বন্যার পানি নেমে গেলে

গুঞ্জন রহমান
Published : 24 August 2017, 07:54 AM
Updated : 24 August 2017, 07:54 AM

একটা সর্বগ্রাসী দুর্যোগ সামাল দেয়ার মতো সার্বিক সক্ষমতা কি আমাদের আছে? আমি এই প্রসঙ্গটা এর আগেও একবার তুলেছিলাম। যেহেতু আজকের পৃথিবী প্রায় প্রতি মুহূর্তেই কোথাও না কোথাও যুদ্ধোংদেহী চেহারা নিয়ে ফুঁসে উঠছে, তাই যুদ্ধের আঁচ থেকে আমরা খুব একটা নিরাপদ দূরত্বে বাস করি না। ধরুন, এই মুহূর্তে আমাদের খুব নিকটবর্তী কোনো একটি দেশে গৃহযুদ্ধ কিংবা দ্বিপাক্ষিক-ত্রিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক যুদ্ধ লেগে গেলো এবং অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাদের সেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হলো। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি, যুদ্ধকালীন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি সামাল দেয়ার মতো সকল বিভাগে চৌকষ নেতা আমাদের আছে কি? – এই প্রশ্নটা আমি বছর তিনেক আগে একবার করেছিলাম। তখন এই প্রসঙ্গে ব্যাপক আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হয়ে থাকলেও আমরা কেউই কোনো সমাধানে আসতে পারিনি। আমার মনে হয়, তেমন দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে আমরা এবার সত্যিই পড়ে গেছি।

না, সশস্ত্র যুদ্ধ আদতে নিকটবর্তী কোথাও শুরু হয়নি বটে, তবে আমাদের দুর্যোগটা তার চেয়েও ভয়াবহ। দেশের যে বন্যা পরিস্থিতি গত দশ দিনেরও বেশি সময় থেকে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে (মূলত বন্যা চলছে তারও অনেক আগে থেকে। একবার থেমে গিয়ে আবারও শুরু হয়ে ঘুরে ফিরে উত্তরের বিভিন্ন জনপদ জলমগ্নই থেকে গেছে বর্ষার প্রায় শুরু থেকে), সেই বন্যা কোনো সশস্ত্র যুদ্ধের চেয়ে কম নয়। এখনও পর্যন্ত চলমান এই সঙ্কট দেশে কী কী বিপর্জয় আনতে যাচ্ছে, তা একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলেই যে কেউ বিপদটা অনুমান করতে পারেন।

১. দেশের প্রধান খাদ্যশস্য আমন ধান এবার উত্তরাঞ্চলের জমিগুলো থেকে একেবারেই পাওয়া যাবে না। দেশের মোট চালের চাহিদার অর্ধেকেরও বেশি পূরণ করা হয় যে শস্য থেকে, তা এবার পুরোপুরি শূন্য। এর চেয়ে বড় দুঃসংবাদ সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে আর এসেছে কিনা সন্দেহ।

২. মাত্রাতিরিক্ত দীর্ঘ বর্ষায় প্রায় সারা দেশের পাকা সড়কগুলো বড় ধরণের ক্ষতির শিকার হয়েছে। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান সড়ক ঢাকা-বগুড়া-রংপুর-দিনাজপুর এবং ঢাকা-সিরাজগঞ্জ-রাজশাহী সড়ক একদমই ব্যবহার-অযোগ্য হয়ে গেছে। কুষ্টিয়া ঝিনাইদহ হয়ে যশোহর খুলনা সড়কও যাচ্ছেতাই অবস্থায়। বিকল্প কোনো উপায় নেই বিধায় এই ভাঙ্গা সড়কেই গাড়ি চলছে জান-মালের ঝুঁকি নিয়ে, তাতে সড়কের বেহাল দশা আরও বাড়ছে। ইতোমধ্যে ঈদযাত্রা শুরু হয়ে গেছে। এক মাস আগে স্বাভাবিক সময়েই এই রাস্তায় পাঁচ ঘণ্টার পথ আট থেকে দশ ঘণ্টায় পাড়ি দিতে হচ্ছিলো, এখন ঈদ মৌসুম শুরু হয়ে গেছে, একপাশ থেকে কোরবানীর পশু বোঝাই ট্রাক ঢাকার উদ্দেশ্যে চলছে, অপর দিকে বাড়ি ফিরতি মানুষ বোঝাই বাসের ঢল! এ রাস্তায় আদৌ গাড়ির চাকা গড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে কিনা সন্দেহ!

৩. বন্যার পানির প্রবল চাপে কিংবা জলমগ্নতা থেকে বাঁচতে অনেক জায়গায় স্থানীয় সড়কগুলো ভেঙ্গে গেছে কিংবা কেটে দেয়া হয়েছে। ফলে স্থানীয় যোগাযোগ ব্যবস্থাও আশঙ্কাজনকভাবে ভেঙ্গে পড়ার জোগাড়।

৪. উত্তরের প্রায় সবগুলো নদীর গাইড বাঁধ ভেঙ্গে গেছে কিংবা ভাঙ্গনের মুখে। ফলে বর্ষা শেষ হয়ে গেলেও উজান থেকে যেকোনো সময় ঢল নেমে আসতে পারে, খুলে দেয়া হতে পারে নদীগুলোর ভারতীয় অংশে নির্মিত বাঁধ। হঠাৎ প্লাবণ বা ফ্লাশ ফ্লাড থেকে তীরবর্তী হতচকিত জনসাধারণকে বাঁচানোর উপায় কী?

৫. বানভাসী মানুষের বর্তমান সঙ্কট – তাঁরা আশ্রয় হারিয়ে অধিকাংশই আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা নিয়েছেন, তাঁদের পর্যাপ্ত খাদ্য নেই, বস্ত্র নেই। সরকার থেকে বলা হচ্ছে, পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী আছে, এবং তা বণ্টনও করা হচ্ছে। যদি তা সত্যিও ধরে নিই, তাহলে সেই ত্রাণ সময় মতো এবং সঠিক নিয়মে, সঠিক জায়গায় বণ্টন হচ্ছে না বিধায় তাঁদের কষ্ট লাঘবে কাজে লাগছে না। এটা গেল তাদের চলতি সঙ্কট। তারচেয়েও ভয়াবহ সঙ্কট তাদের জন্য অপেক্ষা করছে পানি নেমে যাওয়ার পর। জমিতে ফসল নেই, নতুন করে আবাদ শুরু করার পক্ষে মৌসুম অনুকূল নয়, আগাম ইরি চাষ করতে গেলেও বীজ, সার, কীটনাশক ইত্যাদির খরচ তাদের হাতে নেই। মূলত আমন ফসল ঘরে ওঠার পরই তাঁরা ইরি চাষ করেন, তাই ইরি চাষের খরচ আসে আমন থেকে। এবার আমন নেই, ইরির খরচও নেই। তার উপর আছে দাদন-ব্যবসায়ীদের চাপ। মহাজন, ব্যাংক কিংবা এনজিও – কেউই খুব একটা সহানুভূতির সাথে দেখবে বলে মনে হয় না, সবাই আমন চাষের জন্য নেয়া ঋণ বা তার কিস্তি আদায়ে তৎপর হবে, বলাই বাহুল্য। অর্থাৎ, যদি ধরেও নিই যে, আগাম ইরি চাষ করা সম্ভব হবে, তথাপি নতুন ফসল ঘরে উঠতে উঠতে শীত চলে আসবে, মানে প্রায় চার মাস। এই চারটা মাস এই বিপুল জনগোষ্ঠী সামলাবেন কীভাবে? খাবেন কী? চলবেন কীভাবে?

৬. যে শস্য কৃষি থেকে পাওয়া যাবে না, তার যোগান নিশ্চিত করতে হবে বিকল্প উপায়ে – আমদানী করে। এই বিপুল পরিমাণ খাদ্য আমদানী সৃষ্টি করবে বাজেট ঘাটতি। ফলে অন্য খাতে হাত পড়বে। সমন্বয় করতে হবে বাজেটের প্রায় সবগুলো খাতকে। দ্রব্যমূল্য এখনই আকাশচুম্বি, এরপর তা সাধারণের নাগালের পুরোপুরি বাইরে চলে যাবে। মূল্যস্ফিতি মোটেই আর নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে কি?

৭. উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের প্রায় সব স্কুলই এখন আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ফলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ। এমনকি উচ্চ-মাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রমও প্রায় স্থবির। এই যে বিপুল একটা ছেদ পড়লো স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমে, এর ফলাফল পড়বে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় এবং পরীক্ষার ফলাফলে। হয় ব্যাপক ফলাফল বিপর্যয় দেখা দেবে, কিংবা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে শিক্ষকেরা এতই উদারভাবে খাতা দেখতে বাধ্য হবেন যে, খাতায় নামটুকু লিখতে পেরেই অনেকে এ প্লাস গ্রেড পেয়ে বসে থাকবে। সামগ্রিকভাবে ছাপটা পড়বে দেশের গণশিক্ষার মানের উপর। এছাড়া শরণার্থী আশ্রয় নেয়ায় এবং বন্যা ও নদী ভাঙ্গনে অনেক স্কুল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এই স্কুলগুলোর সংস্কারও একটা বাড়তি খরচের খাত সৃষ্টি করবে।

৮. দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানী পণ্য চামড়া'র কাঁচামাল প্রায় নব্বই ভাগ সংগ্রহ করা হয় কোরবানী ঈদের মৌসুমে। বন্যার প্রকোপে এবার পশু কোরবানী'র পরিমাণ অর্ধেকেরও কমে নেমে আসবে, বলাই বাহুল্য। অর্থাৎ এই রপ্তানী আয় থেকেও অনেকটাই বঞ্চিত হতে যাচ্ছে আমাদের অর্থনীতি। অপরদিকে পাট ও পাটজাত পণ্যের উৎপাদন ও বাজারেও ধস নামতে বাধ্য।

কৃষিতে ভর্তুকি, খাদ্য আমদানী ব্যয়, বাণিজ্য ঘাটতি, সড়ক-সেতু ও অবকাঠামো নির্মাণ, গণপূর্ত নির্মাণ ও সংস্কার, শিক্ষা সংস্কার, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, বাড়তি ব্যয় সমন্বয় – সরকারের অগ্রাধিকারমূলক খাত এখন এই খাতগুলো। এগুলো নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র আদৌ ভাবছে কি? ষোড়শ সংশোধনী বিষয়ক বিতর্ক আর প্রধান বিচারপতি সংক্রান্ত টানাপোড়েন যে এই আসন্ন অগ্রাধিকার তালিকার কাছে একেবারেই পাত্তা পায় না, এটুকু বোঝার মতো কাণ্ডজ্ঞান আমাদের মন্ত্রী-এমপি ও বিরোধী রাজনীতিকদের থাকা উচিত, থাকা আবশ্যক। ন্যূনতম দেশপ্রেম আর বাস্তবিক বিবেচনাবোধ থাকলে তারা অন্তত অনুমান করতে পারতেন যে, কী ভয়ানক বিপদের মুখে আমরা দাঁড়িয়ে আছি – আর তা করতে পারলে প্রতিদিন এরকম প্রায় অপ্রয়োজনীয় প্রসঙ্গে গলাবাজি করার করার মতো গলার জোর আদৌ কেউ পেতেন বলে মনে হয় না।

ক্যালেন্ডারের পাতা ফুরোলেই ইলেকশনের বছর। যেকোনো কারণেই হোক, মনে হচ্ছে এবার সত্যিই নির্বাচন হবে। বাংলাদেশের মানুষ ভোট ব্যাপারটাকে উৎসব হিসেবে দেখে থাকে। বছরে দুটো ঈদ একটা পূজো, পাঁচ বছরে একটা নির্বাচন। সেই নির্বাচন থেকে তারা গেল বছর বঞ্চিত হয়েছে, আগামীবার সেই বঞ্চনা মেনে নেবে বলে মনে হয় না। একে তো ভোট দিয়ে যাকে নির্বাচিত করা হয়, সে মোটেই তাদের মনে রাখে না, এবার নিছক সেই ভোট দেয়াটুকুর অধিকারও যদি না থাকে, সেটা মেনে নেয়া কঠিন। অতএব, ভোট হবে।  অন্য কোনোপ্রকার রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, পররাষ্ট্র-নীতি বিষয়ক জটিল গবেষণায় না গিয়ে, কমন সেন্স থেকে বললাম, ভোট হবে। এবং সেই ভোটের ব্যালটে দলীয় কর্মীর সিল নয়, ভোটারের সিল দিয়েই সংসদে ফিরতে হবে।

একবার হলো কি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে মিরপুরের মাঠে ডে-নাইট ক্রিকেট ম্যাচ হচ্ছে বাংলাদেশের। ম্যাচের একদম শেষ পর্যায়, স্বাগতিকদের জেতার জন্য দুই রান লাগবে, অফুরন্ত উইকেট এবং ডেলিভারি হাতে আছে। সপাটে ব্যাট চালিয়ে দুই ফিল্ডারের মাঝ বরাবর বল হাঁকিয়ে দিয়েই দুই ব্যাটসম্যান জয় উদযাপনে ব্যস্ত, সাথে ড্রেসিং রুম থেকে মাঠে ঢুকে পড়া বাকি খেলোয়াড়, মায় গোটা স্টেডিয়াম। এদিকে প্রতিপক্ষের বেরসিক ফিল্ডার আবিস্কার করলেন, বলের পেছনে কেউ ছোটেনি ঠিকই, কিন্তু তাই বলে বলটাও তো সীমানা দড়ি টপকাতে পারেনি! গতি কম থাকায় বা শিশিরে ভেজা স্লো আউটফিল্ডে সে বল থেমে আছে। এদিকে ব্যাটসম্যানেরা তো রানও নেননি বাউন্ডারি হয়েছে ভেবে। কী আর করা যায়, বাধ্য হয়ে উপড়ে ফেলা উইকেট ফেরত দিয়ে আবার তাদের ব্যাটিংয়ে ফিরতে হলো, দরকারি রানদুটো কষ্টে-সৃষ্টে আদায় করে তবেই জয় উদযাপন।

সরকারে আসীনরা এভাবে একবার তো সুযোগ পেয়ে বৈতরণী পার হয়েছেন, বারবার কি সুযোগ পাবেন? পর্যাপ্ত ডেলিভারি হাতে আছে তো? বলের পেছনে কেউ ছুটছে না বটে, তবু অন্তত বলটাকে সীমানার বাইরে তো পাঠানোর ব্যবস্থা করুন! বানভাসী মানুষগুলোর জন্য সত্যিকার আন্তরিকতার সাথে কিছু করুন। আমাদের ভোটারদের স্মৃতিশক্তি খুবই দুর্বল। তারা দেড়-দু' বছরের স্মৃতিই মনে রাখতে পারে না, আরও পুরনো দুর্নীতি-লুটপাট তো ব্যাপারই না। মনে রাখবে তারা এই চার মাসের সেবাটুকুই। তাই একেবারে নিঃস্বার্থও হতে বলি না, নিজের স্বার্থেই অসহায় মানুষগুলোর জন্য কিছু করুন। আল্লাহ্'র দোহাই দিয়ে তো আর কাজ হচ্ছে না, বরং আপনাদের ভোটের দোহাই লাগে!