বিনা খরচে ইন্টারনেট না হয় যেন ডিজুস আর জয় প্যাকেজের মতো দুঃশ্চিন্তার কারণ

গৌতম হালদার
Published : 11 May 2015, 07:23 AM
Updated : 11 May 2015, 07:23 AM

গতকাল থেকে দেশব্যাপী মোবাইল অপারেটর রবি'র মাধ্যমে নি:খরচায় ইন্টারনেট চালু করেছে ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মি. মার্ক জুকারবার্গ। ইতিপূর্বে অবশ্য এই পরিষেবা আফ্রিকান বেশ কিছু দেশে চালু হয়েছে বলে আমরা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে অবগত হয়েছি। প্রাথমিকভাবে সর্বমোট পঁচিশটি ওয়েবসাইট 'ফ্রি ইন্টারনেট' পরিসেবার মাধ্যমে পাওয়া যাবে। পরবর্তিতে এটি বাড়বে বলেই আপাত অনুমেয়।

বর্তমান সরকারের যতগুলো ভালো উদ্যোগ আছে, তার মধ্যে বোধকরি সেরাটি হলো পুরো দেশকে ইন্টারনেট পরিসেবার আওতাভুক্ত করা। এর মাধ্যমে সরকারী বিভিন্ন দপ্তরের কাজকর্মে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির পেয়ে একদিকে যেমন মানুষের কাছে তথ্যপ্রযুক্তি সহজলভ্য হবে, অন্যদিকে কাজের ক্ষেত্রে গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে, লালফিতার দৌরাত্ব্য আর দূর্নীতিও এতে করে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে, সন্দেহ নেই। তবে ব্যাপক ভিত্তিতে তথ্য প্রযুক্তির সফলতা পেতে সরকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যবহারকারীদের অনেক প্রস্তুতির দরকার আছে এ কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।
ফ্রি নেট ব্রাউজ করার সুযোগ নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাবার যোগ্য। এ প্রসঙ্গে আমাদের আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জনাব জুনায়েদ আহমেদ পলক-এর অবদানের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতেই হবে। তবে এই ফ্রি ব্রাউজিং সুবিধায় কিছুটা ভয় হয়। ভয় হয় কারণ আমরা তো যাতে বাঙালি! ফ্রি কিছু কোথাও পেলে, ব্যবহারের থেকে অপব্যবহার আমরা একটু বেশিই করি।
প্রাথমিকভাবে ফ্রি ব্রাউজিং তালিকায় স্থান পাওয়া ওয়েবসাইটগুলোর মধ্যে সরকারী কিছু সাইটও পাওয়া যাবে, দু তিনটি নিউজ সাইট পাওয়া যাবে, আর পাওয়া যাবে "ফেসবুক"। সবগুলো সাইটের মধ্যে ব্যবহারের দিক থেকে বোধকরি পঁচানব্বই থেকে সাতানব্বই শতাংশ ব্যান্ডউইথ ব্যবহৃত হবে শুধুমাত্র ফেসবুক ইউজের জন্য। হিসেবটা পৌনপৌনিক নয়, এটি নিছকই অনুমান, তবে এর যথার্ততা এই সেবা উদ্বোধনকালে মাননীয় প্রতিমন্ত্রী'র কথায় স্পষ্ট, তিনি বলেন, বাংলাদেশের ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষ এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, যা মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ। এ দেশে প্রতি ১২ সেকেন্ডে একজন ফেইসবুকে প্রোফাইল খুলছে, যা দেশের জন্মহারের চেয়েও বেশি।
তাহলে কথা এটাই দাঁড়ায় আপাতত বাকি চব্বিশটি সাইটে মোট ফ্রি ব্যবহৃত ব্যান্ডউইথের তিন থেকে পাঁচ শতাংশ ব্যবহার হবে, যার মধ্যে জনপ্রিয়তার দ্বিতীয় ধাপে আছে বিডিনিউজ24ডটকম  ও প্রথমআলোডটকম -এর মতো স্থানীয় অতিজনপ্রিয় নিউজ সাইটগুলো, এর পর আসে সরকারী সাইট সহ অন্যান্য সাইটের কথা। এ প্রসঙ্গে সরকারী সাইটগুলো মোবাইল দিয়ে ব্রাউজ করার অপরিহার্য্যতা নিয়ে কথা বলতে হয়, কারণ যে সব প্রয়োজনে সরকারী সাইটগুলো মানুষ ব্রাউজ করে, সে সব প্রয়োজন মোবাইল দিয়ে ব্রাউজ করে পূরণ করা কতটুকু সম্ভব? তা নিশ্চয়ই ভাবে দেখার মতো বিষয় বটে। তাহলে কথা ঠিক ঐটাই সার, তাহলো, এই ফ্রি ইন্টারনেট সুবিধা মূলত ফেসবুক-এর ব্যবহারে, 'ফেসবুক'-এর প্রয়োজনে। তবে আমাদের দেশে, অতিরিক্ত ফেসবুক আসক্তি, বিশেষ করে যুবসমাজ ও শিক্ষার্থীদের ফেসবুক ম্যানিয়া ইতোমধ্যে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করেছে, সেটা সকলেরই জানা।
আজকের দিনের রবি, একদা যা একটেল নাম পরিচিত ছিল, সেই একটেল আমাদের দেশের মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে বেশ জোড়ালো অবদান রেখেছিল সেটা আমাদের সকলেরই জানা। আমাদের মনে আছে  গ্রামীন ফোনের 'ডিজুস'-এর কথা। মনে আছে একটেলের 'জয়' পাকেজের কথাও। রাতে অল্প খরচে কথা বলার জন্য ডিজুস সিম কেনার হিড়িক পরে গেছিল সেসময়ে। এর পর রবি এনেছিল 'জয়' সিম। দুটো পাশপাশি মোবাইল নম্বর একত্রে পাওয়া যেত, এর একটি থেকে আর একটিতে ফোন করে দুইটাকা ত্রিশ পয়সায় ত্রিশ মিনিট করে কথা বলা যেতো প্রতিটি কলে দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা। 'জয় প্যাকেজ' আর 'ডিজুস প্যাকেজ' তখনকার সময়ে উঠতি বয়সী, বিশেষ করে তরুণ-তরুনীদের কাছে অনিবার্য নাম্বার। দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছিল এক চরম অস্থিরতা।শিক্ষার্থীরা রাত জেগে কথা বলতো প্রিয়জনের সাথে, দিনে পড়ে পড়ে ঘুমাতো। যুব সমাজ হয়ে উঠেছিলো মোবাইলাসক্ত, দূরে বসবাসরত স্বামী-স্ত্রীদের পারিবারিক সম্পর্ক পৌছে গিয়েছিল ভাঙ্গনের মুখে, দেশ পৌছে গিয়েছিল চরম এক সামাজিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে। এইরকম অবস্থায়  BTRC কে হতে হয়েছিল সক্রিয়, মোবাইল অপারেটর গুলোর জন্য নির্ধারণ করে দিতে হয়েছিল মিনিট প্রতি নুন্যতম কল রেট্, যার মাধ্যমে সমাজ ফিরে অনেকটা এসেছিলো নিয়মিত ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়।
এখন প্রশ্ন হলো মি. মার্ক জুকারবার্গ -এর ফ্রি ইন্টারনেট ব্যবহারের এই সুযোগে 'ডিজুস প্যাকেজ' আর 'জয় প্যাকেজ' এর অনুরূপ প্রতিক্রিয়া আবার আমাদের সমাজে তৈরী হবে না তো! সংশ্লিষ্ট মহল সে বিষয়টা ভেবে দেখেছেন তো! আমরা তো ঘর পরা গরু, তাই আমাদের ভয় একটু বেশিই।