শান্তির দেবদূত ড. ইউনূস সমীপেষু

গৌতম হালদার
Published : 20 May 2015, 05:58 PM
Updated : 20 May 2015, 05:58 PM
বলো কী তোমার ক্ষতি, জীবনের অথৈ নদী 
পাড় হয় তোমাকে ধরে দূর্বল মানুষ যদি-

পরম শ্রদ্ধেয় ড. ইউনুস,

আপনি এই বাংলাদেশেরই সন্তান। আমার মতো কোনো সাধারণ পরিবারের। আপনি নিজ গুণে, নিজ ক্ষমতায়, নিজ প্রচেষ্টায় আজ সারাবিশ্বে পরিচিত, মাননীয় আর শ্রদ্ধারসাথে উচ্চারিত এক নাম। আপনার কর্মের সুখ্যাতি আর স্বীকৃতি বিশ্বজোড়া। যেখানেই আপনার হাতের স্পর্শ পায়, সেখানেই সোনা ফলে। বাংলাদেশের মানুষ হয়েও আপনি কর্মের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। আমাদের গর্ব হয় আপনাকে নিয়ে। এ দেশে আপনি 'ক্ষুদ্র ঋণ' প্রবর্তন করেছেন। গরীব দুঃখী আর সম্বলহীন মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন আর্থিক সক্ষমতা। ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবসা ছেড়ে এখন আবার ব্যবসার ভিন্ন আঙ্গিক। সামাজিক ব্যবসা। এখনও, জীবনের এই পড়ন্ত বেলায়ও আপনি স্বপ্ন দেখেন। আপনি মানুষকে স্বপ্ন দেখান। সপ্ন দেখান দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠানোর। আপনার বক্তৃতা আফ্রিকা থেকে সাইবেরিয়া, সমস্ত মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে, সেতো বক্তৃতা নয়, যেন মোহিনীমন্ত্র। আপনি পরশ পাথর।

আপনি সারাবিশ্বে পরিচিত ক্ষুদ্র ঋণের দেবদূত, এই বাংলাদেশে নয় শুধু। ঋণ দিয়ে ঘরের শান্তি, সমাজের শান্তি আর দেশের শান্তি আপনি স্থাপণ করেছেন, তাইতো আপনি নোবেল ভূষিত। আপনি 'শান্তিতে' পৃথিবী শ্রেষ্ঠ পুরস্কার নোবেল বিজয়ী। আপনার নাম উচ্চারণে দেশবাসী হিসেবে আমাদের সকলের বুক প্রশস্ত হয়। আমরা বিশ্বব্যাপী আপনার আলোয় আলোকিত হয়ে উঠি।

আপনি নিশ্চয়ই অবগত, আপনার জন্মভূমি, মাতৃভূমি বাংলাদেশের দুধের শিশু-মা থেকে শুরু করে শত সহস্র নারী-পুরুষ মালয়েশিয়া উপকূলে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সমুদ্র বক্ষে ভেসে বেড়াচ্ছে। দিনের পর দিন না খেয়ে মানুষগুলো এখন শুধুই অস্থিসার, মৃত্যুমুখে নিপতিত। ইতোমধ্যে থাইল্যান্ডে, গহীন বনে, বাংলাদেশী উদ্বাস্তুদের জীবন্ত গণকবরের কথা আপনি শুনেন নি, সেটা বিশ্বাস করিনা। সেই গণকবর থেকে উদ্ধারকৃতদের মধ্যে দু-একজন বাংলাদেশীকে জীবন্ত পাওয়া গেছে, সেটাও নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়।

বাংলাদেশি আর বার্মিজ রোহিঙ্গা বোঝাই অসংখ্য ট্রলার থাই-মালয় উপকূলে ভাসমান। থাই-মালয় সরকারগুলো তাদের উপকূল রক্ষীদের নির্দেশ দিয়েছে ইঞ্জিন চালিত, উদ্বাস্তুবাহী এইসব ছোট ছোট নৌকোগুলো যেন কিছুতেই তাদের দেশে ভিড়তে না পারে। নৌকোগুলোতে খাবার সংকট, পানীয় সংকট, জালানি সংকট প্রকট। অবস্থা এমন, পানীয় জলের অভাবে নিজমুত্র পানে সবাই বাধ্য হয়েছে। বড় করুন অবস্থার স্বীকার হয়েছে আর হচ্ছে ছোট শিশু আর নারীদের। তারা শক্তি দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছেনা, যে সামান্য পরিমান খাবার অবশিষ্ট আছে, তা সংগ্রহের যুদ্ধে, পুরুষদের সঙ্গে। কালই প্রকাশিত হয়েছে, খাবার নিয়ে সংঘর্ষে প্রাণ গেছে একশ বাংলাদেশী উদ্বাস্তুর। চূড়ান্ত মানবিক বিপর্যয় চলছে সমুদ্রবক্ষে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর একটি প্রজন্ম ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

জাতি সংঘ থেকে শুরু করে তাবৎ বিশ্বের মানবতাবাদী সংস্থাগুলো উদ্বাস্তুদের এই বিপন্ন অবস্থার কারণে জেরবার। তারা শরনার্থীদের নিদারুন মানবিক বিপর্যয় রোধে আর তাদের কষ্টের অবসানে সচেষ্ট। অনুরোধ-উপরোধ করে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট দেশ আর সরকারগুলোকে উদ্বাস্তুদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার জন্য।
আপনার কথা, আপনার বক্তৃতা, রাষ্ট্র প্রধান থেকে আমার মতো অবোধ বালক সবাই শুনে, সবাই আপনাকে মান্য করে। গুলিস্তান থেকে ওয়াশিংটন, পল্টন থেকে ম্যানহাটান, ক্লিনটন থেকে ওবামা, হিলারি থেকে কিলারী কিংবা উইলিয়াম থেকে মুলায়াম সর্বত্র আর সবাই আপনার বাণী শোনে, আর আরও শোনার জন্য অধিক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকে। এদের কাছে আপনার বক্তৃতা তো বক্তৃতা নয়, যেন দেবদূতের ওষ্ঠ নিসৃত অমীয় ধারা।
আপনি শান্তির সুবাতাস।আগেও বলেছি আপনার কর্ম বিশ্ব স্বীকৃত। বিশ্ব প্রশংসিত। আপনি এদেশে লাখো পরিবারে সচ্ছলতা এনেছেন। আপনার দেশেরই, হয়তোবা এদের কেউ নিকট আত্মীয় নয় ঠিকই, প্রতিবেশী তো হতে পারে, পেটের তাগিদে চৌদ্দ পুরুষের ভিটে মাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু হওয়া, এইসব হতদরিদ্র পরিবারগুলোর পক্ষে, নোবেলজয়ী হিসেবে না হোক, মানবিক দিক বিবেচনায় দু-একটি কথাও কি আপনি খরচ করতে পারতেন না? আপনি কি পারেন না? এতগুলো মানুষের এই নিদারুন আর সীমাহীন কষ্ট কী আপনাকে মোটেও ব্যথিত করেনা? হতেও তো পারত, মানবতার বিপর্যয় রোধে আপনার উদ্বেগ পৌছে যেতো থাই মালয়ী নীতি নির্ধারকদের কাছে, আর এই অসহায় নিরন্ন ভাসমান মানুষগুলো পেত জীবনের কিনারা।

পরিশেষে, শুরু করেছিলাম একটি কালজয়ী মানবতাবোধের নন্দিত গানের কথা থেকে। আর শেষ করবো এই বাংলার এক কবির কবিতা দিয়ে। তিনি আপনার মতো বিশ্ব নন্দিত নয় ঠিকই, তবে এদেশের রাজা-প্রজা নির্বিশেষে সকল মানুষের কাছে চির স্মরণীয়, আর দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক, তার দুটো লাইন দিয়ে, তা হলো;

'স্বদেশের উপকারে নেই যার মন 
কে বলে মানুষ তারে? পশু সেই জন'