গত তিন-চার দিন আগে আমার মায়ের জ্বর আর কাশি শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে নাপা এক্সট্রা খেতে দেই। ওতে জ্বর না কমাতে উপায় না দেখে হেল্পলাইন '৩৩৩' পরিষেবায় কল করি। প্রায় পাঁচ মিনিট অপেক্ষার পর একজন কল ধরে আমার সমস্যাটি শুনতে চাইলেন।
তিনি একজন ডাক্তার এবং আমার পুরো বক্তব্য শুনে ফোনেই প্রেসক্রাইব করলেন। ব্যাপারটা ভালো লেগেছে, যে ঘরে বসেই ডাক্তারের সাথে কথা বলে স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারছি।
কিছুদিন ধরে টিভিতে আর ফেইসবুকে দেখছিলাম ৩৩৩ পরিষেবার প্রচারণা; সাহায্যের প্রয়োজন হলে ৩৩৩ হেল্পলাইনে কল দিতে বলা হচ্ছে। তারপর বাড়িতে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হবে। এমনটা বাংলাদেশে আসলেও সম্ভব তা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছিল না। তবুও উপায় না দেখে আবারও কল দিলাম ৩৩৩ হেল্পলাইনে। প্রায় সাত মিনিট অপেক্ষা করার পর একজন ওপাশে একজন সাড়া দিলেন।
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার কমলগঞ্জ পৌরসভা ৮নং ওয়ার্ডের পশ্চিম কুমড়াকাপন গ্রামে প্রায় ২০০ পরিবারের বসবাস। তার মধ্যে থেকে প্রায় ৭০ পরিবারের মতো পৌরসভার অধীনে আর বাকি পরিবারগুলো কমলগঞ্জ ৫নং সদর ইউনিয়নের অধীনে।
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ঘরে থাকুন কর্মসূচির ১৬ দিন পেরিয়ে যাচ্ছে এখানে। গ্রামের ৯৫ শতাংশ পরিবার গরীর-মধ্যবিত্ত বা আর্থিকভাবে অসচ্ছল। গ্রাম সংলগ্ন ভানুগাছ বাজারকে ঘিরে এই গ্রামের মানুষের আয়-রোজগার। কিন্তু বাজারের পরিস্থিতি এখন ভালো না। নিত্য প্রয়োজনীয় দোকানপাট ছাড়া বাকি সবগুলো দোকানই বন্ধ থাকায় অনেকেরই আয়-রোজগারও বন্ধ।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের যেভাবে এগিয়ে আসা উচিৎ ছিল তাদের কাউকে এগিয়ে আসতে দেখিনি। সরকারি-বেসরকারি বা কোনো সংগঠন থেকেও কেউ ত্রাণ ও সহযোগিতা নিয়ে আসেনি।
এমন পরিস্থিতিতেই ৩৩৩ হেল্পলাইনে কলটি করেছিলাম আমার গ্রামের এক বন্ধুর মোবাইল থেকে। ওই বন্ধুই দুঃখ করে আমাকে বলেছিল, যদি এই নিদানের দিনে কেউ আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতো!
সরকারের হেল্পলাইনে ফোন দিলে খাবার পৌঁছে দেওয়া হবে শুনেছিলাম। আসলেই দেবে তা নিয়ে আস্থা না থাকলেও ফোনটা দিয়েছিলাম।
ওই প্রান্তে যিনি ফোন ধরেছিলেন তিনি বললেন, কোথা থেকে বলছেন নামটি বলে প্রশ্নটি করুন। কী জানতে চান?
বললাম, আমি গৌতম পাল, ফোন দিয়েছি মৌলভীবাজার থেকে। আমার গ্রামে প্রায় ১৫০ পরিবার, তার মধ্যে ৮০-১২০ পরিবার নিম্ন আয়ের। তাদের জন্য এখন পর্যন্ত সরকার থেকে কেউ এগিয়ে আসেনি। তারা কানো ত্রাণ বা সাহায্য পায়নি।
আমার পুরো তথ্য নিয়ে ফোনে থাকা নারীকণ্ঠী আমাকে বললেন, আমরা আপনার এলাকার ডিসি, ইউএনও, মেয়র বা এলাকার জনপ্রতিনিধির কাছে আপনার তথ্যটি পাঠিয়ে দেব। উনারা যথা সম্ভব আপনার সমস্যা শুনে-বুঝে আপনাদের-আপনার সহযোগিতায় এগিয়ে আসবেন।
এই আলাপের ঘন্টা দুয়েক পরে আমার বন্ধুর মোবাইলে কল আসে। ফোন দেন কমলগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জুয়েল আহমদ।
তিনি বলেন, তুমি কি গৌতম বলছ?
আমার বন্ধু বললো, না স্যার;
– তাহলে গৌতম কে?
– স্যার, সে আমার বন্ধু।
– তাহলে ত্রাণ লাগবে কার? তোমার না গৌতমের?
– স্যার, আমার।
– তাহলে তুমি গৌতমকে নিয়ে তাড়াতাড়ি করে আমার বাসায় এসে দেখা করো।
আমার বন্ধু সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ফোন দিয়ে জানালো বিষয়টি।
– মেয়র কল দিয়েছিল। উনার বাসায় গিয়ে দেখা করার জন্য বলেছেন। সাথে তোকেও যাওয়ার জন্য বলেছেন।
এর কিছুক্ষণ পর আবারো ফোন এলো মেয়রের কাছ থেকে।
তিনি বললেন, আমার বাসায় আসা লাগবে না। তোমরা ভানুগাছ বাজারে চলে এসো, আমি আসতেছি।
একটু পর তিনি আবার ফোন দিয়ে বললেন, তোমরা কই? তাড়াতাড়ি এসো। আমি দোকানে বসা।
আমরা তাড়াতাড়ি রওনা দিলাম। বাজারে গিয়ে দেখা হলো মেয়রের সঙ্গে।
মেয়র জানতে চাইলেন, তুমি ৩৩৩ নম্বরে কল দিয়েছিলে? তুমি না গোবিন্দ পালের ছেলে?
আমি বললাম, জ্বি চাচা।
– তোমার পড়ালেখা কেমন চলছে?
– চাচা, ভালোই। চাচা, ও আমার গ্রামের বন্ধু। ওর আপনার সাহায্যের দরকার। আর আমি শুধু ওর জন্য বলি নাই গ্রামের অনেকের ত্রাণ পাবার আশায় কল দিছিলাম।
মেয়র বললেন, আপাতত এটা নাও, আর যাদের দরকার সবার কাছে ত্রাণ পৌঁছাবে।
মেয়রকে মুখে ধন্যবাদ তো দিলামই, মনে মনেও ধন্যবাদ দিতে দিতে ভাবলাম, এভাবেই যেন সবার কাছে সাহায্য পৌঁছে যায়। ধন্যবাদ মেয়র। ধন্যবাদ ৩৩৩। এতো দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে ভাবতেই অবাক লাগছে!
এভাবে যদি সবার কাছে সাহায্য পৌঁছে যেত! মানুষ পেটের চিন্তায় করোনাভাইরাস মহামারীকে আর ভয় করছে না। কিন্তু মানুষ ঠিকই ঘরে থাকবে, মানুষ করোনাভাইরাসকে মোকাবেলা করতে পারবে যদি তার দুই বেলার খাবার জুটে যায়।