নিগৃহীত ও নির্যাতিত নারী এবং ‘বিবেকবান’ সমাজ: একটি পরিসংখ্যান

গালিব আফসারী
Published : 13 Jan 2017, 05:18 AM
Updated : 13 Jan 2017, 05:18 AM

বহু আগে নেপোলিয়ন বলেছিলেন, "আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি দেব।"

তারপর বিশ শতকের গোড়ার দিকে বিদ্রোহী নজরুল বলে গেছেন-

"সাম্যের গান গাই,

আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোন ভেদাভেদ নাই।

বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

বিশ্বে যা কিছু এল পাপ-তাপ,বেদনা অশ্রুবারি,

অর্ধেক তার আনিয়াছে নর,অর্ধেক তার নারী। "

নেপোলিয়নের জাতি গড়ার কারিগর সেই নারী আর নজরুলের সাম্যবাদের সেই নারী আজ শুধু ইতিহাসের পাতায়, কবিতার খাতায় সোনালী অক্ষরেই শোভা পাচ্ছে। নারীর প্রতি সহিংসতার রুপ দেখে আমার তাই মনে হয়।

এখন টিভি রিমোট চাপলে কিংবা পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে নারীর প্রতি সহিংসতার বিভৎস রুপ। যেন এই সমাজের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে কোন না কোন ভাবে নারীকে কষ্ট দেয়া, নির্যাতন করা, মানসিক ভাবে ভেঙে ফেলা, শারীরিকভাবে নিঃশেষ করা। প্রতিদিন ধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা, এসিড নিক্ষেপ, শ্লীলতাহানি, ইভটিজিং নিউজলাইনের নিয়মিত বিষয় হিসাবে আমরা দেখি।

আজ এই সভ্য জগতে বাস করেও, আল্ট্রামডার্ন যুগে থেকেও আমরা আদিমতাকে বজায় রেখে নারীর প্রতি হিংস্রতা চালিয়ে যাই। নারীর প্রতি অবিচার, অনধিকার, অস্বীকার, মারপিট, প্রতিটি কাজে খুঁত ধরা, মানসিকতাকে ভেঙে ফেলা ইত্যাদি বিষয়কে আমরা ছোট করেই দেখি কিংবা কেউ কেউ দেখিই না দু'চোখ দিয়ে, মগজ দিয়ে।

আমি গ্রামের ছেলে। যেহেতু এই সমস্ত নির্যাতন আর নৃশংসতা শহর থেকে গ্রামে বেশি ঘটে তাই অনেক ঘটনা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমার হয়েছে। সেই তখন থেকে, যখন আমি কথা বলতে শিখেছি, বুঝতে শিখেছি একটু আধটু তখন থেকেই আমার চারপাশে ঘটতেই আছে বিভিন্ন নৃশংসতা, নির্বিচারে নারীর উপর পুরুষের নির্যাতন।

আমার এখনো মনে পড়ে- যখন আমি দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি তখনকার ঘটনা। আমাদের বাড়ীর পাশেই এক দম্পতি থাকতো। প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠার পর স্বামীর চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে হত তাকে। খুবই সাধারণ বিষয় নিয়ে মহিলাটিকে মারতো, বকাঝকা করতো। এই যেমন, রান্নাবান্না করতে দেরি হলে, তরকারিতে লবণ কমবেশি হলে।

একদিন সকালে আমি ওই বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। তখন মহিলাটি তার স্বামীকে খাবার বেড়ে দিয়ে অন্যকোন কাজে উঠে চলে যায়। এরপরই একটি মুরগি চলতে চলতে হঠাৎ তার খাবারে পা দিয়ে ফেলে। এই নিয়ে সে মহিলাকে তুমুল বকা দিতে লাগলো। অশ্লীল গালাগালি করতে থাকলো। কেন সে খাবার দিয়ে উঠে চলে গিয়েছে। একপর্যায়ে তাকে চেয়ার দিয়ে এমন ভাবে মারতে থাকে যে চেয়ারের পায়াই ভেঙে যায়। মহিলাটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় তবুও তাকে মারতেই থাকে। এমনভাবে মারার পরও কিন্তু তার স্বামী তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়নি কিংবা চিকিৎসার ব্যাবস্থা করে নি।

তো এই হল অবস্থা! আমি এই ঘটনাটি এজন্য শেয়ার করলাম যে, এইরকম ঘটনা আমাদের চোখের সামনে কিংবা আড়ালে আবডালে প্রতিনিয়ত অহরহ ঘটেই যাচ্ছে। আমরা কোন প্রতিকার করতে পারছিনা।

স্ত্রী নির্যাতনের বিষয়টাকে আমাদের কানা সমাজে স্বাভাবিক একটা দিক হিসাবে ধরা হয় এখনো। স্ত্রী কোন দোষ করলে আমরা এটা ধরে নেই যে, স্বামীর অধিকার আছে স্ত্রীকে বকাঝকা করার বা প্রহার করার। এই বলে আমরা নিবৃত হই। আমাদের এই নোংরা মানসিকতার কাছে পরাজিত হয়ে প্রতিদিন অসংখ্য নারী তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছেন, তাদের জীবন হয়ে উঠছে স্বামীরুপ এক মনিবের কাছে দাসীর মত! যে জীবন সারাদিন সংসারে গরুর মত খাটার জন্য, বকা খাওয়ার জন্য আর মারধরে নিরবে সয়ে যাওয়ার জন্য।

এরই মাঝে আবার আরেক গজব হিসাবে সমাজ যৌতুক প্রথাকে বজায় তো রেখেছেই। যা নির্যাতনের আরো এক মাত্রা বাড়িয়ে বাড়িয়ে দেয়। একটি কিশোরী যখন বাবার কাছে থাকে তখন হয়তো ভালোই থাকে কিন্তু বিয়ের পর যখন স্বামীর ঘরে যায় তখন অন্যান্য ব্যতিক্রমতার সাথে যৌতুকের চাপ তাকে এটা বলে দেয়, পৃথিবী শুধু স্বার্থের জন্য, টাকার জন্য, পুরুষের জন্য!

হিন্দু সংস্কৃতি থেকে উঠে আসা এই যৌতুক প্রথা আজ আমাদের সমাজে এমন ভাবে গেড়ে বসেছে যে, একটু ব্যতিক্রম হলেই জীবন দিতে হচ্ছে নারীদের। শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে, না খাইয়ে রাখা হচ্ছে, দীর্ঘদিন বাবার বাড়ীতে রাখা হচ্ছে, মারধর করে পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে, নির্যাতনের মাত্রা সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে অসংখ্য নারী।

দেশে আইন আছে যৌতুকের বিরুদ্ধে। কিন্তু তা শুধু আইন প্রণেতা আর আইন বইয়েই সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে, যার কোন বাস্তব প্রয়োগ কখনওই আমরা দেখিনা।

আমাদের সমাজকে নারীর প্রতি নৃশংসতার দিকে ঠেলে দেয়ার অন্যতম কারণ, প্রশাসনের উদাসীনতা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করা, স্ত্রী নির্যাতনকে একটা স্বাভাবিক বিষয় ভেবে প্রশাসনকে না জানানো, নারীরা নিজেদেরকে অবহেলিত মনে করে চুপ করে থাকা, প্রতিবাদিনী না হয়ে সবই ভাগ্য বলে দুঃখ করা এবং মেনে নেওয়া, পুরুষের অন্যায় অধিকারকে স্বীকারপূর্বক নিজেকে দাসী ভেবে সংসার চালিয়ে যাওয়াসহ আরো অসংখ্য কারণ আছে।

আমাদের চোখের সামনেই তো প্রতিদিন কত ঘটনা ঘটে, আমরা না দেখার ভান করে থাকি বা স্বাভাবিক নিয়ম ভেবে চুপ থাকি!

এইতো গত পরশুর ঘটনা, আধুনিক এই রাজধানীতে একটি ঘৃণ্য কাজ প্রত্যক্ষ করতে হল আমাকে। আমি যাত্রাবাড়ী থেকে ধলপুর যাচ্ছি টিউশনিতে। হঠাৎ একটি বাসার নীচতলা থেকে হাউমাউ করে কান্নার আওয়াজ আর যেমন করে সাপ পিটায় তেমন দড়াম দড়াম আওয়াজ শুনে আমি থমকে দাঁড়ালাম। কিছু উৎসুক পুরুষ-মহিলা ঘটনাস্থলে ভীড় করে আছে। একজন মহিলাকে তার স্বামী মাটিতে ফেলে বাঁশ দিয়ে পিটাচ্ছে। এই পরিস্থিতির মাঝে হঠাৎ এক লোক বলতেছে, "ঠিকই আছে, যেমন কুকুর তেমন মুগুর!"

আমি হতবাক! আমি নির্বাক এই কথা শুনে! কি বলবো? শুধু বলাতে আর শাস্তির ভয়ে কাজ হবে না। আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে। আমাদের চিন্তাধারা বদলাতে হবে। মানবিকতা বিষয়টাকে আমরা যতক্ষণ না আমলে নিতে পারছি ততক্ষণ এই অবস্থা সমাজে চলতেই থাকবে।

♦একটি পরিসংখ্যান →→

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) নারী নির্যাতন নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে একটি জরিপ চালিয়েছে। "ভায়োলেন্স আগেইন্স উইমেনস (ভিএডব্লিউ)সার্ভে ২০১১"এই জরিপে নারী নির্যাতনের অনেক তথ্য উঠে এসেছে।

বিবিএস বলছে, দেশের বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশই কোন না কোন সময়ে কোন কোন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ বলেছেন,তারা স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতন ভোগ করেছেন। ৩৬ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার, ৮২ শতাংশ মানসিক এবং ৫৩ শতাংশ নারী স্বামীর মাধ্যমে অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিস্ময়কর আরো তথ্য হচ্ছে, এসব নারীর ৭৭ শতাংশই বলেছেন তারা বিগত একবছরেও একই ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

বিবিএসের এই জরিপ বলছে, যেসব নারীরা শারীরিক নির্যাতনের স্বীকার হন সেসব নারীদের মাঝে মাত্র অর্ধেক চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ পান। একতৃতীয়াংশ নারীই স্বামীর ভয়ে বা স্বামী সম্মতি না দেয়ার কারণে চিকিৎসকের কাছ পর্যন্ত যেতে পারে না!

এদিকে আমরা দেখতে পাই, শহরের তুলনায় গ্রামে নারী নির্যাতনের হার বেশি। আবার বয়স অনুযায়ী নির্যাতনের হার পাল্টাতে থাকে। আবার যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে অবিবাহিত নারীরা বেশি ঝুঁকির মাঝে থাকলেও মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে বিবাহিত নারীরা এর শিকার বেশি হন।

বিবিএসের জরিপে ৭ শতাংশ নারী জানিয়েছে, নির্যাতনের কারণে তারা আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছে। বিবাহিত এইসব নারীদের ৫৬ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগেই।

সূত্রমতে, ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নারী নির্যাতনের বা নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৩১ হাজার ৬৬৯ টি। এর মাঝে ২০১০ সালে নারীর প্রতি নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ৫৫৭০ টি, ২০১১ সালে ৬৬১৬ টি, ২০১২ সালে ৫৬১৬ টি, ২০১৩ সালে ৪৭৭৭ টি, ২০১৪ সালে ৪৬৫৪ টি এবং ২০১৫ সালে ৪৪৩৬ টি।

এদিকে আমরা আবার সাধু হয়ে বুলি আওড়াই নারীর অবাধ স্বাধীনতাকে নিয়ে। আমরা বলি নারী স্বাধীন কিন্তু কিন্তু দেশজুড়ে অপহরণের চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। ২০১০-২০১৫ পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার নারীকে অপহরণ করা হয়। অন্যদিকে নারী ও শিশু পাচার, নারীকে পতিতালয়ে বিক্রি, যৌতুকের কারনে হত্যা, বাল্যবিবাহ ও পুলিশের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে হাজার তিনেকের উপরে। এই সময়ে নারীকে পতিতালয়ে বিক্রির সংখ্যা প্রায় ৫০০।

এতক্ষণ তো শুধু বই-খাতায় লিপিবদ্ধ নির্যাতনের সংখ্যা গুলো তুলে ধরা হলো। যা পুলিশ কেসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলো কিংবা যা আমরা জেনেছি তা। কিন্তু প্রতিদিন আমাদের অগোচরে, মিডিয়ার অগোচরে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটতেছে যা এই পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত করলে কয়েকগুণ ছাড়িয়ে যাবে।

নারীর প্রতি সংঘটিত অপরাধকে খাটো করে দেখা, আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়া, সাক্ষীকে ভয় দেখানো, প্রভাবশালীদের অর্থের প্রলোভন ও নির্যাতিত পরিবার ঘটনা চেপে যাওয়ার চেষ্টার কারণেই নারী নির্যাতন রোধ সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। আমরা সবাই হয়তো নেপোলিয়ন বা নজরুলের মত করে ভাবতে পারিনা, কিন্তু আমরা যদি আমাদের বিবেককে জিজ্ঞেস করি এই যে নৃশংসতা, নির্যাতনের স্টিম রোলার এ থেকে তুমি কি পেলে? বা সমাজ কি পেল? এর কারণে কি অশান্তি নেমে আসেনি সংসারে বা সমাজে?

আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটাকে বদলানো দরকার। যদিও আইনের শাসন আমাদের মাঝে কতটুকু আছে তা প্রশ্নবিদ্ধ তবুও যেখানেই যেভাবেই কোন নির্যাতন হতে দেখি না কেন দ্রুত প্রশাসনকে জানানো উচিত।

নারীদের শুধু মাদার তেরেসা হলেই হবে না, তাদের প্রতিবাদী হতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা যখন সোচ্চার হবে। তখনি আর কেউ সাহস করবে না তাদের প্রতি সহিংস হতে।