ভারতের রাজ্যসভায় বিল পাস ও বিএনপি’র ভারত বিরোধী অস্ত্রটি ভোঁতা

গৌতম হালদার
Published : 7 May 2015, 08:52 PM
Updated : 7 May 2015, 08:52 PM

বহুল প্রতীক্ষিত ভারতীয় সংবিধান-এর ১১৯তম সংশোধনী বিলটি অপরিবর্তিত অবস্থায় ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ বা রাজ্যসভাতে গতকাল ১৮১:০ ভোটে পাশ হয়। আশাকরা যায় লোকসভাতেও সংসদের চলতি অধিবেশনেই অর্থাৎ আগামী কাল ৮ মে'র মধ্যেই রাজ্যসভার মতো সর্বসম্মতভাবে পাশ হবে বিলটি। এটি পাশের সময়ে  উচ্চ কক্ষে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। রাজ্যসভার ওডিশার অবাঙালি নির্দল সদস্য শ্রী এ ভি স্বামী পরিষ্কার বাংলায় গেয়ে উঠেন 'শোনো, একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি… বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।'  গাইতে গাইতে তিনি কেঁদেও ফেলেন। তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় ছিলেন। হৃদয় দিয়ে সমর্থন করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে। সেদিন তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশেও দাঁড়িয়েছিলেন। আশাপ্রকাশ করেন সীমান্ত বিল পাস হওয়ায় দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে।

ভারত একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, বাংলাদেশও একটি স্বাধীন আর সার্বভৌম জাতি। দুটি দেশ পরিচালিত হয় আলাদা আলাদা সংবিধান আর নৈতিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। যেখানে বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা, আবার ভারতে বাংলাদেশ বিরোধিতা উভয় দেশেরই সরকার পরিবর্তনেরও অন্যতম কারণ হয়ে উঠে কখনো কখনো, যেখানে ভারতের সাথে আমাদের অসংখ্য বিষয়ে অমিল আর মতপার্থক্য এমনকি বৈপরীত্য বিদ্যমান, সেখানে, ভারতের সংবিধান সংশোধনের বিল আমাদের দেশে কেন এত গুরুত্বের সাথে আলোচিত হচ্ছে সেটি নিশ্চয়ই ভাববার মতো বিষয় বটে।
৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও বাংলাদেশ আর ভারতের মধ্যকার ছিটমহলগুলো এবং এর মধ্যে বসবাসকারী জনগনের জমি ও নাগরিকত্ত্ব সংক্রান্ত বেশ কতগুলি সমস্যা দির্ঘদিন ধরে ঝুলে ছিল বিলটি পাসের অভাবে। আর বিলটি পাশ করানোর উদ্যোগ ঝুলে ছিলো বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যথাযথ ইতিবাচক সরকারী কুটনৈতিক পদক্ষেপের অভাবে এবং ভারত সরকারের সদিচ্ছার অভাবে। তবে বর্তমান হাসিনা সরকারের জোড়ালো ভূমিকায় ভারতের সম্প্রতিগত মনমোহন সিং সরকারের সময়েই বিলটি পাশ করানোর চেষ্টা হয়েছিল ; তা ফলপ্রসু হয়নি মূলত ভারতের অভ্যান্তরে নানান পক্ষের রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে। বিলটি গতকাল উপস্থাপনের সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রী শ্রীমতি সুষমা স্বরাজ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে স্মরণ করতে ভুলেন নি, তিনি বলেন, 'এই বিল মনমোহনজিরই। তাঁর কাজ আমরা সমাপ্ত করলাম। এটা এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। কারণ, ৪১ বছর পর একটা চুক্তি বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে।'
বিলটি পাশের জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের সুদক্ষ কুটনৈতিক পদক্ষেপ আর ভারত সরকারকে এই সুযোগে অন্তর থেকে ধন্যবাদ।
বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ-এর সাথে ভারতের সাথে, বিশেষ করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস'র সঙ্গে সখ্যতা সবার কাছেই জানা। আমরা এ নিয়ে আমাদের দেশের অভ্যান্তরে, বিশেষ করে বিএনপি'র রাজনৈতিক প্রচারণায়, আওয়ামী বিরোধিতার ইস্যুতে 'আওয়ামী ভারত সখ্যতা' ইতোপূর্বে বেশ জোড়ালোভাবে কাজে এসেছে সেই ৯০ সাল থেকে। দেখেছি নব্বই-এর নির্বাচনে ভারত বিরোধিতার জিগির জনগনকে গলধকরণ করিয়ে কীভাবে রাতারাতি হিরো বনে গিয়েছিল বিএনপি? সেবার শুধুমাত্র ভারত বিরোধী স্লোগানেই বিএনপি আওয়ামী লীগকে ঘায়েল করতে পেরেছিল, পেয়েছিল দেশের শাসনভার। এমনও ঘটনার স্বাক্ষী আমরা হয়েছি, ভারতের রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ ভ্রমনে, সমস্ত সৌজন্যবোধ আর বাঙালি আতিথেয়তার ঐতিহ্য জলাঞ্জলী দিয়ে, শুধুমাত্র ভারত বিরোধী অবস্থান জনগনের কাছে সুস্পষ্টভাবে পৌছে দেবার সুযোগ নিতেই বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া শ্রী প্রনব মুখার্জির সাথে দেখা করেন নি।
বিএনপির রাজনীতিতে ভারত বিরোধিতা একটা গুরুত্ত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। ভারতের বিরোধিতা করতে গিয়ে অন্যকারও প্রতি প্রীতি, এমনকি যে দেশটির অপশাসন, শোষণ আর বঞ্চনার প্রতিবাদে বাঙালী একসাগর রক্ত, ত্রিশ লক্ষ প্রাণ আর তিন লক্ষ মা বোনের জীবনের অমূল্য সম্পদ, সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সেই পাকিস্তান প্রীতিও দেখাতে কুন্ঠাবোধ করেনি বিএনপি। কিছু মানুষ, যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও পাকিস্তানের প্রতি ছিল অনুগত, তারা, আর তাদের উত্তরপুরুষদের কাছে এটা বরং ভালই লেগেছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রী মনমোহন সিং যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন, তখন ভারত বাংলাদেশ দুতরফেই বেশ আশার বাতাস বইছিল তিস্তা জলবন্টন চুক্তি আর ট্রানজিট চুক্তি নিয়ে। হঠাত তা আটকে যাওয়াতে, বিষয়টি নিয়ে  সেসময়ে বিএনপি বেশ সরগরম হয়েছিল। আর সেসময়ে চুক্তিদ্বয় স্বাক্ষরিত হলে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভিন্ন রকমই হতে পারতো, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। চুক্তিদুটি না হওয়াতে বিএনপির ভারতবিরোধী প্রচারণার পালে কুসুম হওয়া লেগেছিল, কিছুটা হলেও বেগবান হয়েছিল তাদের সরকার আর ভারত বিরোধী জিগিরও।
পাশাপাশি অবস্থিত প্রতিবেশীদের মধ্যে তো আর সুইচ টিপে সব সমস্যা রাতারাতি সমাধান হয়না! বর্তমান আওয়ামী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপে ইতোমধ্যেই ভারত আর মায়ানমার-এর সাথে সমুদ্রসীমানা সংক্রান্ত জটিলতা পিসফুল্লি সমাধান হয়েছে। তিস্তা চুক্তিটিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী'র আসছে জুনের সফরে আশাকরা যায় সম্পন্ন হবে। এতসবের পর এখন কিছু বিষয়ে অনিস্পন্ন অবস্থায় থাকবে, সেটা খুবই স্বাভাবিক। তবে সব কিছু ছাপিয়ে ছিটমহল বিনিময় চুক্তিটি বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এই চুক্তিটিতে বাংলাদেশ অধিক পরিমানে ভূমির মালিকানা পাবে, ছিটমহলবাসী পাবে দীর্ঘদিনের বঞ্চনা আর অনিশ্চয়তা থেকে চিরমুক্তি। এটা নিঃসন্দেহে বর্তমান সরকারের কৃতিত্ত্ব, তৃপ্তিদায়ক কুটনৈতিক সফলতা। দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে যে সমস্যা বিরাজমান ছিল দুটি দেশের মধ্যে, সেটি অচিরেই শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণ ভাবেই নয়, বরং লাভজনকভাবে নিষ্পন্ন হতে হচ্ছে, এটি নিশ্চয়ই সুখের কথা বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের কাছে, যেমনটি আনন্দের কথা এতদিন প্রায় অবরুদ্ধ ছিটমহলবাসীর কাছে।
এতসব আনন্দের খবর নিয়ে যখন সারা বাংলাদেশে সবাই সরব বর্তমান সরকারের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও আন্তরিকতাপূর্ণ পদক্ষেপের প্রশংসায়, ঠিক সেই সময়ে এদেশের একটি রাজনৈতিক দল, বিএনপি, আর তার কিছু অনুসারী যারপরনাই মর্মাহত। তাদের মর্মাহত হবার মত কথাও বটে। কারণ ছিটমহল বিনিময়ের মতো ঝুলে থাকা চুক্তি সম্পাদন হয়ে গেলে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার পালেই হওয়া লাগবে, পক্ষান্তরে বিএনপি'র ভারত বিরোধী প্রচারণার মূল অস্ত্রটি যে হয়ে পরবে ভোঁতা।