বর্ষবরণ কাণ্ডে মুখরতা আর রুবেল সম্পর্কে হ্যাপীর মামলায় নমনীয়তা- দ্বিচারিতা নয় কি?

গৌতম হালদার
Published : 20 April 2015, 04:52 PM
Updated : 20 April 2015, 04:52 PM

'ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দূর্বলতা,

হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা –

তোমার আদেশে। …………..'
শুরুতেই বলে নেই পহেলা বৈশাখের উত্সব সার্বজনীন উত্সব। এ উত্সব জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রাণ খুলে আনন্দ মুখর পরিবেশে উদযাপনের দিন। এদিনে যাবতীয় অন্ধকার, কূপমণ্ডূকতা আর পৈশাচিকতার অবসান ঘটিয়ে সার্বজনীন মঙ্গলের জন্য একত্রিত হবার দিন। এদিন বর্বরতা নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদেরও দিন। 
এবারের বর্ষবরণে যে পৈশাচিকতা আর বর্বরতার ঘটনা জাতির শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ আঙ্গিনায় সংগঠিত হয়েছে, তার নিন্দা জানাই। ঘৃণা জানাই এই নারকীয় আর নির্লজ্জতার সংগঠক পশুদের। আমি চাই এই নির্মমতা আর বীভৎসতার জন্য দায়ী প্রত্যেকটি ব্যক্তি বিচারের মুখোমুখি হোক। তারা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাক। শাস্তি পাক সকলে, যাদের উদাসীনতা, নির্লিপ্ততা, নিস্ক্রিয়তায় এই জঘন্য ঘটনা ঘটেছে, আর যারা নেপথ্যে থেকে শক্তি সঞ্চালনা করেছে, তারাও।
বর্তমান সমাজে নিগ্রহ, তা সে নারী নিগ্রহ অথবা পুরুষ নিগ্রহ, যা-ই হোক না কেন, এক ভয়ানক ব্যাধি সরূপ। এ ব্যাধি দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। এর পিছনে হাজার কারণের মধ্যে দিনে দিনে মানুষের নৈতিকতাবোধের চরম অবক্ষয়ই মূলত দায়ী। ভোগবাদী সমাজে আজ মানুষের সামনে এমন কোনো আদর্শ সামাজিকভাবে কিম্বা রাষ্ট্রীয়ভাবে নেই যা দেখে সবাই ত্যাগের আদর্শে উজ্জীবিত হতে পারে। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষ আজ অবতীর্ণ অনৈতিক আর ঘৃণ্য কাজের প্রতিযোগিতায়। তবে এই প্রতিযোগিতা যদি এখনই বন্ধ করা না যায়, শুধু আমাদের জাতীয় জীবনই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, বিপন্ন হবে জীবনের মূল শিকড় পারিবারিক বন্ধনও। 
মানুষের ব্যক্তিগত নৈতিক অবস্থান অনেকটাই নির্ভর করে রাষ্ট্রীয় নীতি নৈতিকতার উপর। রাষ্ট্র যদি কোনো ক্ষেত্রে কোনো অনৈতিক কর্মকান্ডকে উপেক্ষা করে, প্রশ্রয় দেয়, তবে তা রাষ্ট্রের অধিবাসীদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। অর্থাৎ নাগরিকদের ব্যক্তিগত নীতি নৈতিকতা অনেকটাই প্রভাবিত হয় রাষ্ট্রের নীতি-আদর্শ দ্বারা- এ কথা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই।   
এখন আসা যাক আজকের বিষয়ে। তার আগে বলে নেই, এই বঙ্গদেশে, জীবনের আদর্শ হিসেবে ধর্মগুরুদের ভুমিকা কোনভাবেই খাটো করার সুযোগ নেই। কারণ  আমাদের দেশের মানুষ খুবই ধর্মভীরু। এটাই এদেশে চরম সত্য, হুজুর যা বলেছেন তা করতে গিয়ে জীবন উতস্বর্গ করতেও মানুষ দ্বিধা করেন না। তবে যেই দেশের ধর্মগুরু নারীকে তেঁতুলের সাথে তুলনা করে, সেখানে নারী দেখা মাত্রই পুরুষের জিহ্বে জল আসবে সেটাও স্বাভাবিক। আর নারীরা সেই সমাজের অন্দরে বাইরে প্রতিনিয়ত নিগৃহীত, নির্যাতিত, অত্যাচারিত আর তেঁতুলের মতো উপাদেয় হয়ে আবালবৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলের কাছে ভোগ্যবস্তু হিসেবে বিবেচিত হয়ে ধর্ষিত হবেন, অনুসারীরা ভাবতেই পারেন। কারণ ধর্মগুরুদের এই মানসিকতাই অনুসারীদের মধ্যে দ্রুত সঞ্চারিত হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এই অবস্থা বন্ধ করতে হলে প্রথমেই যা দরকার, তা হলো ঐসব বিকৃতমস্তিস্ক, ধর্মগুরুদের চিকিতসা করানো; অতপর অন্যকিছু। 
বর্তমান সময়ে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব না সমাজের সকল অনিয়ম, সকল দুর্নীতি আর সকল অনাচারের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা, সব অভিযোগের একশ শতাংশ বিচার নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে যা করতে হয়- তা হলো সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগের সুষ্ঠু বিচারের ব্যবস্থা করে সমাজের বুকে দৃষ্টান্ত স্থাপণ করা। তবে রাষ্ট্র যদি এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়, উদাসীনতা দেখায়  কিম্বা দোষীকে আড়াল করার চেষ্টা করে তবে সেই দুর্নীতি, অপরাধ আর অনাচার দ্রুত ছড়িয়ে পরে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।  রুবেল সম্পর্কে হ্যাপী'র অভিযোগ রাষ্ট্র সঠিকভাবে মূল্যায়ন তো করেইনি। পরন্তু  এমন জঘন্য অপরাধের পরও অপরাধীকে করা হয়েছে পুরস্কৃত, হয়েছে প্রশংসিত। এ দৃষ্টান্ত সমাজের বুকে এক নির্লজ্জ উদাহরণ। আমরা কেউই ভেবে দেখিনি বেচারি হ্যাপী'র অবস্থান থেকে বাস্তব চিত্রটা।  বিষয়টাকে নির্লজ্জ স্বার্থপরতার আবরণে ঢেকে এড়িয়ে গিয়েছি। এই এক চরম ব্যর্থতা, যা রাষ্ট্র হিসেবে নারী জাতির কাছে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক স্বার্থপর মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। আমি এর নিন্দা আগেও জানিয়েছি, এখনও জানাই। আর নারী নির্যাতনের অভিযোগগুলোর যথাযথ বিচার হলে, রুবেল-হ্যাপী'র বিষয়টিও অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো বিচারের মাধ্যমে যথাযথ নিস্পত্তি হলে, হীনস্বার্থের কারণে অভিযুক্তকে অনুকম্পা না দেখালে, পহেলা বৈশাখের ঘটনা ঘটাতে নেপথ্যের পশুগুলো হয়তো কিছুটা  হলেও নিবৃত হতো । 
পহেলা বৈশাখের ঘটনায় আজ দেশ তোলপাড়। ঘটনার ভয়াবহতাও ব্যাপক, তাই সবাই সরব তীব্র প্রতিবাদে। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলেই ঘৃণাভরে সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানাচ্ছে  এহেন জঘন্য আর পৈশাচিক অপরাধের।  কোনো ভাবেই মেনে নেওয়া যায়না এত বড় পাশবিক অপরাধ! তাই সবাই কলমে, কলামে, রাজপথে গলিপথে, চা দোকানে, সবখানে সরব। আজকের এই প্রতিবাদ আমি দেখিনি হ্যাপি-রুবেল ইস্যুতে। যদি সেদিন সারাদেশ থেকে এমন সরব আর স্ফূর্ত প্রতিবাদ সবাই জানাতো, আমার বিশ্বাস পহেলা বৈশাখে এমন নিন্দনীয় ঘটনা হয়তো নাও ঘটতে পারত। কিন্তু আমরা তখন জোড়ালো প্রতিবাদ করিনি, যা আজ অন্য অপরাধীদের সাহস যুগিয়েছে। এ আমাদের দ্বিচারিতারই বহিপ্রকাশ। এই দ্বিচারিতা কোনো ক্রমেই কাম্য নয়। আমরা একবারও ভাবিনি কোন পরিস্থিতিতে একজন মেয়ে নিজেকে ধর্ষণের শিকার বলে স্বীকার করতে বাধ্য হয়। আমরা ভাবতে চেষ্টাও করিনি। এ ব্যর্থতা আমাদের, আর এ ব্যর্থতার কারণেই আমরা রাষ্ট্রকে সুষ্ঠু বিচারে বাধ্য করতে পারিনি। আজ তারই ফলশ্রুতিতে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রকাশ্যে দিবালোকে নারীর প্রতি এমন বর্বর নির্লজ্জতা প্রদর্শনেও মানুষরূপী হায়েনাগুলো তাদের আগ্রাসী মনোভাব প্রকাশে কুন্ঠাবোধ করেনি, বলাটা খুব বেশি নির্বুদ্ধিতা হবে না।ওদেরকে থামাতে হলে নিকট-দূর নির্বিশেষে দ্বিচারিতা নয়, উদাসীনতা নয় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। শাস্তির দাবিতে আওয়াজ তুলতে হবে।  
পরিশেষে কবিগুরুর দুটি লাইন দিয়ে শেষ করব, তা হলো;
'অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, 
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণ সম দহে।'