১৬ অক্টোবর- বিশ্ব খাদ্য দিবস: একটি তাৎক্ষণিক ব্লগ

ফিউচারিস্ট
Published : 15 Oct 2011, 08:39 PM
Updated : 15 Oct 2011, 08:39 PM

আজ ১৬ অক্টোবর, বিশ্ব খাদ্য দিসব। ১৯৭৯ সালে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) ২০তম সাধারণ সভায় হাঙ্গেরির তৎকালীন খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রী ড. প্যাল রোমানী বিশ্বব্যাপী এই দিনটি উদযাপনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৮১ সাল থেকে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিষ্ঠার দিনটিতে (১৬ অক্টোবর, ১৯৪৫) দারিদ্র ও ক্ষুধা নিবৃত্তির নিমিত্তে বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি দেশে এই দিনটি গুরুত্ত্বের সাথে পালিত হয়ে আসছে; এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়, "সঙ্কট নিরসনে সহনশীল খাদ্য মূল্য"।

একটি দেশের নাগরিকগণের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে খাদ্য অন্যতম। তাই গত কয়েক দশকে পৃথিবীর আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে চাষযোগ্য জমি সংরক্ষণ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, কৃত্রিম বনায়ন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশ এবং পৃথিবীর সবগুলো উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ, বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যস্ত হয়ে আছে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। পৃথিবীজুড়ে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং আরো কয়েকটি বিষয়ের পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এখন সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যের মধ্যে একটি।

খাদ্য নিরাপত্তা বলতে খাদ্যের লভ্যতা এবং মানুষের খাদ্য ব্যবহারের অধিকারকে বোঝায়। কোন বাসস্থানকে তখনই "খাদ্য নিরাপদ" বলে মনে করা হয়, যখন এর বাসিন্দারা ক্ষুধার্ত অবস্থায় বসবাস করেন না কিংবা খাদ্যাভাবে উপবাসের কোন আশঙ্কা করেন না। বিশ্ব খাদ্য সম্মেলন (১৯৯৬) অনুযায়ী "খাদ্য নিরাপত্তা তখনই আছে বলে মনে করা হয় যখন সকল নাগরিকের সব সময়ের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণে, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য প্রাপ্তির প্রত্যক্ষ ও অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা থাকে যা তাঁদের সক্রিয় ও সুস্থ জীবন নিশ্চিতকরণের জন্যে সঠিক পরিমাণ খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে।"

বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা অনেকটাই ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং ধানের মূল্য স্থিতিকরণের সমার্থক। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে সাথে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ প্রভূত সাফল্য অর্জন করলেও জনসঙ্খ্যার ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির দরুন নির্দিষ্ট পরিমাণ চাষযোগ্য জমির উপর সৃষ্ট চাপের জন্যে এই অগ্রগতি বজায় রাখা বেশ কঠিন। বন্যা, খরা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আভ্যন্তরীণ খাদ্য শস্য উৎপাদন ব্যাহত হয় যা খাদ্যের যোগানে অপ্রতুলতা সৃষ্টি, পাইকারি ও খুচড়া বাজারে চালের মূল্যের ঝুকিপুর্ণ ওঠানামার স্থায়ী হুমকি নিশ্চিত করে।
এমন সব প্রপঞ্চ বিবেচনায় এনে প্রতি বছর প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাদ্য সরবরাহের জন্যে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা'র (FAO) পাশাপাশি বাংলাদেশও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে জাতীয় খাদ্য নীতি ২০০৬ ও জাতীয় খাদ্য নীতি : কর্ম পরিকল্পনা ২০০৮-২০১৫ উল্লেখযোগ্য। এই নীতিগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো-

• যথেষ্ট পরিমাণ পুষ্টিকর খাদ্যের স্থায়ী সরবরাহ নিশ্চিতকরণ
• সর্বসাধারণের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি ও খাদ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিতকরণ
• সবার জন্যে, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের যথেষ্ট পরিমাণ পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিতকরণ

বাংলাদেশের আয়তন ১,৪৫,৫৭০ ব.কি. (৫৬,৯৭৭ ব.মা.) এবং বর্তমান জনসঙ্খ্যা প্রায় ১৫.৮৫ কোটিরও বেশি। জনসঙ্খ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১০৭৪.৫৪ জন! মাথাপিছু আয় মাত্র ৬৩৮ ডলার। মানব উন্নয়ন সূচক ০.৪৬৯ (HDI)। দেশের ৪০% মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে অবস্থান করছে এবং ৪৬% শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। অর্থাৎ পরিমিত এবং পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহে আমরা চরমভাবে ব্যার্থ।

বাংলাদেশ সরকার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বেশ অনেক বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং জাতিসঙ্ঘসহ আরো কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান মনে করে খাদ্যোৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। গত এপ্রিল মাসে (২ এপ্রিল, ২০১১) খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মুহম্মদ আব্দুর রাজ্জাক এক বিবৃতিতে বলেন যে বাংলাদেশ সরকার আগামী পাঁচ বছরের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে প্রায় ৮০০ কোটি ডলারের একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। কিন্তু খাদ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণে শুধুমাত্র বৃহৎ পরিসরে পরিকল্পনা গ্রহণ নয় বরং মাঠ পর্যায়ে খাদ্যের সঠিক বন্টন নিশ্চিতকরণও খাদ্য নিরাপত্তার একটি অংশ। কিন্তু বাংলাদেশের কৃষকগণ, যারা আমাদের মোট জনসঙ্খ্যার ৪৫%, তাঁদের উৎপাদিত ফসলের সঠিক মূল্য পাচ্ছেন না। কঠোর পরিশ্রমের পর পাইকারি ক্রেতাদের এক রকম জবরদস্তির ভেতর দিয়ে তাদেরকে নাম মাত্র মূল্যে ফসল বিক্রি করতে হয় যা ঢাকায় আসার পথে একাধিক স্থানে সরকারি টোল ছাড়াও স্থানীয় নেতাদের বেসরকারি টোল (!), বিভিন্ন চেক পয়েন্টে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে চাঁদা প্রদাণ এবং শহুরে আড়তদারদের কারসাজীতে দ্বিগুণ-ত্রিগুণ দামে খুচরা বাজারে বিক্রি হয়। ফলশ্রুতিতে কৃষক তাঁর প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হন এবং সাধারণ ভোক্তাগণ অধিক অর্থ খরচ করে চরম দূর্ভোগ পোহান। অর্থাৎ, প্রান্তিক এবং শহুরে উভয় দলের নাগরিকগণ ক্রমশ সাধারণ ক্রয় ক্ষমতা হারাচ্ছেন। খাদ্যের বন্টন ব্যবস্থাপনায় দূর্নীতির জন্যে এবং প্রান্তিক জনগণ ক্রয় ক্ষমতার নিচে অবস্থানের ফলে জাতীয় খাদ্য নীতির কোন শর্তই পূরণ হচ্ছে না এবং এই পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত স্থায়ী হয়ে উঠছে। এমন অবস্থায় ২০১৫ সালের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন সম্ভব নাকি তা নিছক আষাঢ়ে গল্প তা প্রশ্নের সম্মুখীন!