পিতৃ-হন্তারকের পাপ-স্বীকারোক্তি

গুঞ্জন রহমান
Published : 16 August 2015, 03:47 AM
Updated : 16 August 2015, 03:47 AM

এই বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, অধিকাংশ জনপ্রিয় নেতা ও প্রজাবৎসল রাষ্ট্রনায়কই খুব অদ্ভূতভাবে, অকালে নিহত হয়েছেন কিংবা অস্বাভাবিকভাবে বিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে। নেপোলিয়ানকে নির্বাসিত করা হয়; হত্যা করা হয় সক্রেটিস, সিরাজউদ্দৌলা, চে গ্যেভারা, মাস্টারদা সূর্যসেন, ক্ষূদিরাম বসুকে; আততায়ীর গুলিতে নিহত হন আব্রাহাম লিংকন, কেনেডি, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, মহাত্মা গান্ধী; আত্মহত্যায় বাধ্য হন হিটলার (হিটলার সারা পৃথিবীর ত্রাস হলেও জার্মান জাতি জীবদ্দশায় তাঁকে শ্রদ্ধা করতো বলেই জানা যায়)। খোলাফায়ে রাশেদীনের চার সদস্যসহ রক্ষা পাননি এমনকি মহানবী (সাঃ)-র আদরের দুই দৌহিত্রও! ইন্দিরা গান্ধী, প্রেমাদাসা, রাজীব গান্ধী, ইয়াসির আরাফাত, বেনজির ভূট্টো, সাদ্দাম হোসেন, মুয়াম্মার গাদ্দাফি … এই তালিকা খুব ছোট নয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবদ্দশায় যেমন ছিলেন বিশ্বের এক অত্যুজ্জ্বল, অনন্য ব্যক্তিত্ব, মৃত্যুর মধ্য দিয়েও তিনি ব্র্যাকেটবন্দী হয়েছেন ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মহানায়কদের – কেবল এইটুকুই সান্তনা। নয়ত, আমরা আমাদের পিতাকে হত্যা করেছি – জাতি হিসেবে এর চেয়ে বড় গ্লানি আমাদের আর কী হতে পারে! যে মানুষটি তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করলেন এই দেশটির জন্য, দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য, মুক্তির জন্য, স্বাধীন পরিচয়ের জন্য, আমরা তাঁকে ভুল বুঝলাম। আমরা তাঁর অন্ধবিশ্বাসের আড়ালে ষড়যন্ত্র করেছি, দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তৈরি করেছি হত্যার নীলনকশা। বাঙালী জাতির আর একটি কথাও বলার কোনো অধিকার নেই তাঁর হত্যাকাণ্ড বা এই অনাকাঙ্ক্ষিত অকাল প্রয়াণ নিয়ে।

একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে তিনি যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তা এক কথায় অনন্য। সর্বপ্রকার সিস্টেম ভেঙ্গে পড়েছিল তখন দেশের। অবকাঠামো নেই, ব্যবসা-বাণিজ্য নেই, শিল্প-কারখানা ধ্বংস, কৃষিকাজ প্রায় দুঃসাধ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। দেশ চলছে বিদেশী সাহায্য আর অনুদানের উপর। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রজুড়ে হাহাকার। ক্ষূধা, বেকারত্ব, কর্মহীনতা। লোভ, সন্দেহ। আর সীমাহীন প্রত্যাশা। প্রত্যেকেই চায় স্বাধীন দেশে যে যার ইচ্ছেমতো সবকিছু ভোগ করবে। শত বছরের গোলামীর অবসানের পর কেউ আর কারো বশ্যতা স্বীকার করে না। কেউ কারো দ্বারা শাসিত হতে চায় না। এমনকি চায় না আইনের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল থাকতে। কোনো নিয়ম না মানাটাই যেন নিয়ম তখন। সকলের মধ্যেই তখন যুদ্ধজয়ী বীরের ঔদ্ধত্ব। এরকম একটি পরিস্থিতিতে অনেক অনিয়ম হয়, অব্যবস্থাপনা থাকাটাও স্বাভাবিক। সেসব দমন করতে যতটা কঠোর হওয়া প্রয়োজন, তিনি হয়ত ততোটা হতে পারেননি। পারেননি, সেটা তাঁর ব্যর্থতা নয়, পিতা হিসেবে তাঁর সন্তানবাৎসল্য। মুঘল মেরেছে, পাঠান মেরেছে, মেরেছে বৃটিশরা, পাকিস্তানীরাও… সেই দেশবাসী মা-মাটির সন্তানেরা যত বেয়াড়াই হোক, পিতা হয়ে তাদের উপর তিনি কঠোর হবেন কোন্ প্রাণে? … তার উপর একাত্তরের পরাজিত শক্তির মরিয়া হয়ে গুপ্ত আঘাত তো ছিলই। যতখানি আত্মত্যাগ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে আমরা করতে পেরেছি, তার সিকিভাগ ত্যাগের মহত্ত্বও এর পরের দিনগুলিতে আমরা কেউ দেখাতে পারিনি। যেন দেশ স্বাধীন করার মধ্য দিয়েই আমাদের দেশপ্রেমের চির অবসান ঘটেছে, শুরু হয়ে গেছে আত্মপ্রেমের চর্চা (যা চলমান আছে এখন পর্যন্ত), যার ভয়ঙ্করতম বিস্ফোরণই হলো ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। এক দল উচ্ছৃঙ্খল সেনা সদস্য আর কতিপয় সুযোগ-সন্ধানী রাজনীতিকের চূড়ান্ত কৃতঘ্নতায় সারা বিশ্বের কাছে আমাদের "হেঁটমুণ্ডু নতজানু" হওয়া। যে মানুষটির কারণে জাতি হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে আমরা হয়েছিলাম চির-উন্নত-শির, সেই মানুষটির বুকে নৃশংস, ভয়ঙ্করতম, পশুবৎ আক্রমণের মধ্য দিয়েই আমাদের পেছনে চলার শুরু।

প্রাসঙ্গিকভাবেই বলা চলে, এই ১৫ আগস্টের বীজ বোনা ছিল আসলে পঁচাত্তরে নয়, বরং সেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়েই। এ কথা ভোলার নয় যে, আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনালগ্নেই, পঁচিশে মার্চের কালরাত্রীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্র হলে এবং জ্ঞানীগুণী শিক্ষকবৃন্দের আবাসিক ভবনগুলিতে প্রবেশ করে হানাদার পাকবাহিনী এক নৃশংসতম হত্যাকা- চালায়। অগণিত ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষক, অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবীগণ। এর উদ্দেশ্যই ছিল বাঙালী জাতিকে মেধাশূন্য করে একটি পশ্চাদপদ, অকর্মণ্য জাতিতে পরিণত করা। এরপর মুক্তিযুদ্ধ যতই বেগবান হয়েছে, সারা দেশ থেকে আওয়ামী লীগের সকল প্রবীণ-নবীণ নেতৃত্বকে এদেশীয় দালাল চক্রের ইন্ধনে ও প্রত্যক্ষ মদদে খুঁজে খুঁজে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তারও লক্ষ্য সেই একই – দেশকে নেতৃত্বশূন্য করে বাঙালী জাতির এগিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করা। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে, সেখানকার কারাগারে বিচারের নামে সামরিক আদালতের প্রহসনমূলক রায়ে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়। যে সেলে তিনি বন্দী ছিলেন, তার পাশে তাঁর জন্য কবর পর্যন্ত খোঁড়া হয়।

কিন্তু এতটা সাহস পাকিস্তানের কোনো সামরিক জান্তা কিংবা বেসামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাঝে ছিল না যে, সিংহ-হৃদয় শেখ মুজিবের মৃত্যুদণ্ড কেউ কার্যকর করে। ফলে তাদের সেই আত্মঘাতি পরিকল্পনা থেকে ফিরে আসতে হয়। কে না জানে, কাপুরুষদের শেষ আশ্রয় হলো ষড়যন্ত্র। তারাও তাই বেছে নেয় ভয়ঙ্কর ষঢ়যন্ত্রের পথ। আর সেই ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন হিসেবেই তারা ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের প্রাক্কালে আরেক ম্যাসাকার ঘটায় ১৪ ডিসেম্বর গভীর রাতে। কার্ফিউ চলাকালীন আল বদর আর আল শামস বাহিনীর সহায়তায় তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে খুঁজে বের করেন দেশের অবশিষ্ট বেঁচে থাকা বুদ্ধিজীবীদের, চোখ বাঁধা অবস্থায় সামরিক বাহনে তুলে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় অজ্ঞাত স্থানে, শেষ পর্যন্ত তাঁদের সন্ধান মেলে রায়ের বাজারের বদ্ধভূমিতে, বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ক্ষত-বিক্ষত গলিত লাশের আকারে! এই কাপুরুষোচিত হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল একটাই – বঙ্গবন্ধুকে তারা মুক্তি দিতে বাধ্য হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মুক্ত হবার পর, স্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি যেন দেশ চালানোর মতো কোনো মানবসম্পদ হাতের কাছে না পান, মেধাবী সহযোগীর অভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হন, দেশ পরিচালনায় পদে পদে ঠোকর খেয়ে জনগণের চোখের মণি থেকে চক্ষূশূলে পরিণত হন। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, মেধাবী মানুষগুলোকে হারিয়ে তিনি যেন 'ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সরদার'-এ পরিণত হন।

কিন্তু মূর্খ পশ্চিমারা তো জানতো না যে, বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ প্রজ্ঞা, অসীম দৃঢ়তা আর ইস্পাত-কঠিন মনোবলের সামনে কোনো কিছুই অজেয় নয়। আর তাই, যুদ্ধ বিধ্বস্থ বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করেছিল মাত্র তিন সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই! তার নমুনা যখন প্রদীপ্ত সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করছে; তিনি যখন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হতে শুরু করেছেন এক দোর্দণ্ড প্রতাপশালী নেতা ও সিংহহৃদয় পিতার মতো শাসক হিসেবে; জাতিসংঘ, ওআইসি, কমনওয়েল্থ – বিশ্বসভার প্রায় সকল ফোরামে তিনি স্বাগত হচ্ছেন, সম্মানিত হচ্ছেন; যখন ফিদেল কাস্ত্রো'র মতো পলিটিক্যাল মায়েস্ত্রো পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করে বলছেন – "আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি!" – তখন পরাজিত পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় ব্যাতিব্যস্ত হবার কারণ আছে বৈকি! আর সেই উদ্বেগেরই বহিপ্রকাশ – এই আগস্ট ট্রাজেডি।

প্রাসঙ্গিকভাবেই বলা চলে, ১৫ আগস্টের পথ বেয়েই সূচিত হয়েছিল ৩ নভেম্বরের জেল-হত্যাকাণ্ড – যা ইতিহাসের নির্মমতম এবং কাপুরুষোচিত এক হত্যাকাণ্ড। বঙ্গবন্ধু স্বপরিবার নিহত হবার পরও এই খুনিচক্র স্বস্তি পাচ্ছিল না, নিজেদের কূচক্রের মসনদকে আরো সুসংহত করার অভিপ্রায়ে জেলখানার অন্ধকার সেলের ভেতর ব্রাশফায়ার করে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামান – বঙ্গবন্ধুর এই চার সহযোগী, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নসারথী, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে দেশের ভবিষ্যত নেতৃত্বকে।

এমনকি সেই ১৫ আগস্টেরই ধারাবাহিকতায় এদেশে আরো একবার সূচিত হয়েছিল রক্তাক্ত এক ন্যাক্কারজনক ইতিহসের – সেও এই আগস্ট মাসেই! এক আগস্টে জাতির জনক নিহত হলেন স্বপরিবারে, তাঁর খুনিচক্রই নতুন করে পরিকল্পনা করলো – আরেক আগস্টে জাতির জনকের কন্যাকে হত্যা করা হবে তাঁর সকল রাজনৈতিক সহকর্মীর সঙ্গে একত্রে – দেশের ইতিহাসে স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি বলেই কিছু আর অবশিষ্ট থাকবে না! ফলে, এবার আর রাতের অন্ধকারে নয়, প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রেনেড ছুঁড়ে আক্রমণ করা হলো শান্তিুপূর্ণ সমাবেশের উপর। হায় ভাগ্যের পরিহাস! বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত ২১ আগস্টের সেই সমাবেশ ছিল এই ১৫ আগস্ট উদ্যাপনেরই কর্মসূচি। … পিতার অবদানের কৃতজ্ঞতায় কন্যার প্রতি বাঙালী জাতির হৃদয়ছেঁড়া দোয়া আর আশীর্বাদেই বুঝি সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা, অগণিত হতাহতের সঙ্গে যুক্ত হলো বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি আইভি রহমানের নাম, যিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও পরবর্তীতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ঊনিশতম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিনীও!

কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধর্মের কল বাতাসে নড়েছে। ইতিহাসের সর্ববৃহৎ ব্যালট-বিজয়ের মাধ্যমে, জনগণের পূর্ণ ম্যান্ডেট নিয়ে শেখ হাসিনারই নেতৃত্বে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোট। আর এর মধ্য দিয়ে, অনেক দেরিতে হলেও আমরা হাঁটতে পেরেছি পিতৃহত্যার পাপ স্খলনের পথে। বঙ্গবন্ধুর চিহ্নিত, আত্মস্বীকৃত খুনীদের আমরা আইনের মুখোমুখি করেছি। প্রথমবার ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার যে বিচার-প্রক্রিয়া শুরু করেছিল, পরবর্তীতে ক্ষমতায় এসে চারদলীয় জোট সরকার যে বিচারকাজকে বারংবার নানা কায়দায় বিঘ্নিত ও বানচাল করার ষড়যন্ত্র করেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল; ২০০৮ সালের ঐতিহাসিক নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে সেই বিচারকাজ সফলভাবে সমাপ্ত হয়েছে। বিদেশী চ্যানেলের পর্দায় দম্ভের সাথে নিজেদের জাতির জনকের খুনী বলে ঘোষণা করা ইতিহাসের নিকৃষ্টতম পিশাচেরা দেশের প্রচলিত আইনেই শাস্তির সম্মুখীন হয়েছে, শেষ পর্যন্ত তারা হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়েছে, প্রাণভিক্ষা চেয়েছে।

কিন্তু যে পাপ তারা করেছে, তার কি ক্ষমা হয় আদৌ? যে অপরাধ তারা করেছে, তার তো দায়শোধ নেই কোনোভাবেই। তাই তারা ফাঁসিতে ঝুলেছে, আর কতিপয় দাম্ভিক খুনী এখন কীটানূকীটের মতো এই দেশ থেকে সেই দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছে প্রাণের ভয়ে।

আর প্রজন্মের কণ্ঠে উচ্চারিত দাবী, ত্রিশ লক্ষ শহীদ পরিবারের দাবি, ষোল কোটি বাঙালীর গণদাবি – একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার – এই ঐতিহাসিক ঘটনাটিও ঘটতে শুরু করেছে এই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারেরই প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে। ফাঁসি হয়েছে মিরপুরের কসাই, কুখ্যাত রাজাকার কাদের মোল্লার, ফাঁসি হয়েছে আরেক গণহত্যাকারী কামারুজ্জামানেরও; কনডেম্ড সেলে বসে মৃত্যুর দিন গুণছে আরও কত জন!

তবে পিতৃহত্যার বিচারের মধ্য দিয়ে হয়তো কেবল খুনীদের বিচার হয়েছে; কিন্তু যারা এই খুনের চক্রান্ত করেছিল, যারা খুনিদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল একুশ বছর, দেশে ও বিদেশে অতি-গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদে নিয়োগ দিয়ে তাদের পুরস্কৃত করেছিল, পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল, এমনকি যারা এই বহুল প্রত্যাশিত ও দীর্ঘবিলম্বিত ন্যায়বিচার পর্যন্ত মেনে নিতে পারেনি বিধায় বিচার চলাকালীন সময়ে এমনকি সাজা কার্যকর হবার মুহূর্তে পর্যন্ত নানানভাবে বিচারকাজকে বিঘ্নিত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল – তাদের বিচার কি হবে না? আর কত দিন তারা আমাদের শান্তিপ্রিয় ক্ষমাশীল মনভাবের সুযোগ নিয়ে পিঠে ছুরি মারার জন্য চক্রান্ত করেই যাবে?

https://www.youtube.com/watch?v=ywOe6lAlrPk

বলতে দ্বিধা নেই, এত কিছুর পরও, পিতৃহত্যার এই অমার্জনীয় পাপ থেকে জাতি হিসেবে আমাদের কারুর মুক্তি নেই। কোনো অনুশোচনাই যথেষ্ট নয় এ পাপক্ষয়ে। যত দিন পৃথিবীর বুকে বাঙালী জাতির অস্তিত্ব থাকবে, ততোদিন এ পাপ আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে। বেঁচে থাকলে কোমল-হৃদয়, 'সু-পিতা' বঙ্গবন্ধু নিজেই হয়তো ক্ষমা করে দিতেন তাঁর কু-সন্তানদের, কিন্তু তা বলে আমরা নিজেরা কখনো কি পারি নিজেদের ক্ষমা করতে? জনকের হন্তারকের জন্য এ একই সাথে পৃথিবীর সবচেয়ে লঘুদণ্ডের পাশাপাশি সবচেয়ে গুরুদণ্ডও। কোনো প্রায়শ্চিত্যেই রক্ষা মেলে না, কোনো অনুশোচনাই যথেষ্ট নয়; আপন পিতাকে হত্যা করার মতো নৃশংসতম পাপ থেকে পরিত্রাণ আমাদের কারুর হয়না, কোনো দিন না!