মুখের ভাষা, কলমের ভাষা

গুঞ্জন রহমান
Published : 12 Jan 2015, 07:54 PM
Updated : 12 Jan 2015, 07:54 PM

আমাদের স্কুলগুলোতে কি আজকাল ব্যাকরণ শেখানো বন্ধ হয়ে গেছে? নৈর্ব্যক্তিক পদ্ধতির "টিকমার্ক-কায়দা"য় পরীক্ষা দিতে দিতে ছাত্রছাত্রীরা কি পূর্ণ একটি বাক্য লেখার অভ্যাস প্রায় ছেড়েই দিয়েছে? ফেসবুক কিংবা অন্যান্য বাংলা ব্লগ পেজগুলোতে বাংলা পোস্টগুলো পড়তে গিয়ে আজকাল খুব চোখে লাগে! শহুরে বাংলাদেশীর মুখের ভাষা অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে, যার ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে ছবিয়াল বাহিনীর নাটকের মাধ্যমে, এখন শুরু হয়েছে লেখার ভাষা নষ্ট করার প্রতিযোগিতা।

লক্ষ্যণীয় যে, ভাষা চর্চায় আঞ্চলিকতার প্রভাবের আমি মোটেই বিরোধী নই, কারণ বৃহদার্থে বাংলা প্রমিত ভাষাও একটি আঞ্চলিক ভাষা। সেই দৃষ্টিতে চট্টগ্রাম কিংবা সিলেট কি ঢাকা অথবা রাজশাহী বা রংপুর নয়ত কুষ্টিয়া নচেৎ পাবনা … ইত্যাদি সমস্ত অঞ্চলের ভাষারই আলাদা আলাদা শ্রুতিমাধুর্য আছে, যা আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। কোনো একটি আঞ্চলিক ভাষা যথাযথ উচ্চারণ করতে পারার মধ্যেও মুন্সীয়ানা আছে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। আমি নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষা যতটা ভালোবাসি, ততটাই মুগ্ধ হই বরিশালের কথ্যভাষায়। দিনাজপুরের ভাষা আয়ত্ব করতে গিয়ে আমাকে সচেতন থাকতে হয় পার্শ্ববর্তী রংপুরের কথ্য-সুর যেন তাতে মিশে না যায়, কেননা রংপুরের ভাষাটিরও যে রয়েছে আলাদা আবেদন!

কিন্তু আজকাল, বিশেষভাবে টিভি নাটকে যে ভয়াবহ মাত্রায় ভাষা ধ্বংসের ষড়যন্ত্র চলছে, তার থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? আমার নানা যখন তাঁর কোনো ছেলে বা মেয়ের প্রসঙ্গে কারো সাথে কথা বলতেন, তখন এমনকি ছেলেমেয়েদের জন্যেও 'আপনি' সম্বোধন ব্যবহার করতেন! যেমন, ধরা যাক তিনি তাঁর মেজো ছেলের বিষয়ে বলছেন, "আমার মেজো ছেলে নাসিহ্ নাটোরে থাকেন, সরকারী স্কুলে শিক্ষকতা করেন"; অথচ আজকাল প্রায়ই পড়তে গিয়ে বিরক্ত হই, "আমার বাবা আমাকে অনেক আদর করতো, সে আমাদের কখনো মারে নাই"! অনেক বড় বড় তারকাকেও টিভিতে বিভিন্ন টকশো-তে হরহামেশাই বলতে শুনি – তিনি অনেক সুন্দর ছিল কিংবা সে আমাকে খুব সাপোর্ট দিসেন!

কবীর সুমনের গান কিংবা জুয়েল আইচের যাদু অথবা সুবর্ণা মুস্তাফার অভিনয় আমাকে যতটা না টানে, তার চেয়ে অনেক বেশি টানে তাঁদের মুখের কথা। সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারাটাও একটা শিল্প, এবং এটা শেখার জন্য কোনো স্কুলে ভর্তি হতে হয় না, শুধু দরকার হয় একটু মনযোগ দেয়া। কী বলছি, তা ভেবে বলবো না? যা মুখে আসে, তাই বলে ফেলবো? মুখের কথা বন্দুকের গুলির মতো, একবার বেরিয়ে গেলো তো আর ফিরিয়ে নেবার উপায় নেই, কিন্তু লেখার ক্ষেত্রে তো অন্তত এটুকু সুবিধা আছে যে, কী লিখলাম তা একবার পড়ে দেখা যায়, ভুলত্রুটি সংশোধন করে নেয়ার সুযোগ থাকে। তার পরও দেখে দেখে লেখা বাক্যে এত ভুল কেন?

… অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার ব্র্যাড হজ যেদিন প্রথমবার শচীন টেন্ডুলকারের উইকেট পেলেন, সেদিন ইনিংস শেষে বলটি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন শচীনের দিকে, অটোগ্রাফের জন্য। শচীন স্বাক্ষর করবার আগে বলটিতে লিখেছিলেন "It Will Never Happen Again". শচীন কিন্তু তাঁর কথা রেখেছেন, ব্র্যাড দ্বিতীয়বার তাঁকে আউট করতে পারেননি! – এটা হলো আত্মবিশ্বাসের গল্প। যেমন আত্মবিশ্বাসের সাথে প্রাবন্ধিক ও নাট্যকার মাহবুব কামাল আমাকে বলেছিলেন, তুমি আমার কোনো লেখায় কখনো বানান ভুল বা ব্যাকরণগত অথবা ভাষাগত ভুল বের করতে পারবে না। এবং সত্যিই আমি আজো সেটা পারিনি।

তেমন আত্মবিশ্বাসী লেখক এই প্রজন্মে আর কি জন্মাবেন না?