নয়ন বাছার। হতভাগ্য ছেলেটি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, পিরোজপুর ও সরকারি সোহরাওয়ার্দি কলেজ, পিরোজপুর থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে থেকে এখন জগন্নাথের ছাত্র।
শত প্রচেষ্টা সত্বেও দুর্ভাগ্য ওর আর ওর মা স্কুল শিক্ষিকা শিখা রানি মজুমদার-এর পিছু ছাড়ছে না। শিশুবয়সে স্নেহ ভালবাসা কী? তা বোঝার পুর্বেই বাবা ওদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন ভারতে, আর ফিরে আসা তো দুরে থাক – কোনদিন খোঁজ নেননি পর্যন্ত। সেই থেকে বাবার অবর্তমানে মা-ই ওর বাবা, মা-ই ওর মা।
অনেক কষ্টে এতদিন এই অন্ধের যষ্ঠীকে নিজের বুকে আগলে রেখে, রেজিস্টারি প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা আর শিশুদেরকে পড়িয়ে নিজের আর সন্তানের পড়াশুনার খরচ চালিয়েছেন মা শিখা রানি। আর স্বপ্ন দেখেছেন ছেলে বড় হয়ে সব কষ্ট ভুলিয়ে দেবে।
হ্যা। ছেলেও ঠিক মায়ের মত। কষ্ট করেই মানুষ হতে হবে – ঠিক বুঝতে পেরেছে। তাইতো অনার্স এ ভর্তি হবার সাথে সাথে টিউশনি করে নিজের খরচ মেটাতো, মায়ের শ্রম যাতে কিছুটা হলেও লাঘব হয় সেই ভাবনায়।
দিন এভাবেই যাচ্ছিলো। হঠাত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়ে হতভাগ্য সন্তান আর তার আজন্ম দুখি মায়ের সব স্বপ্ন ধুলিস্যাত করে দিয়েছে।
এ নিয়ে প্রথম আলো, কালের কন্ঠ মানব কন্ঠ সহ বেশকিছু পত্রিকা সিরিজ রিপোর্ট করেছে। কিছু সাহায্য পাওয়া গিয়েছে- তা দিয়ে আর বিভিন্ন গ্রামিন সংস্থা থেকে উচ্চসুদে ঋণ নিয়ে এতদিন ছেলের চিকিতসা চালিয়ে এসেছেন এই মা। এ নিয়ে সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরার প্রয়াশে আমি প্রথম আলো থেকে কোট করছি-
". . . . রাজধানীর দয়াগঞ্জে একটি মেসে থেকে পড়াশোনা করতেন তিনি। নয়নের ভাষ্য, গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে বাসে চড়ে ছাত্র পড়াতে যাচ্ছিলেন তিনি। কিছু দূর গেলে কে বা কারা বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। অন্য যাত্রীদের সঙ্গে নেমে দৌড় দেন তিনি। কোতোয়ালি থানার পুলিশ তাঁকে ধরে ফেলে। পুলিশ বলে, 'তুই শিবির করস, তুই আগুন দিছস!'"
" . . . . শিখা রানী বলেন, 'মাস্টারি করে পাই ১২ হাজার টাকা। আট হাজার টাকা ঋণ বাবদ ব্যাংকে দিতে হয়। এবার বোঝেন, চার হাজার টাকায় সংসারটা কীভাবে চালাই! আবার নয়নকে ভারতে নিয়ে যেতে হবে। আবার অস্ত্রোপচার করতে হবে। কিন্তু আমার কাছে কোনো টাকা নেই। জানি না, কী করব?' শিখা রানী বলেন, 'একদিকে ছেলের পা, আরেকদিকে ছেলের কাঁধে মামলা। সব সময় আতঙ্কের মধ্যে থাকি।'"
" . . . .একটি ব্যাংক থেকে দুই লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও মোরেলগঞ্জ উপজেলার শিক্ষক সমিতি ও একজন পুলিশ কর্মকর্তার দেওয়া টাকা দিয়ে নয়নকে নিয়ে গেছেন ভারতের চেন্নাইয়ের এক হাসপাতালে। সেখানে অস্ত্রোপচার করা হয়। দেশে ফিরে এখনো ছেলের ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় আছেন শিখা রানী।"
এখনও চিকিতসা বেশ বাকি। অথচ টাকার অভাবে আর চলছে না চিকিতসা। আমি নিজের ইচ্ছেতেই পরিবারটির খোঁজ নিতে যতবারই যোগাযোগ করেছি, প্রতিবার ফোনের ওপারে মা শিখা রানীর অঝোড় কান্নায় নির্বাক দহিত হয়েছি। শান্ত্বনা জানানোর ভাষা খুঁজে পাইনি।
আসুন না ভাই/বন্ধু যে যতটুকু কিংবা যেভাবে পারি আমরা সাহায্য করি আর ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করি মা শিখা রানীর বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন, নয়নের মনি "নয়ন" এর স্বাভাবিক জিবন। আপনার-আমার, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই দুঃখী পরিবারটির দীর্ঘনিশ্বাস যদি কিছুটা লাঘব হয়, মানুষ হিসেবে সেটাই তো আমাদের সকলের পরম প্রাপ্তি।