সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধঃ কোন পথে এগুচ্ছে?

সাজেদুল আমিন চৌধুরী রুবেল
Published : 12 March 2012, 03:51 PM
Updated : 12 March 2012, 03:51 PM

এক এক করে বিশ্বের প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রই যেন আজ তছনছ হতে চলছে। এ ধারাবাহিকতা বিদ্যমান থাকলে অদূর ভবিষ্যতে মুসলিম বিশ্বের অস্তিত্ব ঠিকে থাকবে কিনা তাই আজ যথেষ্ট উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগ্রাসন কারীদের শ্যান দৃষ্টির কারনেই হোক কিংবা নিজেদের অন্তরকলহ জনিত কারনেই হোক, নিকট অতীতে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মুসলিম দেশের উপর যে নগ্ন হামলা, ভয়াল থাবা বা হিংস্রতা বয়ে গেছে তার রেশ শেষ হতে না হতেই আবারো নতুন করে হোলি খেলায় মেতে উঠেছে সিরিয়া। এবং তা ক্রমাগত চলতে থাকলে এ মুসলিম দেশটির ভাগ্যও যে অচিরেই অন্ধকারে তলিয়ে যাবে তা আর বলার অবকাশ রাখেনা।

ক্রমবর্ধমানভাবে দেশটি যে গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তার জন্য মুলত প্রেসিডেন্ট আসাদকেই দায়ী করছে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল। মানবতাকে মাটিচাপা দিয়ে নির্বিচারে তিনি যে গনহত্যা চালিয়ে যাচ্ছেন তাতে বিশ্ববিবেক উদ্রেক প্রকাশ করছেন। সন্ত্রাস নির্মূলের কথা বলে তিনি গনহত্যাকে আড়াল করার অপচেষ্টা চালালেও সচেতন লোক মাত্রই এ কথা বুঝতে বাকি নেই যে, নিরীহ লোকের উপর তাঁর সামরিক বাহিনীর যে জঘন্য অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন তা কেবল ক্ষমতার রশদকে ধরে রাখার জন্য এক ধরনের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস মাত্র।

সাধারনত সামাজিক, শ্রেনিভেদ প্রথা, রীতিনীতি, আঞ্চলিকতা, ধর্মীয় মুল্যবোধ, রাজনৈতিক মতানৈক্য, নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন বা অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকেই গনবিক্ষোভ দানা বেধে উঠে। সিরিয়ার শাসনব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতেও এ বিষয়গুলো এক সঙ্গে জট বেধে বসেছে। ফলে দেশটির শাসন ব্যবস্থা ক্রমেই নড়বরে হয়ে উঠেছে যার কুফল বা ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে সর্বসাধারণ তথা পুরো রাষ্ট্রের উপর। জনগন দাঙ্গা হাঙ্গামায় লিপ্ত হচ্ছে অতি সহজেই। ন্যয্য অধিকারের দাবীতে তারা চালাচ্ছে আন্দোলন। সে আন্দোলন দমাতে বা গদি ঠিকিয়ে রাখতে সরকার বেছে নিচ্ছে হার্ড লাইনের পথ। লেলিয়ে দিচ্ছে তাঁর সেনাবাহিনীকে। ঝাঁপিয়ে পড়ছে তারা নিরস্ত্র জনগণের উপর। ক্রমান্বয়ে তা রূপ নিচ্ছে গৃহ যুদ্ধে।

গণআন্দোলনকে ঊপেক্ষা করে কেঊ যদি ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করে ধরে রাখতে চায় এর ফলাফল যে খুব ভয়াবহ রূপ ধারণ করে, তা আমরা অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে অতি সহজেই উপলব্ধি করতে পারি। মিশরের কথা যদি নাও টানি কেবল লিবিয়ার দিকে তাকালেই এর প্রমাণ মেলে। লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ গাদ্দাফি যদি সঠিক সময়ে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর করে দিতে রাজি হতেন তাহলে পরবর্তীতে তাঁর বা পুরো দেশটার যে করুণ ও অপূরণীয় মুল্য দিতে হয়েছে এর প্রয়োজন নাও হতে পারতো। কিংবা আমেরিকার অন্যায় হস্তক্ষেপ থেকেও নিজেদেরকে মুক্ত রাখতে পারতো। আজ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের ক্ষমতাপ্রবন ও সামরিকতান্ত্রিক মনোভাব দেশটাকে লিবিয়ার দিকেই নিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন।

দেশটাতে প্রায় এক বছরের আন্দোলনের মাথায় প্রান হারাতে হয়েছে কয়েক হাজার লোককে। বিভিন্ন সূত্রের খবর অনুযায়ী, কেবল গত সপ্তাহেই হোম শহরে প্রাণহানি ঘটেছে শতাধিক নিরীহ লোকের। প্রতিদিনই শিশু সহ অনেককেই প্রাণ দিতে হচ্ছে কোননা কোন ভাবে। ঝুঁকি মাথায় নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের দুই সাংবাদিককে। গুটি কতক সংবাদ প্রতিনিধি ছাড়া অধিকাংশ সাংবাদিকদের জন্য সিরিয়ার দরজা বন্ধ। হানাহানি, রক্তারক্তি থেকে বাঁচার জন্য প্রতিবেশি দেশ লেবাননে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে হাজার হাজার সিরীয় নাগরিক। প্রতিদিনেই সীমান্তে ভীড় করছে অসংখ্য শরণার্থী। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এসবে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করলেও কাজের কাজ কিছুই করতে পারছে বলে মনে হচ্ছেনা। এমনকি ক্ষতিগ্রস্থ ও বিধ্বস্তদের মাঝে সঠিক ভাবে ত্রাণসামগ্রী বিতরন করতেও ব্যর্থ হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও সেবামূলক সংস্থা গুলো। আরবলীগ বিষয়টা হস্তক্ষেপ বা মধ্যস্ততার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেও প্রকৃতপক্ষে তারাও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে সময়োপযোগী ও কার্যকরী কোন পদক্ষেপ এখনো পর্যন্ত নিতে পারেনি।

সরকারের সেনাবাহিনী ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিদ্রোহীদের উপর আঘাত হাণছে প্রতিনিয়ত। এতে করে দেশটি আরও অস্তিতিশিলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আত্মরক্ষার তাগিদে সাধারণ জনগণও আজ দলে দলে সন্ত্রাসী হামলায় লিপ্ত হচ্ছে। গৃহ যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ নিঃসন্দেহে। সাধারণ জনতা আত্মরক্ষার তাগিদে অস্ত্র হাতে তূলে নেবে এটাই স্বাভাবিক। আরবও কয়েকদিন আগে নিরস্ত্র জনগণকে অস্ত্র সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেছে। সিরিয়ান সরকার বিদ্রোহীদের সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দিলেও ওরা দিনে দিনে খুবই পারদর্শী ও সুবিন্যস্ত হয়ে ঊঠছে। সুতরাং পর্যাপ্ত অস্ত্র পেলে মাতাল বিদ্রোহীদের দমিয়ে রাখে সে সাধ্যি কার!

মানবিক শিক্ষা আমাদেরকে যুদ্ধ বন্ধের শক্তি যোগায়। যুদ্ধ কেবল পৃথিবীতে ধ্বংসই ঢেকে আনে। তাই যুদ্ধকে প্রতিরোধ করা সময়ের দাবি। আমরা জানি সুনিপুণ বা কূটনৈতিক মধ্যস্ততা দ্বন্দ্ব বা সংঘাত এড়াতে সম্ভব কিন্তু সামরিক হস্তক্ষেপ রাষ্ট্রে নৈরাজ্য, জানমালের ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানি তথা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকেই মাথাচাড়া দিয়ে তোলে। যুদ্ধের দামামা বাজাতে সাহায্য করে। কিন্তু সিরিয়া এখন কোন পথ বেছে নেবে? যুদ্ধ না শান্তি? আরব লীগের হস্তক্ষেপ নাকি জাতিসংঘের মতো ভেজাবেড়াল জাতীয় কোন তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্ততা? এসব বিষয়ে খুব দ্রুত ও পরিস্কার ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে খোদ সিরিয়াকেই।

ইতোমধ্যে মোড়ল দেশগুলোতে দখলদারিত্বের গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। সুতরাং আগ্রাসনকারীদের শ্যেন দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হওয়ার আগেই সিরিয়াকে তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপনে কার্যকরী ভুমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি বিশ্ব বিবেককেও জেগে উঠা উচিত। যে ক্ষেপনাস্ত্রের বঙ্কিম পথ ধরে সিরিয়া এগুচ্ছে তাকে আর চলতে না দিয়ে এখানেই থামিয়ে দেয়া অত্যাবশ্যক। খাদ্য, বাসস্থান বা বস্ত্রের মতো মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য যে অর্থ, সে অর্থ যেন আমরা আর অনর্থের কাজে ব্যবহার না করি তাই হোক আজকের শ্লোগান।