এবং বিভিন্ন সময়ে তা বয়কট করতে বাধ্য হয়।

এ মিডিয়াটির পিছনের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় মিথ্যে ও ভিত্তিহিন সাংবাদিকতার কারণে আলজেরিয়ান সরকার দুহাজার চারে আল জাজিরার এক সংবাদ কর্মীকে প্রতিহত করেন। বাহরাইন একই দোষে দু হাজার দুই থেকে চার সাল পর্যন্ত আল জাজিরার সংবাদ পরিবেশন বা তার দেশে অফিসিয়াল কার্যক্রম চালু রাখার ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। শুধু তাই নয় উগ্রপন্থি সংবাদ পরিবেশনের জন্য আরব নিজেও অসন্তুশ প্রকাশ করেন।

আলকায়দা ও জঙ্গিবাদকে উস্কানি দিয়ে সংবাদ পরিবেশনের দায়ে ১১ নভেম্বর ২০০১ মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনী কাবুলে আল জাজিরার অফিস ধংশ করে দেয়। কিছুদিন পর আলজাজিরার কাবুল প্রতিনিধি সামি আলহাজ নামের এক ব্যাক্তি ভুয়া পাসপোর্ট বহন করার অপরাধে পাকিস্তনি কতৃপক্ষ গ্রেফতার করে ও পরিশেষে মার্কিনীদের কাছে সোপর্দ করে। হলুদ সাংবাদিকতায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওই মার্কিন বাহিনী ৮ এপ্রিল ২০০৩ বাগদাদে আল জাজিরা অফিসে বোমা নিক্ষেপ করে। ফলে তারেক আইয়ুব নামের এক সাংবাদিককে নিহত হয়।

ইজরাইল অনেক আগে থেকেই আল জাজিরার অসত্য ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত সংবাদে অসহ্য হয়ে এ মিডিয়াটিকে বর্জন করে এবং ভিত্তিহিন ও উদ্দেশ্যমুলক সংবাদ পরিবেশনের জন্য কতৃপক্ষকে চার্জ করতে বাধ্য হয়।

দুহাজার আটের জানুয়ারিতে ব্রিটেনের বহুল প্রচারিত পত্রিকা দি গার্ডিয়ান একটি রিপোর্ট করে এভাবে, serious stuffing crisis. অর্থাৎ ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী সাংবাদিক বৃন্দকে আল জাজিরার ধ্যান ধারনা বা মতাদর্শের প্রতি খেয়াল রেখে রিপোর্টিং করার তাগিদ দেয়া হতো। এতে করে কর্মরত সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারতেননা ও কোন ঘটনার স্বচ্ছতা বহিপ্রকাশের ক্ষেত্রেও তাদেরকে প্রায়ই বাধাগ্রস্থ হতে হতো। ফলশ্রুতিতে তাদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে নবায়ন করতে রাজি না হওয়া বা নতুন কোন ইংরেজি ভাষাভাষী সাংবাদিক এ চিহ্নিত চ্যানেলটিতে কাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করলে সাংবাদিক সঙ্কট দেখা দেয়। যার ফলে গার্ডিয়ান উপরোল্লেখিত শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।

এই হল আল জাজিরা। মুরব্বী দেশ গুলো থেকে শুরু করে ছোট খাট সব দেশই আল জাজিরা বা এর ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে কম বেশী ওয়াকিবহাল। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদকে বাঁচিয়ে রাখাই যাদের প্রধান কাজ সে ক্ষেত্রে মিডিয়াটি গোলাম আযমের মতো একজন মৌলবাদ ধর্ম ব্যবসায়ী যুদ্ধাপরাধীর জন্য মিথ্যে সাফাই গাইবে তাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্ববাসী এতো বোকা নয় যে আল জাজিরার মতো অসৎ, মৌলবাদ বা সংশ্লিষ্ট অনুসর্গের দোষে দুষ্ট একটি চ্যানেলের সাফাই শুনে কান ভারী হয়ে উঠবে। তাই যারা আল জাজাজিরায় প্রচারিত প্রতিবেদনের আলোকে বিভিন্ন উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, শঙ্কা বা আশঙ্কার কথা বলছেন কিংবা যুদ্ধাপরধীদের নিকৃষ্টতম চেহারার উন্মোচন ঘটিয়ে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ব্যর্থ বলে অভিহিত করছেন তাদেরকে সমীহ করেই আমি দ্বিমত প্রকাশ করি। সরকার বহির্বিশ্বে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধীদের স্বরূপ তুলে ধরতে পেরেছে বলেই জামায়াত প্রীত যুদ্ধাপরাধীদের কয়েকটি মিত্র দেশের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বিচারকার্য চালিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে। তা ছাড়া এ ক্ষেত্রে কেবল সরকারকে এক ছেতিয়া ভাবে দোষ দিয়ে লাভ কি? সাধারন জনগনও তো বিভিন্ন সামাজিক নেটওয়ার্কের আশ্রয় নিয়ে বা ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ ব্যপারে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখতে পারেন। আর উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বা শঙ্কা? একেবারে উড়িয়ে দেইনা। প্রতিপক্ষ বা স্বার্থান্বেষী মহল সুযোগের অপেক্ষায় ওঁত পেতে থাকবে তাই স্বাভাবিক। তবে তরুন প্রজন্ম থেকে শুরু করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে যে গনজাগরন, তার সামনে সকল ষড়যন্ত্রই পণ্ড হতে বাধ্য ইনশাল্লাহ।

শেষে আরেকটি কথা না বলেই পারছিনা। আল জাজিরার মতো একটি জঙ্গিবাদ পৃষ্টপোষকতা সম্পন্ন মিডিয়াকে পরিত্যক্ত ঘোষণার মাধ্যমে নিষিদ্ধ করে বাহরাইন বা ইজরাইলের মতো কি বাংলাদেশে একটি উদাহরণ সৃষ্টি করা যায়না?