শেখ হাসিনার প্রশান্তপারে আগমন ও তাঁর কাছে যা যায়, যা যায় না

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 1 Dec 2011, 06:11 PM
Updated : 26 April 2018, 03:20 AM

গণতন্ত্রের সুফল ও কু ফল আছে বৈকি। সুফল আমরা দেখছি পাশ্চাত্যে। আর কুফল ? ভারতেই দেখুন। মানুষ চায় বলে বিজেপি আজ সরকারে। সেই সরকার ভারতের এতদিনে তিলে তিলে গড়ে ওঠা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারাকে ব্যাহত করলেও মানতে হচ্ছে। নেহেরু কিংবা গান্ধীর ভারত আর আজকের ভারতে অনেক তফাৎ। তারপর ও মোদীর প্রিয়তা নিয়ে কথা চলেনা। এই পরিবর্তন সেখানকার ভবিষ্যৎ বা ভারতের রাজনীতিকে যেখানেই নিয়ে যাক আর্থিক ও বৈষয়িক উন্নয়নে  ভারত এগিয়ে চলেছে। চলেছে বলেই মানুষ সরকারের ধার ধারে না। কারণ পুঁজিবাদের যেটা নিশানা সেটাই এখন সার্থক। আদর্শ বা বোধ জাতীয় বিষয়গুলো থাকলে থাকলো না থাকলে নেই। মানুষ  আহার নিদ্রা মৈথুনে খুশী হলেই হলো। বলাবাহুল্য আজকের বাংলাদেশ ও সে পধে অনেকটাই এগিয়ে আছে। কিন্তু ভারতের ধর্মবিষয়ক রাজনীতি আর আমাদের ধর্মের রাজনীতির একটাই তফাৎ। আমাদের দেশে এই ধারাকে বেগবান করছে জাতীয়তাবাদী নামের শক্তি। যার কাছে দেশপ্রেম তুচ্ছ। ইতিহাস থাকলে আছে না থাকলে নাই। বিকৃতি আর গাঁজাখুরি গল্পে একটা কিছু হলেই হলো। সবার আগে চাই সরকারী পদ বা গদী। সেই কারণে দেশের মত বিদেশেও উগ্রতা হিংসা এবং ভেদাভেদ এখন চরম পর্যায়ে। যার একটা নমুনা দেখা গেলো বিলেতে।

শেখ হাসিনা এখন বিদেশে গেলেই যথাযোগ্য সম্মান ও পদকে ভূষিত হন। সেই উচ্চতা তাঁর অর্জন। এর মানে এই না তিনি যা করছেন তার সবটাই সমর্থনযোগ্য। কিন্তু এটাও মানতে হবে তাঁর কোন বিকল্প নেই। অন্তত এখন আমাদের শেষ ভরসা তিনি। ভারত বা পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইতিহাস বিষয়ক তর্ক নাই। তাঁরা গান্ধী জিন্নাহ বা দেশজ ইতিহাসকে অপমান করেনা। বিদেশেতো করেই না। বরং মোদীর মত সাম্প্রদায়িক দলের নেতাও গান্ধীর মূর্তির পাদদেশে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাতে বাধ্য হন। আমাদের দিকটা দেখুন। এবার ইংল্যান্ডে মানে লন্ডনে শেখ হাসিনার সফর কালে বিএনপির একদল কর্মী নেতারা চোখ কান খুইয়ে লজ্জা শরম ছেড়ে এমন স্লোগান দিলেন যাতে মধ্যযুগীয় বর্বরতার কথা মনে পড়াই স্বাভাবিক। ব্যক্তিজীবনে আমি সংশয়বাদী মানুষ। নিজের বিপদ আপদ ছাড়া ঈশ্বরের শরণাগত হবার কারণ পাইনা। কারণ দেখিনা ঈশ্বর বিষয়ক তর্কে ডুবে থাকার। কিন্তু কারো অনুভূতি বা ধর্মীয় বোধে আঘাত হানা আমার মতে অনুচিত। বিশেষত তার কারণ যদি হয় রাজনীতি।

বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতির জনক। যদি আপনি তা মানতে নাও চান আপনাকে রাষ্ট্রকাঠামোর অনেক বিষয়ের মত এ নিয়েও শালীন এবং সভ্য আচরণ করতে হবে। সেটা মাথায় না রেখে তারা লন্ডনের রাস্তায় হিন্দু অবতার বা দেব দেবীদের নামে এমন সব স্লোগান দিয়েছেন যাতে আঘাত লাগাটাই স্বাভাবিক। এদের কথায় কিছু আসে যায়না বলে যারা নিশ্চিন্তে ঘুমাব তারাও তলে তলে এগুলো চায়। কারণ এতে সহজ সাধারণ বাঙালি মুসলমানের মনে একটা খটকা তো লাগানো যায়। সেটা বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে ব্যবহার করার পরও তারা সে অস্ত্রের কাছে নতজানু। একদা এগুলো বলে ফায়দা হতো। ভোট বাড়তো। এখন হয় কি হয় না জানিনা, তবে এর প্রভাব বা অপইচ্ছা এখন বিলেতের মত জায়গায়ও তার বিকৃত চেহারা নিয়ে বেরিয়ে এসেছে।

শিগগিরই শেখ হাসিনা আসছেন অষ্ট্রেলিয়ায়। তাঁর আগমন নিয়ে  আওয়ামী লীগারদের ভেতর যত রাজনীতি তার ছিটেফোঁটাও নেই গঠনমূলক প্রচারণায়। ভাবখানা এই তিনি আসবেন তারা পালা করে ষ্টেজে যাবেন নিজেদের সুরত দেখাবেন ব্যস তাতেই কাজ শেষ। আমরা একথা বলার অধিকার রাখিনা কে ষ্টেজে যাবে আর কে যাবেন না। যারা দীর্ঘ সময় ধরে বিদেশে লীগের রাজনীতি করেন তারা কথা বলবেন এটা তাদের হক। কিন্তু যে আভাস ইঙ্গিত বা নমুনা দেখছি তাতে এটা নিশ্চিত নেত্রী ফিরে যাবার পর এখানকার আওয়ামী শক্তি দুর্বল হবেই। যার মূল কারণ তারুণ্য ও আওয়ামী লীগের প্রতি দুর্বল বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি এদের অনীহা। এখানে একটা মুশকিল এই, আমরা বললেই ধরে নেয় আমরা মঞ্চে যেতে চাই। এদের পোষ্য কিছু লেখক বা মুখ দেখানোর প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত নপুংসকরা ফেইসবুক বা সামাজিক মিডিয়ায় অসম্পাদিত দেয়ালে আমাদের যা খুশী গালাগাল করে ঝাল মেটায়। কিন্তু বাস্তবতা আসলে কি? যেখানে বাড়ী বাড়ী দাওয়াতের নামে ধর্মের রাজনীতি সচল যেখানে ঘরে ঘরে ধর্মের নামে বিভেদ বিভাজনের কারখানা সেখানে কি প্রগতির রাজনীতি নামে আওয়ামী লীগের কয়েকটি কমিটি বানানো? আর নেত্রী বা তেমন কেউ এলে তাদের সত্য জানতে না দেয়া? সবাই জানেন বাংলাদেশের অন্য যেকোন নেতারা এখন দুধভাত। তাদের কাছে কিছু বলা মানে অরণ্যে রোদন। একমাত্র বঙ্গবন্ধু কন্যাই কথা শোনেন আর তাঁর নির্দেশেই কাজ হয়। সেখানে নিজেদের কলহ জায়েজ করার নামে নিজেরা পিঠা ভাগ করে খেয়ে বাকিদের উচ্ছিষ্ট ভোগের জন্য ডেকে নেয়ার কি আদৌ কোন অর্থ আছে? প্রশ্ন উঠতে পারে সভা যখন আওয়ামী লীগের তারাইতো ঠিক করবেন কে কি করবে। একদম ঠিক কথা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কি শুধুই আওয়ামী লীগের? না দেশের? তিনি একাধারে নেত্রী আবার সরকার প্রধান। তার ওপরে আমাদের জাতির জনকের কন্যা। সবার চেয়ে  বড় কথা তাঁর প্রতি আমাদের বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসটুকুতে তারুণ্যকে যদি মর্যাদা দেয়া না হয় কারা সামলাবে প্রবাসী দূর্গ?

যারা বলেন দেশের রাজনীতির বিদেশে দরকার নেই আমি এখনো তাদের সাথে একমত হতে পারিনা। কারণ দরকার না থাকলে সেটা সবার জন্য দরকার নাই হতে হবে। তলে তলে বিএনপি জামাতের রাজনীতি চললে শুধু আওয়ামী লীগ বা বাম কিংবা প্রগতির রাজনীতি বন্ধ হবে কোন সুখে? কে না জানে বিএনপির আগামী দিনের নেতা তারেক রহমান থাকেন বিলেতে। আছে আওয়ামী লীগের সম্ভাবনার নেতারাও। ফলে একথা বলা যাবেনা বিদেশে দেশের রাজনীতি পুরোপুরি বন্ধ করা উচিৎ। বরং এর একটা সহনীয় মাত্রা আর সঠিক ব্যবহার প্রয়োজন। যারা নেত্রীকে ঘিরে থাকবেন তারা তাঁকে তা জানাবেন না। এটাই আমাদের বড় সমস্যা। মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৯ সালে যখন সিডনি এসেছিলেন তখন এত রাজনীতি আর দলভেদ দেখিনি। এখন এটা এমন পর্যায়ে যে এতে মাথা গলাতেও ভয় হয়। অথচ তখন যেসব তরুণেরা সাহসে ভর করে তাঁকে নালিশ জানিয়েছিল বা জানাতে পেরেছিল তিনি তা শুনে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতেও দেরী করেননি। এখন দেশের মত এখানেও রাখ রাখ ঢাক ঢাক চলছে। কোনক্রমে তাঁকে সব ঠিক বলে বিদায় দিয়ে নিজেরা ফটো আপলোড করতে পারলেই হবে।

না হবেনা। সামনে কঠিন সময়। নির্বাচন বলে নয়। সবমিলিয়ে শান্তি এখনো সুদূর পরাহত। খালেদা জিয়া কারাগারে। রাগে ফুঁসছে তার দল। তার বড়পুত্র নিশ্চুপ বসে নেই। বিএনপির শক্তিকে অবহেলা করা হবে চূড়ান্ত বোকামী। এবার প্রবাসীরা ভোট দিতে পারবেন না বটে তবে তাদের মতামত অর্থ ও লবিং-এর জোর আছে। সবচেয়ে বড় বিষয় তাদের মতামত বা সমর্থনের জোর। সেটা সম্পূর্ণ আওয়ামী লীগের দিকে এটা কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না। বরং ঘষামাজা আর পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে তাদের। সে জায়গাটা প্রধানমন্ত্রী এসে ঠিক করে দিতে পারবেন না। পারবেন দিক-নির্দেশনা দিতে। পারবেন সমস্যা জানলে সমাধান বাতলে দিতে। তাঁর কাছে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ খবর যাওয়া জরুরী। যেটা তারুণ্য ও বুদ্ধিবৃত্তি ছাড়া আর কারো দ্বারা হবার নয়। কিন্তু সে এক চিত্র এক ছবি। আমরা আমরা করতে করতে আমাদের ভবিষ্যত ও রাজনীতি কখনো বিপদ অতিক্রম করতে শেখেনি।

খুব অাশ্চর্য না হলেও অবাক হচ্ছি কাল পর্যন্ত যারা একে অপরকে আটকানোর জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে ছিলেন কুৎসা রটিয়ে বা ঘটনা ফাঁস করার নামে তারুণ্যকে নিয়ে খেলেছেন তারাই আজ আপোসের জালে। এই আপোস শুধু মাত্র নেত্রীর সাথে বসার বা তাঁকে দেখানোর প্রতিযোগিতা। আগেই লিখেছি আমাদের পচনের কথা; আদর্শহীনতা এবং চারিত্র আমরা দেশ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করে নিয়ে আসি। এবং সময় ও সুযোগ মত তার ব্যবহার করে  বুঝিয়ে দিতে  চাই, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি। অথচ বঙ্গবন্ধু বড় আশা নিয়ে বলেছিলেন দেখে যাও কবিগুরু তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।

একটাই কথা মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী যেন সত্য ও সঠিক বিষয় জানতে পারেন। তাঁর সামনে এখানে লড়াইরত তারুণ্য বা বাংলা বাঙালির প্রতি নিবেদিত জনেরা যেতে পারুক বা না পারুক তাঁকে জানতে হবে কোথায় কেন এবং কি হচ্ছে। তিনি আমাদের ভরসা। তাঁর নিরাপত্তা সম্মান আর মর্যাদা যেন আমাদের উজ্জীবিত করে প্রেরণা যোগায়। তিনি আসবেন আবার চলেও যাবেন, থেকে যাবে পদরেখা। থাকবে ভালোমন্দের স্মৃতি। সেখানেই আমাদের আগমী দিনের পথচলা। বঙ্গবন্ধু প্রশান্তপারে আসেননি। আমাদের সৌভাগ্য তাঁর কন্যা আগেও এসেছিলেন এবারেও আসছেন। তাঁর এই আগমন এখন বিশ্বজনীন । তিনি দুনিয়ায় যে বিরল সম্মান ও ঔজ্জ্বল্যে দীপ্র তার আলোয় ভাসুক সিডনি।

প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে বলি আপনি স্পষ্টভাষী। আপনি নিজের মেধা দিয়ে প্রজ্ঞা দিয়ে ঘটনা যাচাই করেন। আপনার মান অভিমান চিন্তা ও বিবেকে  যে-জাতিসত্তা আজ তার বিস্তার ও প্রসারে আমরা গর্বিত। আমাদের সবার একটাই কামনা আপনার সফর হোক সফল । আপনি নিজগুণে বুঝে নেবেন কারা বা কি আপনার কাছে যায় আর কি যায় না। তাহলেই সবাই নিরাপদে থাকবে। সে দূরদর্শিতা আপনার আছে বলেই আপনি জননেত্রী।

প্রশান্তপারের বাঙালি আপনার আগমন ও কথা শোনার দিন গুনছে।