মোদীর মুখোশ ও নেপাল সংকট

গৌরব চাকমা
Published : 28 Sept 2015, 11:45 AM
Updated : 28 Sept 2015, 11:45 AM

অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষে, বিগত ৮ বছরের নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে, নেপাল তাদের নতুন সংবিধান প্রণয়ন করাতে পেরেছে। মাওবাদীরা ক্ষমতায় আসার পর এই সংবিধান প্রণয়ন তাদের আর একটি বিশাল বিজয় হিসেবে দেখা যেতে পারে। কেননা এর ফলে হিন্দু প্রধান নেপাল যাত্রা শুরু করছে একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে। নেপালের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাম্য প্রতিষ্ঠা কিংবা তাদের সকলের সমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে ধর্ম নিরপেক্ষতার বিকল্প ছিল না। অন্য দিকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যার সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি, সেই ইন্ডিয়ার মাথা ব্যাথা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই নতুন সংবিধান। নিজেদের দেশের আদলে রচিত, প্রতিবেশী দেশ নেপালের যে সংবিধান, উদারতা ও সহযোগিতার বাণী নিয়ে ইন্ডিয়াকে তুলে ধরছেন যে মোদী, সেই মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকার যখন নেপালের সার্বভৌমত্বকে পাশ কাটিয়ে সেই সংবিধান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তখন একটি ধর্ম নিরপেক্ষ দেশের নেতৃত্ব দেয়া মোদীর উদারতার বাণী যে নিতান্ত ফাঁপা বুলি তা সহজেই প্রতীয়মান হয়।

নেপাল এর সংবিধান প্রণয়ন এর মূল বাধা ছিল সকলের সমান প্রতিনিধিত্ব। এর সাথে নেপালের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীসমুহের ভৌগোলিক অবস্থান নিবিড় ভাবে জড়িত। এক দিকে পাহাড়ে বসবাসরত জনগোষ্ঠী সমূহ, অন্যদিকে সমতলের বাসিন্দা অন্য সকল জনগোষ্ঠী। নেপালের তরাই অঞ্চল, যা ইন্ডিয়ার সীমান্তে অবস্থিত, সেখানে বসবাসরত মাদেশি এবং থারু জনগোষ্ঠী যারা নেপালের জনসংখ্যার প্রায় ৪০%, এই সংবিধানের মূল বিরোধিতাকারী। বাকি সকল ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী যারা বাকি ৬০% জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্বকারী, যাদের অধিকারের জন্য মূলত মাওবাদীরা তাদের আন্দোলন শুরু করেছিল। তরাই অঞ্চলে বসবাসকারী হিসেবে ৫টি জনগোষ্ঠীকে ধরা হয় যারা ইন্ডিয়ার সীমান্তবর্তী কয়েকটি প্রদেশের জনগোষ্ঠীসমূহের সাথে জাতিগত ভাবে সম্পর্কযুক্ত, বিশেষ করে বিহার। আবার নেপালের মোট জনগোষ্ঠী যখন ১২৫টি, তখন সমান প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে জনসংখ্যার অনুপাত বনাম জাতিগোষ্ঠীর অনুপাত প্রধান সমস্যা হিসেবে প্রকট হয়ে ছিল।

মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে বেছে নেন নেপালকে। ২০১৪ সালে আগস্টে মোদী নেপাল সফর সবাইকে অবাক করে। কিন্তু নভেম্বরে সার্ক সম্মেলনে মোদী নেপালে যান ভিন্ন সুর নিয়ে। তার আর মাদেশিদের এক কণ্ঠ, নেপালের প্রস্তাবিত সংবিধানের প্রতি ইন্ডিয়ার দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিষ্কার করে তুলে।

ইন্ডিয়া যে সকল নীতি নিয়ে নিজে পরিচালিত হচ্ছে, নেপাল এর নতুন সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে সেখানে তাদের ভিন্ন মত থাকা অস্বাভাবিক। নেপালের সংবিধান প্রণয়নের অন্তিম মুহূর্তে সেখানে ঝটিকা সফর করেন ইন্ডিয়ার ফরেন সেক্রেটারি জয় শঙ্কর। তার এই সফরকে নেপালের অন্যতম বুদ্ধিজীবী অমিত ধাকাল তুলনা করেন হুমকি হিসেবে। এই সফরে জয় শঙ্কর এর ভুমিকা ফরেন সেক্রেটারি হিসেবে নয়, বরং মোদীর দূত হিসেবে তুলে ধরেন তিনি। ল্যান্ড-লক দেশ হিসেবে নেপাল সম্পূর্ণ ভাবে ইন্ডিয়ার ওপর নির্ভরশীল। তরাই অঞ্চলকে ইন্ডিয়া এখন উদ্দেশ্য সাধনের উপায় হিসেবে দেখছে। তরাই অঞ্চলে যে ১,৭৫১ কি.মি. উম্মুক্ত সীমান্ত রয়েছে তা নেপালের অর্থনীতির প্রাণ বলা যেতে পারে। সুতরাং, এই সীমান্ত বন্ধ হয়ে গেলে নেপাল যে খুব শীঘ্রই বিপদে পড়তে যাচ্ছে তা বলা যায়।

ইন্ডিয়া এই সংবিধান এর বিরোধীটার মূল কারণ দেখাচ্ছে সীমান্তে সংঘাত এর আশংখা। এই সংবিধান এর বিরোধিতা করে মাদেশি জনগোষ্ঠী সংঘাত সৃষ্টি করবে যা ইন্ডিয়ার সীমান্তে মাথা ব্যাথার কারণ হবে বলে জানানো হচ্ছে। কিন্তু তরাই অঞ্চলের ১১৬ জন প্রতিনিধি এর মাঝে ১০৫ জন এই সংবিধানের পক্ষে ভোট দিয়েছে। ফলে ইন্ডিয়ার এই যুক্তি হাস্যকর বলে প্রতীয়মান হয়।

অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক একে দেখছেন মোদীর অভ্যন্তরীণ রাজনীতির খেল হিসেবে। নেপাল আগামি দুই বছর এই সংবিধান নিয়ে আলোচনার দরজা খুলে রেখেছে যেন এর ত্রুটি সংশোধন করা যায়। সমতলের জনগোষ্ঠী সমূহের জন্য আলাদা বিধান রাখা হয়েছে তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে। সুতরাং, মোদী সরকারের বিরোধিতা একে শুধুই বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির খেলা হিসেবে দেখা যায়। এক মাত্র হিন্দু রাষ্ট্রটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হয়ে গেলে প্রতিবেশী ধর্ম নিরপেক্ষ ইন্ডিয়ার মাথা ব্যাথার কারণ না হলেও সাম্প্রদায়িক বিজেপির রক্তক্ষরণের কারণ অবশ্যই। অন্যদিকে এগিয়ে আসছে বিহারের নির্বাচন। মাদেশি জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কযুক্ত বিহারের জনগণ এর ভোট নিজের পাতে তুলে নিতে মোদীর বিরোধীটার মর্ম খুজে পাওয়া যায়। কিন্তু সহযোগিতার বুলি আওড়ানো মোদী, যিনি একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী, তাকে এই ভূমিকাতে দেখা খুব অবাক করার মত বিষয় নয়। এক দিকে মোদী আন্তর্জাতিক ভাবে নিজেকে প্রচার করছেন ইন্ডিয়ার নতুন ত্রাতা হিসেবে, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর বন্ধু হিসেবে, অন্যদিকে নিজের দেশে বিজেপির আস্ফালন আর মুসলমানদের অধিকার খর্ব করার নীতি নিয়ে তিনি নিসচুপ। বলা যায় আমেরিকার নীতিকেই তিনি টেনে নিয়েছেন। সারা দুনিয়ার গণতন্ত্রের আমদানিকারক হিসেবে আর্তনাদ করা আমেরিকা নিজেই গণতান্ত্রিক দেশ না। সেই একি নীতিতে ইন্ডিয়ার ধর্ম নিরপেক্ষতা নিজের মুখোশ হিসেবে টেনে নিয়ে মোদী ছাড় দিয়ে চলেছেন নিজের দলের সাম্প্রদায়িকতাকে। নেপালের নতুন সংবিধান এই মুখোশে একটি জোর টান মেরেছে বলা যায়। দুই নৌকায় পা দিয়ে চলার এই নীতি হোঁচট খেতে বাধ্য, কারণ নতুন যে রূপেই মোদী আবির্ভূত হন না কেন, যে বিশাল মহিরুপেই তিনি বর্তমানে নিজেকে মেলে ধরুন না কেন, বীজটার ব্র্যান্ড যে ছিল সাম্প্রদায়িকতা।