এতোদিন এই খবরগুলো অনলাইন পত্রিকা আর নিউজ সাইটগুলো থেকে জেনে আসছিলাম। আজ একুশে বই মেলা থেকে ফেরার পথে বাসে বসে কী মনে করে মোবাইলে বিবিসি নিউজ টিউন করলাম। তখন শুনলাম মোবারক ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছে!
আমি মিশরের কোন নাগরিক নই, মিশরের স্বৈরতন্ত্র আমাকে একজন মিশরীও নাগরিকের মতোন ভাবিত করে না তুললেও মুক্তিকামী মানুষ হিসেবে আমি আরো শতসহশ্র মানুষের মতোই আশঙ্কাগ্রস্ত ছিলাম।
বিবিসি নিউজের একজন করেস্পন্ডেন্ট তাহরীর স্কয়ার থেকে সরাসরি সম্প্রচারের সময় বলছিলেন-
“আমি এই অভাবনীয় পরিস্থিতি নিয়ে কিছু বলার আগে শুধু এই জনতাকে দুই তিন সেকেন্ড শুনুন”
তারপর আমি শুনতে পাচ্ছিলাম হাজার হাজার মানুষের গর্জন; আনন্দের-বিজয়ের-আত্মবিশ্বাসের গর্জন! সারা শরীরে যেনো নতুন একটা শক্তি অনুভূত হচ্ছিলো আমার; নিজেকে ঐ সহশ্র মানুষের একজন মনে হচ্ছিলো! বারবার উত্তেজিত কন্ঠে পার্শ্ববর্তী বন্ধুদের বলছিলাম এই খবর! ভেতরে ভেতরে গর্জন অনুভব করছিলাম প্রতি মুহুর্তে! বারবার একটাই কথা ফিরে ফিরে আসছিলো আমার ভেতর- ইনকিলাব জিন্দাবাদ, Long live revolution!
বাসন্ত বিষুব বলেছেনঃ
গণঅভ্যুত্থান নয় মিশরে ঘটেছে এক/এগারো বা সেনা অভ্যুত্থান
না, হলো না। মিশরে শেষ পর্যন্ত কোন গণঅভ্যুত্থান হলো না। হলো সেনা অভ্যুত্থান। লাখ লাখ মানুষ মোবারকের ৩০ বছরের শাসনের বিরুদ্ধে অন্যের অনুকরণে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করলো। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তিউনিসিয়ার মত সরকার হটিয়ে নতুন বেসামরিক জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা। আরব জনতা যে এমন কাজ করতে পারে তা কারোরি ধারণায় ছিল না। কিন্তু যা ভাবা হচ্ছে মিশরে কি আসলে তাই ঘটেছে? আমার তা মনে হয়না। অর্থাৎ মিশরে কথিত গণঅভ্যুত্থান ঘটেনি। প্রকৃত পক্ষে সেখানে ঘটেছে এক ধরণের পরোক্ষ সেনা অভ্যুত্থান। যা কিনা বাংলাদেশের ১/১১ এর সাথে তুলোনীয়।
বাংলাদেশে জনতার দুটি পক্ষের অব্যাহত হানাহানি আর রাজপথের সংহিসতার ফাঁক গলিয়ে তত্ববধায়ক সরকারের হাত থেকে সেনাবাহিনী যেভাবে শাসন ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিল ঠিক তেমনি মিশরের জনগণের বিক্ষোভের ফলে সৃষ্ট অস্থিরতার ফাঁক গলিয়ে সে দেশের শাসন ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছে সেনাবাহিনী। হোসনী মোবারক যখন নবনিযুক্ত ভাইস প্রেসিডেন্টের হাতে তার ক্ষমতা অর্পন করে বিদায় নিতে চেয়েছিলেন ঠিক তখনই সে দেশের সেনাবাহিনী তাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং সকল ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। ফলে যে উদ্দেশ্য আর আকাঙক্ষা নিয়ে এই বিক্ষোপ-বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল তা আর সোজা পথে সমাপ্ত হতে পারেনি। মোবারক বিদায় নিয়েছে এটা হয়তো আন্দোলনকারীদের জন্য সুখের বিষয় কিন্তু তাদের আন্দোলনের ফলাফল সুখকর নয়। অর্থাৎ একটি আদর্শ গণঅভ্যুত্থানের ফল মিশর পায়নি; ঠিক কবে পাবে সে নিয়েও রয়েছে অনেক সংশয়। কারণ সেনা চরিত্র কারোরি অজানা নয়। তাছাড়া, মিশরের সেনাবাহিনী যে মার্কিন সরকারের কাছে দায়গ্রস্ত সেটাও সবাই জানে। আর ইসরাইলে তো দারুণ সব ঘটনা ঘটছে। সেনা প্রধান বদল করা হয়েছে, শীর্ষ মার্কিন সেনা কমান্ডার সফরে গেছেন আর সিনাই উপত্যকা নতুন করে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য ইসরাইল সরকারের উপর চাপও বাড়ছে। ইসরাইল চাইছে, মৌলবাদী চক্র মিশরের ক্ষমতার অংশীদার হলে তারা পুনরায় সিনাই দখলে নেবে। আর এই অবস্থার প্রেক্ষিতেই মিশরের সেনাবাহিনীকে ঘোষণা করতে হয়েছে তারা কোন আন্তর্জাতিক চুক্তিই বাতিল করবেনা।
মোটকথা, ইসরাইল বিরোধী জনতা গণঅভ্যুত্থান ঘটাবার চেষ্টা করলেও ঘটেছে উল্টো। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মার্কিনপন্থী সেনাকর্তৃপক্ষ। যারা মোবারকের চেয়ে খুব বেশি কিছু মিশরের জনগণকে দিতে পারবেনা।