“দাঁতের মাজন বিক্রেতার দাঁত যদি হয় তরমুজের বীজের মতো কুঁচকুঁচে কালো, তবে তার দাঁতের মাজন লোকে খায় না” এটা গ্রাম বাংলার লোকমুখে বহুল উচ্চারিত উপমা। এখানে ‘খায়না’ শব্দটি মূলত ‘কিনে না’ শব্দটাকে তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত হয়েছে প্রতিশব্দ হিসেবে। মূল কথাটি হলো সেই মাজন বিক্রেতার মাজন লোকে কিনে না।
গ্রামের লোকজন রাজনীতি কম বুঝে, বাস্তবতা ভালো বুঝে এটা নিখাদ সত্য। হয়তো এজন্যই গ্রামে এখনও মানুষে মানুষে নিবিড় আন্তরিকতা। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একে অপরের প্রতি অধিক সহনশীল, শ্রদ্ধাশীল আর সহযোগিতাপ্রবণ। আমরা শহরবাসী সবাই বাস্তবতা কম বুঝি, রাজনীতি ভালো বুঝি, স্বার্থপরতা বেশি বুঝি। আমরা দাঁতের মাজন কিংবা চিকার ওষুধ বিক্রেতা ফেরিওয়ালা দেখলেই হুমড়ি খেয়ে তাদের মাজন আর ওষুধ কিনে নেই। “সস্তায় কত্তোখানি মাজন পাইলাম!” বলে নিজেকে নিজে বাহবা দেই। একবার চেয়েও দেখিনা মাজন বিক্রেতার দাঁতগুলো কত কুত্সিত কিংবা ওষুধ বিক্রেতার পায়ের নখে চিকা আছে কিনা? মনে মনে জিতে গেলেও আখেরে যে হেরে গেছি সেটা যখন বুঝতে পারি তখন আর আফসোস ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কোলকাতা মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচন দেখার সুযোগ আমার হয়েছে; কারণ নির্বাচনের দিন আমি সেখানে ছিলাম। ভারত, যারা বিশ্বের বৃহত গণতান্ত্রিক দেশ বলে দাবি করে, তাদের নির্বাচন দেখার ঔতসুক্য আমার আগে থেকেই ছিল, তাই এইবার এই সুযোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করিনি আর। তবে নির্বাচনের দিনে যা দেখলাম তাতে ভারতের নির্বাচন সম্পর্কে আমার মনমধ্যে অঙ্কিত ধারণা যে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কোলকাতায় এবারের নির্বাচনের নামে যা হয়েছে তাকে নির্বাচন না বলে “নির্বাচনের প্রহসন” বলাই শোভনীয়। অধিকাংশ এলাকাতেই “এলাকার ক্ষমতাসীন” গোষ্ঠির অনুগত ভোটার ছাড়া “ভিন্নমতের” কিংবা “সন্দেহজনক ভিন্নমতের” কেউকে ভোট প্রদান তো দূরের কথা এমনকী বাজার করতেও যেতে দেয়া হইনি। সকাল বেলা পড়ার “পার্টি অফিস” থেকে “টুল” আর ” মালের বোতল” নিয়ে প্রতিটি রাস্তার মোড়ে মোড়ে কর্মী বাহিনী হাজির। সঙ্গে সাউন্ড বক্স। যারা যারা “সন্দেহভাজন ভিন্নমতের”, তাদেরকে ডেকে ডেকে ” ও দাদা, ভোট দিতে যেতে হবেনা কষ্ট করে, ও আমরাই ম্যানেজ করে নোবো, আজ আপনার ছুটি। বাড়িতে থাকুন, ছুটি কাটান। না হয় আমাদের সঙ্গে আসুন, মস্তি করুন। ভোট দিতে কিন্তু যাবেন না মাইরী, আগেই বলে রাখলুম”। অবস্থা এমন, ভিন্নমতের লোকজন নির্বাচনের দিন যে ঘর থেকে যে বের হবেন, তাও পারবেন না।
দেশে এখন ‘নির্বাচন উত্সব’ বিরাজমান। রাত পোহালেই ঢাকা ও চিটাগং-এর তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। কী চা দোকান, কী বাসস্ট্যান্ড- সবখানে এখন নির্বাচন নির্বাচন বাতচিত। পোস্টারে পোস্টারে ছয়লাব শহর। সর্বত্র মাইক-সাউন্ডবক্স, কোথাও আবার প্রজেক্টরে টেলিফিল্ম দেখিয়ে চলছে প্রার্থীদের গুণকীর্তন। কেউ বলছে অমুক ভাই বিজয়ী হলে অমুক করবেন তো আর একজন বলছে তমুক ভাইকে ভোট দিলে তমুক করবেন। প্রার্থীরাও বসে নেই। কেউ “পিছা” নিয়ে লেগে গেছেন রাস্থা ঝাড় দিতে! তো আর একজন কমলা প্রতীক পেয়েছেন বলে বাজারের সব কমলা কিনে নিচ্ছেন ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কমলা দিয়ে ভোট চাইতে। এতে বাজারে কোথাও কোথাও কমলার যোগানে ঘাটতি হওয়ায় কমলার দাম খানিকটা বেড়েছে বটে, তবে নির্বাচনী কান্ডে যে বৈশাখী কমলার সুমিষ্ট রসের সঞ্চার হয়েছে, তাতে সন্দেহের উদ্রেক করার কোনও কারণ নেই। সব মিলিয়ে সবার এখন এন্তার ব্যস্ততা। কারও এক মুহূর্ত নষ্ট করার জো নেই।
কাগজে দেখলাম ইইউ ঢাকা আর চিটাগং-এর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে “অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়”। ইইউ আমাদের দেশের নির্বাচন নিয়ে বহুত আগ্রহ দেখায়, তা হোক জাতীয় নির্বাচন কী? অন্য কিছু! আর এই নামটা কানে গেলেই আমার কেন জানি পিত্তি জ্বলে। পিত্তি জ্বালার কারণ বাংলাদেশ বিষয়ে তাদের অযাচিত প্যাচালের কারণে। কোনদিন শুনি নি, ইইউ কোলকাতা মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচন কিংবা ভারতের কোনো নির্বাচন নিয়ে কোনদিন কোনো কথা বলেছে। ইইউ’র ভারতের নির্বাচন নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। ভারতের নির্বাচন নিয়ে ইইউ কিংবা পাশ্চাত্য দেশগুলোর কোনো হামদর্দী ভাব দেখানোর সুযোগও নেই। আর ভারতবাসিও তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তৃতীয় পক্ষের হামদর্দী মনোভাব বা নাক গলানো মেনে নেবে না। পৃথিবীতে বোধহয় আমরা বাংলাদেশীরাই একমাত্র জাতি যারা ঘরের ঝগড়া থামাতে রাস্তার লোক ডাকি। এটাও নিসন্দেহে আমাদের নির্লজ্জতা, আমাদের দেউলিয়াপনা মনোভাব। আমরা এই বিষয়টা বারবারই ভুলে যাই বাংলাদেশ এখন কলোনিভুক্ত কোনো দেশ নয়। বহু ত্যাগ আর প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন আর সার্বভৌম দেশ, নিজস্ব আইন ও নীতি রয়েছে প্রয়োজনীয় সকল ক্ষেত্রে। এখানে নির্বাচন কিভাবে অনুষ্ঠিত হবে, কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে, কিভাবে নির্বাচন পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালিত হবে?
কাগজে আরও দেখলাম যুক্তরাজ্যস্থ টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র নির্বাচনে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বিএনপি’র আদর্শপুষ্ট মেয়র “লুত্ফর রহমান”-এর অনৈতিক অবলম্বনের মাধ্যমে নির্বাচনে জয় লাভ করা এবং এ নির্বাচন নিয়ে বিরোধী প্রার্থী “মি. এরলাম”-এর অভিযোগ প্রসঙ্গে। নির্বাচনে মি. এরলাম যে অভিযোগ করেছেন তা হলো, “পুলিশ এবং নির্বাচন কমিশন ‘অপদার্থ’। তারা লুৎফুরকে বিচারের মুখোমুখি করতে ‘কিছুই করেনি’।”
তার আরও অভিযোগ “আমাদের মনে হয়েছে, টাওয়ার হ্যামলেটসের পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ভেঙে পড়েছে। রায়েও আমরা সঠিক প্রমাণিত হয়েছি। বিচারক পরিষ্কারভাবে বলেছেন, এই বরোতে পুরো প্রক্রিয়া ভেঙে পড়েছে।এখন আমরা কমিশনারের কাছে দাবি জানাব, যাতে গত মের নির্বাচনে সংঘটিত ভোট জালিয়াতির ঘটনার সম্পূর্ণরূপে নতুন তদন্ত করা হয়।”
অভিযোগ দুটি লক্ষ্য করলেই সহজেই অনুমেয় টাওয়ার হ্যামলেটসের পুলিশ ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাবের চূড়ান্ত ফলশ্রুতিই হলো “লুত্ফর রহমান”-এর বিজয়, যা আদালতের রায়েও স্পষ্ট।
প্রশ্ন জাগে বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়ে, নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিরপেক্ষতা আর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আসলে ইইউ বিভিন্ন সময়ে কথা বলে কেন? বা আমাদের নির্বাচন নিয়ে তাদের কথা বলার কোনো এখতিয়ার আছে কিনা? আমার মনে হয় না সেই এখতিয়ার ইইউ’র আছে। যেখানে ইইউ’র বড় অংশীদার যুক্তরাজ্যের একজন মেয়র নির্বাচনে কমিশনের পক্ষপাতিত্ব, পুলিশের নিস্ক্রিয়তা, রেসিজমসহ নানাভাবে ধর্মীয় অস্ত্রে ঘায়েল করে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মতো ঘটনা নিয়মিত শোনা যায়, তারা কীভাবে, কোন মুখে বাংলাদেশের নির্বাচনের “নিরপেক্ষতা সনদ” প্রদান করতে আসে? আমার বোধগম্য নয়! তাও আবার তারা এমন সব দলকে দলের প্রার্থীদেরকে উত্সাহিত করে “ফোড়ন” কাটে যাদের নির্বাচনের মূলধন-ই হলো ধর্মীয় সুরসুরি দিয়ে জনতাকে ধোকা দেওয়া!
আমরা ইউনাইটেড স্টেটস-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও সেখানকার “বিলিয়নিয়ার ক্লাব” এর ভূমিকার কথা কমবেশি জানি।
আমার বক্তব্য ভিন্ন। আমরা শহুরে আধুনিকতা চাইনা, বরং একটু গ্রাম্য হই। আর এইসব ইইউ ফিইউ থেকে আগত কুতুবদের অযাচিত মন্তব্যের বিরুদ্ধে বলি,
“ও হে দাঁতের মাজনের ফেরিওয়ালা, তোমরা আপাতত বিদেয় হও। তোমার নিজের দাতগুলো আগে ঝকঝকে বানাও, তোমার নখের চিকা আগে সরাও। তোমাদের অসুধ খাইয়ে পাশের গেরামের লোকদের আগে সুস্থ্য কর, তারপর এসো আমাদের সামনে তোমাদের দাঁতের মাজন আর চিকার ওষুধ বেচতে। তার আগে তোমাদের প্রেসক্রিপশন আমরা মানবো না।”
https://www.facebook.com/goutam.2511

পছন্দের পোস্ট করতে আপনাকে লগইন করতে হবে।
সাইদ বলেছেনঃ
ইদানিং কালে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিভিন্ন উন্নতিশীল দেশ বা সংস্থা (আমেরিকা/বৃটেন/জাতিসংঘ/ইউ/জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন সহ অন্যান্য তথাকথিত মানবধিকার গোষ্ঠী) নির্লজ্জ ভাবে উস্কানি মূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। এই সব বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে তাদের চতুরতা, শঠতা আর উগ্র ধর্মান্ধ প্রতি তাদের সহানুভূতিশীলতাই প্রকাশ পাচ্ছে অতিমাত্রায় এবং তা অবশ্যই ক্রমবর্ধিষ্ণু(তবে কি তারা এদেশটাকে তালেবান/আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তানের মতো আরেকটা দেশ দেখতে চান)।এই সব ভিনদেশীর বা সংগঠনের, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক যে কোন বিষয় বক্তব্য দেয়া বা কোন দলের হয়ে ওকালতি করা সম্পূর্ণ ভাবে অগ্রহণযোগ্য ও অনভিপ্রাত। এটা কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না বা যাবে না।
গৌতম হালদার বলেছেনঃ
সাইদ ভাই যথার্থই বলেছেন।
আমাদের যেকোনো বিষয়ে এই ইইউ সহ পশ্চিমা দেশগুলোর অযাচিত গলানো দেখে একরোখা উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ছাড়া উদার ও আধুনিক মননের সকলের মনেই যে কথাটি সবার আগে উঁকি দেয় হলো চারিত্রিক দিক দিয়ে ইএসব দেশগুলো আসলে ইতিপূর্ব কোনদিন উদারতার পরিচয় দেখাতে পারেনি। সকল “ভালো কথা”- পিছনে তাদের দুরভিসন্ধি সহজেই উপলব্ধ।
ইতিহাসে এমন কোনো নজির নেই যা তাদের স্বার্থের পরিপন্থী হলেও তারা গ্রহণ করেছে। উপরন্তু এমনটাই বার বার প্রতিভাত হয়েছে যে, টার্গেটেড দেশটি তারা বিভিন্ন কূটকৌশলে, পাতানো ফাঁদে আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ফেলে ধুলিস্যাত করে দিয়েছে।
বাংলাদেশের ধর্মান্ধ গোষ্ঠিকে; যাদের রাজনীতির মূল উপকরনই ধর্ম, তাদেরকে গণতন্ত্রের ছদ্দনামে সহায়তাও সেই সুদূরপ্রসারী অপকৌশলেরই নতুন রূপ বলে মনে হচ্ছে।
এর বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হবে, সবাইকে।
আপনার মূল্যবান মতামতের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
মোঃ আব্দুর রাজ্জাক বলেছেনঃ
এ বৈশ্বিকতার যুগে এক রাজ্যের নিজস্ব বিষয় বেশিক্ষণ নিজস্ব থাকে না। এটা খুব দ্রুত অন্যদেরও হয়ে দাঁড়ায়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া একটি বিবাহ কর্মের মতো পাত্রপাত্রী বিয়ে করেছে বলে ঘোষণা করলেই সেটা সমাজ মেনে নাও নিতে পারে। পাত্রপাত্রীদের দেখাতে হবে যে তারা আসলেই বিবাহিত। গণতন্ত্রও তদ্রুপ। শুধু নির্বাচন হলেই হবে না। নির্বাচনকারীদের প্রমাণ করতে হবে যে এটা সুষ্ঠু হয়েছে, সঠিক হয়েছে। যেহেতু আমাদের গণতন্ত্র পশ্চিমাদের কাছ থেকেই ধার করা, তাই আমাদের গণতন্ত্রের সনদের জন্য পশ্চিমের দিকে তাকানোর একটা ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে ইউরোপের দিকে শুধু গণতন্ত্রের জন্যই নয়, নানাবিধ কারণে আমরা তাকিয়ে থাকি। আমরা তাদের তোয়াজ করি, তাদের উকিল ধরি, তাদের মধ্যস্ততাকারী হিসেবে আহব্বানও জানাই। তাই ইউরোপিয় ইউনিয়ন আমাদের বিষয়ে সহজেই উৎসাহিত হয়; বন্ধ ুবলি আর কর্তৃত্ব বলি, ওদের হেদায়েত আমাদের গিলতেই হয়। এতে মাইন্ড করার মতো অবস্থায় আমরা আসলেই নেই।
এই যে আপনি ব্রিটেনের স্থানীয় সরকারের নির্বাচন সম্পর্কে এত খবর রেখেছেন, এটাও কিন্তু বিশ্বায়নের ফসল। শুধু আপনার নির্বাচন নিয়ে ওরা দুকথা বলছেন বলেই আপনি ওদের নির্বাচন নিয়ে কথা বলছেন, এমনটি নাও হতে পারে। গণতান্ত্রিক সমাজের যে কোন খবরাখবর অন্যান্য গণতান্ত্রিক সমাজের সদস্যরা স্বাভাবিকভাবেই রাখবে। এতে মনক্ষুণ্ন হওয়ার কিছু নেই। একে সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও একের দ্বারা অন্যের উন্নতি হবার উপায় হিসেবেই দেখা যৌক্তিক বলে মনে করি।