সমুদ্রপথে মৃত্যুমুখে মা ও শিশুসহ হাজারো অভিবাসী ও আমাদের নৈতিকতা 

গৌতম হালদার
Published : 16 May 2015, 08:02 AM
Updated : 16 May 2015, 08:02 AM

সমগ্র বিশ্বব্যাপী যে খবরটি সর্বাধিক গুরুত্বসহকারে প্রচারিত আর আলোচিত হচ্ছে এখন, তা হলো- মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড আর ইন্দোনেশিয়া উপকূলে নৌপথে আসা অভিবাসীদের তীরে ভিড়তে না দিয়ে বরং নৌকাগুলোকে ভয় দেখিয়ে দূর সমুদ্রে তাড়িয়ে দেয়া। প্রতিটি নৌকাই বহন করছে পুরুষের পাশাপাশি প্রচুর সংখ্যক বয়স্ক মহিলা আর কোলের শিশুও। এসব অভিবাসী নৌকায় দুগ্ধপোষ্য শিশু আর তাদের মায়েদের সংখ্যা আর তাদের দুর্ভোগের হৃদয়বিদারক আহাজারির ছবি দেখলে সহজেই বোঝা যায় দিনের পর দিন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাসাধিক কাল তীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভাসমান অবস্থায় থেকে থেকে এসব নৌকায় এখন চলছে কতটা নির্মম মানবিক বিপর্যয় !

মা আর মাতৃভূমি স্বর্গের চেয়েও উত্তম স্থান আর পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনো স্থানে মাতৃভূমির মতো শক্তি আর সাহস দেখানো সম্ভব না, সেটা সবারই জানা। মাতৃভূমি ব্যতিত অবশিষ্ট সকল স্থানেই, সমাজের চোঁখে, শরণার্থী বা সোজা বাংলায় "উদ্বাস্তু" হয়েই বেঁচে থাকতে হয় অভিবাসিদেরকে, সেটাও সবার জানা। শরনার্থী অর্থাত ওই দেশের জন্মসূত্রে নাগরিক নয়, বরং স্থানীয় অধিবাসীদের চোঁখে আশ্রয়ের জন্য "বিশেষ অনুকম্পা প্রাপ্ত" আর "দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক" বা "নিকৃষ্ট শ্রেনীর মানুষ" । তথাপি, এতসব বঞ্চনা আর অবহেলা সত্বেও, অনিশ্চিত ভবিষ্যত, নিজের আর সন্তানের জীবন বিপন্ন করে, সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থেকে প্রতিবছর শিশু ও বৃদ্ধসহ শত শত নারী-পুরুষ, জন্মভূমি ছেড়ে নৌকোয় করে অন্য দেশে পাড়ি দেয়। বলা ভালো, পাড়ি দিতে বাধ্য হয় বা অভিবাসী হতে বাধ্য হয়। কারণ যে দেশে তাদের মাতৃভূমি, সেখানে তাদের বেঁচে থাকার ন্যুনতম সুযোগ থাকলেও কেউ এভাবে নিজের ও সন্তানের জীবনকে অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ঠেলে দেয় না।

মালয়শিয়া আর থাই উপকূলে এইসব নৌকায় মূলত রয়েছে নারী শিশু আর যুবতী নির্বিশেষে হাজার হাজার মায়ানমারের রোহিঙ্গা আর বাংলাদেশের উদ্বাস্তু। এরা সবাই জন্মসুত্রে মায়ানমার অথবা বাংলাদেশের নাগরিক। মায়ানমারে বীভৎসভাবে চলছে রোহিঙ্গা নির্যাতন, সেটা সারা বিশ্ব অবগত। তবে বাংলাদেশের কোনো জাতি-ধর্ম আর শ্রেণীর মানুষ বর্তমানে এতটা নির্যাতনে "হয়ত" নেই, যে তাদেরকে, জীবনের এতবড় ঝুঁকি নিয়ে, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেও স্বপরিবারে দেশত্যাগ করে অন্য দেশে পারি দিতে হবে। বাংলাদেশী এসব মানুষ মূলত স্থানীয় দালাল আর তাদের দেশব্যাপী বিস্তৃত নেটোয়ার্কের সহযোগীদের প্ররোচনায় প্রলুব্ধ হয়ে নৌপথে পাড়ি জমিয়েছে ঐসব দেশে।

আমরা ইতোপূর্বে অনেকবার দেখেছি এইসব দালালদের মাধ্যমে নৌপথে পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া যাবার পথে অনেক দুর্ঘটনা। এমনকি মাঝ সমুদ্রে অভিবাসীদের গুলি করে মেরে মৃতদেহ সমুদ্রে ভাসিয়ে দেবার মতো দালালদের নিষ্ঠুরতার কথাও আমাদের সবার জানা।

মালয়েশিয়া মানুষ পাঠানোর এইসব দালাল হিসেবে কোন কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, কে কীভাবে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছে এভাবে অবৈধ পথে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর কিংবা ইন্দোনেশিয়া যেতে, তা খুঁজে বের করা কঠিন কোনো কাজ নয়। যদিও দালালরা এর বিনিময়ে মোটা টাকা সংগ্রহ করছে, যার একটি অংশ তারা ব্যবহার করছে বেআইনি এইকাজে আইনি জটিলতা থেকে মুক্ত থাকার জন্য, সেটা বোধ করি কারোর অজানা নয়, যার ফলশ্রুতিতে তারা প্রশাসনের নাকের ডগায় থেকে, নির্বিঘ্নে পূণ পূণ লোকসংগ্রহ আর এই ঝুঁকিপূর্ণভাবে মানবপাচার করার বেসাতি শুধু টিকিয়েই রাখতে সক্ষম হচ্ছেনা, বরং দোর্দন্ড প্রতাপে পরিসর বাড়াচ্ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এসব দালালদের কুট-কৌশল আর অর্থের প্রতাপে আমার প্রতিবেশী, তার মা, তার বোন, তার ভাই, তার শিশুসন্তানটি জীবন বিপন্ন করে, এভাবে অবৈধভাবে, সমুদ্রপথে দিনের পর দিন অর্ধাহারে-অনাহারে কাটিয়ে, অমানবিক মানসিক-শারীরিক নির্যাতন- এমনকি ধর্ষণের স্বীকার হয়ে স্বপ্নের গন্তব্যে পৌঁছানোর পরিবর্তে পৌঁছে যাবে মৃত্যুর দুয়ারে, এর বিরুদ্ধে আমাদের কী কিছুই বলার নেই?

প্রকাশিত ছবি গুলো দেখলে সহজেই বোঝা যায়, "জীবনের ন্যুনতম প্রয়োজন" থেকে বঞ্চিত এই কঙ্কালসার মানুষগুলোর চোখের জলও আর অবশিষ্ট নেই, শুকিয়ে গেছে অভুক্ত থেকে, নির্যাতন আর পাশবিকতার স্বীকার হয়ে। আজ হয়ত অনেকেরই কাছে ওরা আমাদের 'আত্মীয়-স্বজন' কেউ নয়, তাই আমরা বিষয়টি 'গা' করি না, কিন্তু কাল আমার সন্তানটি যখন আমায় জিজ্ঞেস করবে "বাবা, আমার খেলার সাথী কোথায়, আমি কার সাথে খেলবো?" আগামী প্রজন্মের কাছেই বা আমি তখন কী উত্তর দিবো?