আমি তখন ঝিনেদা শহরে একটা এনজিওর চাকুরে। থাকতাম অফিস মেসে আরও দুজন কলিগের সাথে। আমরা প্রতিদিনই খেতে যেতাম অনেকটা হেঁটে, হয় নতুন বাস স্টান্ডে, নাহয় পুরাতন ডিসি অফিসের কাছে একটা হোটেলে। তবে বেশিই যেতাম ডিসি অফিসের কাছের হোটেলটিতে মালিকের নামটা ভুলে গেছি এখন। ধোপাঘাটা ব্রিজের কাছে অফিসে ফিরতে মিনিট পনেরো'র মতো সময় লাগে। এই হোটেলের মালিক লোকটি সব সময়ই দেশীয় মাছ-সব্জি আর দেশীয় রান্নায় ক্রেতাদের খাওয়াতেন।
একদিন দুপুরবেলা, ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসের কোনো একদিন হবে। আমি একাই খেতে গিয়েছিলাম। খাওয়া শেষ, ঘরে ফিরব। হোটেল থেকে বের হতে গিয়ে দেখি প্রচন্ড রোদ্দুরে চারদিক খা খা করছে। একান্তই অপরিহার্য প্রয়োজন ব্যতীত লোকজন খুব একটা বাইরে বেরোয় না, এ রকম রোদ্দুরে। তাপে রাস্তার পিচ গলে পথচারীর জুতোর তলায় লেগে হাঁটার সময়ে চট চট শব্দ হচ্ছে। অফিসে না ফিরে কাছেই ডিসি অফিসের সামনে, গাছ তলায় গেলাম একটু খোলা বাতাসের আশায়। ঠান্ডা হাওয়ায় একটু জিরোবে ভেবে গিয়ে যা পেলাম তাতে কলজেটা এতটাই তৃষ্ণার্ত হয়ে গেল! যে তৃষ্ণা বোধ করি এই জনমে আর মিটবে না।
আমার মায়ের বয়সী, ষাটোর্ধ, পুরু কাঁচের চশমা পড়া মলিন পোশাকের এক মহিলা। বাঁকা লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে হেঁটে এসে একটা দুই কিংবা আড়াই মাস বয়সী লাল বাছুরকে আমি যে গাছটির তলায় দাঁড়িয়েছিলাম, সেটার পাশের গাছটিতে বেঁধে এদিক ওদিক উদ্ভ্রান্তের মতো করে কী যেন খুঁজে চলছেন। আর অস্পষ্ট শব্দে বলছেন, "হায় আমার বুড়ি, আহারে বুড়ি, ওরে বুড়ি, তুই আমারে রেখি কই গেলি"? ভদ্র মহিলা একা একা কথা বলছেন, এ দেয়াল-সে দেয়াল, আড়াল আবডাল যদ্দুর পারছেন তার বুড়িকে খুঁজছেন আর চশমা তুলে বার বার চোঁখ মুছছেন। একটু খুঁজেই বার বার তিনি বাছুরটির কাছে ছুটে আসছেন, গায়ে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, বাছুরটিও তাঁর গা চেঁটে দিচ্ছে। আবার মহিলা একটু চোঁখের আড়াল হতেই বাছুরটি অস্ফুট শব্দে এম্মা-আ-আ এম্মা-আ-আ বলে ডাকছে। আমি মহিলার প্রতি বাছুরটির ভালোবাসা আর বাছুরটির প্রতি মহিলার মমতা দেখে আপ্লুত হয়ে না হয়ে পারলাম না। নিজের অজান্তেই চোঁখে জল চলে এলো। আমি মহিলার কাছে গেলাম, গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "খালা, কি হয়েছে আপনার? কাঁদছেন কেন? খুঁজছেন কাকে"?
আমার প্রশ্ন শেষ না হতেই তিনি চৌগুণ শব্দে, হাউ মাউ করে কেঁদে যা বললেন! কি যে চাপা কষ্টে তাঁর বুকের ভেতরটা উথাল-পাথাল হচ্ছিল, না দেখলে তা ভাষায় প্রকাশ করে কারোর অনুভুতিতে পৌঁছানো আমার পক্ষে সম্ভব না। মাতৃস্নেহ কত গভীর হতে পারে তা বোধ করি সেদিনটির আগে কোনো দিন আমি বুঝিনি। বোঝার চেষ্টাও আমার করা হয়নি। কারণ কোনো জিনিসের শুন্যতা কারো কাছে তৈরী না হলে তার অপরিহার্যতা কেউ কোনদিনই বুঝতে পারেনা। আমিও অবারিত মাতৃস্নেহ উপভোগ করতাম বলেই হয়তো এর গভীরতা সম্পর্কে সেদিনের আগে কোনদিন সেভাবে ভাবিনি। দিনটি আমার কাছে জীবনকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। আমি নিজেকে, নিজের জীবনকে নতুন করে গড়তে চেষ্টা করেছি। দিনটি আমার কাছে চরম ব্যথাতুর দিনগুলোর একটা। দিনটি আমাকে এখনও সমান দহিত করেছে। আজও যখন মহিলার করুন কান্না আর আর্তনাদ চোঁখের সামনে ভেসে ওঠে আমি বোবা কান্নায় সিক্ত হই।
এবারে পরের অংশে আসি। মহিলা দুই কন্যা সন্তানের জন্মদাত্রী। কোনো পুত্র সন্তান না থাকার কারণে গ্রামে যেটুকু জমি জিরেত ছিলো, নিঃশেষ করে মেয়েদের বিয়ে সাদী শেষ করেছেন পূর্বেই। তারা সবাই নিজ নিজ সংসারে কষ্টে ক্লেশে দিন যাপন করছে। তারা তাদের মতো করেই চলছে। মেয়ে-জামাইরা খোঁজ রাখেন না। নিজের কাঠ মিস্ত্রী স্বামী আর আগের মতো শক্তি দিয়ে কাজও করতে পারেন না। কারো গলগ্রহ না হয়ে, জমি বিক্রির অবশিষ্ট টাকা আর স্বামীর রোজগারের উদ্বৃত্ত থেকে বছর তিনেক আগে, এই বাছুরটি মা গরুটাকে আর একটি বাছুরসহ কিনেছিলেন তেইশ হাজার টাকা খরচা করে। দশ-বারো কেজির মতো দুধ দিত গরুটা, তা বেচেই দিন চালাতেন এই বুড়ি আর তাঁর স্বামী। দুধ বিক্রি করতে সুবিধে আর গরুকে যত্ন আত্তি ওষুধ পত্তর করতেই দুটো চালা দিয়ে একটা ঘর বেঁধেছিলেন ভরাট হয়ে যাওয়া খাল ধারে, সরকারি জমিতে। একপাশে গরু দুটো থাকত, অন্যপাশে নিজেরা। স্রোতহীন খালের বুকে জেগে ওঠা চরে উদয়াস্ত গরুকে ঘাস খাওয়াতেন দুধ বেশি পাবার আশায়। সকাল বিকাল দু বেলায়ই দুধ দিত গরুটি। দুমাস আগে আগের বাছুরটি বেচতে হয়েছে। বেচতে হয়েছে, স্বামীর চিকিত্সার জন্য হয়ে যাওয়া বেশ কিছু হাওলাত শোধ দেবার জন্য। হাওলাত শোধ দেওয়া হয়েছে ঠিকই, তবে স্বামীকে আর বাঁচানো যায়নি, তিনি গত হয়েছেন ঊনিশ দিন হলো।
গত পরশুদিন বিকেলে দুধ দুইয়ে, গরুটি ঘরের কাছেই বেঁধে রেখে নিজে গেছেন বাজারে দুধ বিক্কিরি করতে। দুধ বেচতে দেরী হওয়াতে ঘরে ফিরে আসতে খানিকটা রাত হয়েছে। ফিরে এসে দেখেন নিজে যেখানে গরুটি বেঁধে রেখে গিয়েছিলেন, সেখানে আর গরুটি নেই। বাছুরটি শুধু এম্মা-আ-আ এম্মা-আ-আ বলেই চিতকার করছে আর লেজ উচিয়ে মহিলা যেদিক যেদিক যাচ্ছে, সেদিক সেদিক তাঁর পিছন পিছন দৌড়াচ্ছে। গত দুদিন হয়ে গেলেও গরুটির কোনো খোঁজ পাননি। এদিকে বাছুরটি এখনও পুরোপুরি ঘাস ধরেনি। গত দুদিন শুধু নরম করে, দুধের মতো করে ভাত রেঁধে বার দুই জোড় করে গিলিয়ে দিয়েছে। মাতৃশোকে লাল ফুটফুটে বাছুরটির চোঁখ দিয়েও থেকে থেকে জল ঝরছে। ডাকতে ডাকতে স্বর ধরিয়ে ফেলেছে। মহিলা কাঁদছেন আর বিলাপ করছেন; "বুড়িরে নাম ধইরা ডাকলেই হেয় যেহানে থাইকতো ছুইটা আইত, আইজ দুইদিন ধইরা ডাকতাছি, বুড়ি আর আসেনা। টিপাই কইছে তোমার বুড়ি আর আইবো না। হেয় "হজম" হই গিছে। আমি এহন এই লালুরে কেমনে বাচামু? ও খোদা তুমি আমার সব কাইরা নিলা? আমি কী এত গুনা করছি তোমার দরবারে? আমারে বুড়িরে ফেরত দেও, খোদা। আমি কেমনে বাচমু, আমার পুঁজি শ্যাস। আমার আর পুঁজি নাই।"
আমি সান্তনার ভাষা হারিয়ে ফেলি। তাঁর কান্নার আগুনে জল দিতে চেষ্টা করে খালা থেকে "আম্মু" আর আপনি থেকে "তুমি" তে চলে গিয়ে বলেছিলাম," আম্মা, দেইখো তোমার বুড়ি ঠিক-ই আইবো।"
আম্মা আমার চটুল সান্তনা বুঝে গিয়ে বলেছিলেন, "আমিও তো তাই ঘুইরা ঘুইরা খুজতাছি আর খুজতাছি, আল্লাহ, তুমি বড় মেহেরবান, আমার গুনা মাফ কইরা দেও। আমার গুনা মাফ কইরা দেওগো আল্লাহ, আমার বুড়িরে আমার কাছে ফিরাই দেও। লোকটা মইরা গেল ঊনিশ দিন, হেয় থাকলে আর এমন হইত না। আমার আর দুধ বেচতে যাওন লাগত না। আমার বুড়িও আমার কাছে থাকত"।
বলার প্রয়োজন নেই, "বুড়ি" ছিল মহিলার রিজিকদাতা গাই, আর বাছুরটি "লালু"। আর আগের বাছুরটি, যেটি বিক্কিরি করে দেনা শোধ করেছেন, সেটি ছিল "জলী"। পালিতের প্রতি পালকের আর পালকের প্রতি পালিতের এই মমতা আমি জীবনে আর দেখিনি, শুনিও নি। এ এক অমোঘ ভালবাসার রূপ, যা সন্তানের প্রতি মায়ের ভালবাসার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। বিষয়টি আমি যতবার ভাবি, ততবারই চোখ জলের নিয়ন্ত্রণ হারাই।
মূষরে পরা আম্মার সে বিলাপ দেখার মতো না, সে কান্না প্রকাশ করার মতো না। সন্তানের জন্য আম্মা বোধ করি কোনদিন এতটা করে কোনদিন কেঁদেছেন কিনা আমি জানিনা! কারণ গরুটা এই পরিবারটিকে যেভাবে আগলে রেখেছিল, সন্তানেরা তা কোনদিনই হয়তো করেন নি। আম্মা হৃদয়ের সকল মমতা দিয়ে যক্ষের ধনের মতো গরুটা আর তার বাছুর দুটিকে ভালবাসতেন, যা প্রকৃত অর্থে তেমনটিই ছিল, সন্তানের প্রতি আবহমান বাংলার মায়েদের চিরন্তন ব্যাকুলতা ভরা, "মায়ের মমতা"। বাংলার মায়েরদের সন্তানদের প্রতি ভালবাসার এই বিশালতার কথা মনে হলে পরম সুখে বুকটা ভরে ওঠে।